শুক্রবার 19 রমজান 1445 - 29 মার্চ 2024
বাংলা

শাইখ ফকীহ মোল্লা আলী আল-ক্বারী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

225410

প্রকাশকাল : 15-04-2015

পঠিত : 15524

প্রশ্ন

প্রশ্ন: আলী বিন সুলতান মুহাম্মদ আল-ক্বারী কে? তিনি কি নির্ভরযোগ্য, তাঁর থেকে কি ইলম গ্রহণ করা যাবে?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

আলহামদুলিল্লাহ।

তাঁর নাম হচ্ছে- আলী বিন সুলতান মুহাম্মদ। উপনাম- আবুল হাসান। উপাধি- নুরুদ্দীন। তিনি একাধারে ফিকাহবিদ, মুহাদ্দিস ও ক্বারী। বাসস্থানের বিবেচনা থেকে তাঁকে হারাবি ও মক্কী বলা হয়। তিনি ‘মোল্লা আলী ক্বারী’ নামে সুপরিচিত।

তাঁকে ক্বারী উপাধি দেয়া হয়েছে; যেহেতু কুরআনের ভিন্ন ভিন্ন পঠনপদ্ধতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। খোরাসানের প্রধান শহর ‘হারাত’ এর বাসিন্দা হিসেবে তাঁকে ‘হারাবী’ বলা হয়। খোরাসান বর্তমানে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত।

তাঁকে মক্কী বলা হয় যেহেতু তিনি মক্কায় সফর করেছেন, মক্কার আলেমদের থেকে ইলম অর্জন করেছেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করেছেন।

তিনি ৯৩০ হিজরি সালের দিকে ‘হারাত’ শহরে জন্মগ্রহণ করেছেন। সেখানেই বড় হয়েছেন, ইলম অর্জন করেছেন, কুরআন শরিফ মুখস্থ করেছেন। তিনি শাইখ মঈন উদ্দীন বিন হাফেয যাইন উদ্দীন আল-হারাবী এর নিকট তাজবিদ শিক্ষা লাভ করেছেন। তিনি সমকালীন আলেমগণের নিকট ইলমে দ্বীন অর্জন করেছেন। এরপর তিনি মক্কায় চলে আসেন। মক্কাতে থেকে সেখানকার আলেমগণের নিকট দীর্ঘ মেয়াদে ইলমে দ্বীন অর্জন করেছেন। এভাবে ইলম অর্জনের মাধ্যমে মশহুর আলেমে পরিণত হন। তিনি হানাফি মাযহাবের আলেম ছিলেন। তার গ্রন্থাবলি ও জীবনী থেকে সেটাই জানা যায়। হানাফি মাযহাবের অনেক মাসয়ালা নিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন এবং এ মাযহাবের পক্ষে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন।

তিনি দ্বীনদার, তাকওয়াবান ও সুচরিত্রের অধিকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিজ হাতে কাজ করে খেতেন। তিনি ছিলেন দুনিয়ার বিরাগী, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ও অল্পে তুষ্ট একজন ব্যক্তি।

মানুষের সাথে কম মিশতেন। ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। সুন্দর হস্তাক্ষরে প্রতি বছর একটি করে কুরআন শরিফ লিখতেন। লিখিত কুরআন শরিফের পার্শ্বটীকাতে ক্বিরাআত ও তাফসির লিখতেন। সেটি বিক্রি করে যা পেতেন তা দিয়ে তাঁর বছর চলে যেত।

তিনি মনে করতেন শাসকদের নিকটবর্তী হওয়া এবং তাদের উপঢৌকন গ্রহণ করা ইখলাস ও তাকওয়ার পরিপন্থী। তিনি বলতেন: “আল্লাহ আমার পিতার প্রতি রহম করুন। তিনি বলতেন: আমি চাই না যে, তুমি আলেম হও; এই আশংকায় যে, তুমি আমীর-ওমরাদের দরজায় ধরনা দিবে।” [মিরকাতুল মাফাতীহ (১/৩৩১)]

ইলম, আমল ও নেকীর কাজে ভরপুর জীবন কাটিয়ে তিনি ১০১৬ হিজরীতে মতান্তরে ১০১০ হিজরীতে মক্কাতে মৃত্যুবরণ করেন। তবে অগ্রগণ্য মতানুযায়ী তিনি ১০১৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন এবং মুয়াল্লা নামক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন-

-      ইবনে হাজার আল-হাইছামী আল-ফকীহ

-      আলী মুত্তাকি আল-হিন্দি

-      আতিয়্যা বিন আলী আল-সুলামি

-      মুহাম্মদ সাঈদ আল-হানাফি আল-খোরাসানি

-      আব্দুল্লাহ আল-সিন্দি

-      কুতুবুদ্দিন আল-মাক্কী

তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন-

-      আব্দুল কাদের আল-তাবারী

-      আব্দুর রহমান আল-মুরশিদি

-      মুহাম্মদ বিন ফার্‌রুখ আল-মাওরাবী

লোকেরা তাঁর ভূয়শী প্রশংসা করেছেন:

আল-হামাবি ‘খুলাসাতুল আছার’ গ্রন্থ (৩/১৮৫) এ বলেন:

“তিনি ইলমের কর্ণধার, যুগের অনন্য, মতামত বিচার-বিশ্লেষণে অতুলনীয়, তাঁর প্রসিদ্ধি তাঁর গুণ বর্ণনার জন্য যথেষ্ট।”

আল-ইসামি ‘সামতুন নুজুম’ গ্রন্থ (৪/৪০২) এ বলেন:

“আকলি ও নকলি (বর্ণনানির্ভর ও যুক্তিনির্ভর) উভয় জ্ঞানের ভান্ডার। হাদিসে রাসূলের পূর্ণ সুধা পানকারী। মুখস্থ শক্তি ও বোধশক্তির জন্য প্রসিদ্ধ ও নামকরা একজন ব্যক্তিত্ব।”

লাখনাবি তাঁর ‘আত-তালিক আল-মুমাজ্জাদ’ গ্রন্থে বলেন:

“অত্যুজ্জ্বল ইলম ও স্বনামধন্য মর্যাদার অধিকারী”

এরপর তিনি তাঁর লিখিত বেশ কিছু গ্রন্থ উল্লেখ করে বলেন:

এগুলো ছাড়াও তাঁর লিখিত আরও অগণিত পুস্তিকা রয়েছে; সবগুলো মূল্যবান।

নোমানী তার ‘আল-বিজাতুল মুযজাত’ নামক গ্রন্থ (পৃষ্ঠা-৩০) এ বলেন:

“তিনি ছিলেন সমকালীন আলেমদের মধ্যে সেরা। প্রসিদ্ধ ইমাম, মহান আল্লামা। আকলি ও নকলি অনেক জ্ঞানের আধার ছিলেন তিনি। হাদিস, তাফসির, ক্বিরাআত, উসুলে ফিকহ, আরবী ভাষা, ভাষাবিজ্ঞান ও বালাগাত ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন।”।

ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) ও ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) কে তিনি যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। তাঁদের দুজনের উপর আরোপিত অভিযোগগুলো তিনি খণ্ডন করতেন এবং তাঁদের পক্ষ নিয়ে কথা বলতেন। তাঁর গ্রন্থাবলির অনেক স্থানে তিনি সলফে সালেহিনের আকিদা সাব্যস্ত করেছেন। যদিও তাঁর গ্রন্থাবলির কিছু কিছু স্থানে সলফে সালেহিনের ‘মানহাজ’ (নীতি) এর পরিপন্থী বিষয় পাওয়া যায়। সেসব ক্ষেত্রে তিনি হানাফি-মাতুরিদি আলেমগণের মাযহাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আল্লাহর গুণাবলি সংক্রান্ত আয়াতগুলোর ক্ষেত্রে তিনি সলফে সালেহিনদের পরবর্তী আলেমদের নীতি গ্রহণ করেছেন অথবা আল্লাহর গুণাবলিকে ভিন্নার্থে ব্যাখ্যা করার নীতির অনুসারী ছিলেন। জেনে রাখুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য সবার মধ্যে গ্রহণীয় ও বর্জনীয় উভয় দিক থাকবে ।

দেখুন: আস-শামস আল-আফগানি লিখিত ‘আল-মাতুরিদিয়্যা’ (১/৩৫০), (১/৫৩৭-৩৪০)।

তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলো হচ্ছে-

-      তাফসিরুল কুরআন

-      মিরকাতুল মাফাতিহ

-      শারহু নুখবাতুল ফিকার

-      আল-ফুসুল আল-মুহিম্মাহ

-      শারহু মুশকিলাতুল মুয়াত্তা

-      বিদাআতুস সালিক

-      শারহুল হিসনিল হাসিন

-      শারহুল আরবায়িন নাবাবিয়্যা

-      জাওউল মাআলি

-      শাম্মুল আওয়ারিদ ফি যাম্মির রাওয়াফেয

-      ফাইযুল মুয়িন

-      রিসালা ফির্‌ রাদ্দ আলা ইবনে আরাবি ফি কিতাবিহি আল-ফুসুস ওয়া আলাল কায়িলিনা বিল হুলুল ওয়াল ইত্তিহাদ

এছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ।

আরও জানতে দেখুন:

-      যিরিকলি এর ‘আল-আলাম’ (৫/১২-১৩)

-      কান্দালাবি এর ‘আত-তালিক আস-সাবিহ আল মিশকাতিল মাসাবিহ’ (পৃষ্ঠা-৬)

-      লাখনাবি এর ‘আত-তালিকাত আস-সানিয়্যাহ’ (পৃষ্ঠা ৮-৯)

-      মুহাম্মদ আব্দুর রহমান আল-শামা এর ‘আল-মোল্লা আলী আল-ক্বারি ফিহরিস মুআল্লাফাতিহি ওয়ামা কুতিবা আনহু

আল্লাহই ভাল জানেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব