আমরা আশা করছি, আপনাদের ওয়েবসাইট Islam Q&A (ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব) কে সাপোর্ট দেয়ার জন্য মুক্তহস্তে দান করবেন; যাতে করে ইনশা আল্লাহ্ ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সেবায় আপনাদের ওয়েবসাইট তার পথ চলা অব্যাহত রাখতে পারে।
তারাবীর নামায জামাতের সাথে মসজিদে আদায় করা উত্তম; নাকি ঘরে আদায় করা?
আলহামদু লিল্লাহ।.
তারাবীর নামায মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করা ঘরে আদায় করার চেয়ে উত্তম।
সুন্নাহ থেকে ও সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়:
১। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক রাতে মসজিদে নামায আদায় করলেন। তাঁর পেছনে লোকেরাও নামায আদায় করল। পরবর্তী রাতেও নামায পড়লেন এবং লোকসংখ্যা বেড়ে গেল। এরপরে তৃতীয় রাতে বা চতুর্থ রাতেও মানুষ জমায়েত হল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে বের হলেন না। যখন ভোর হল তিনি বললেন: "তোমরা যা করেছ (অর্থাৎ জমায়েত হওয়াটা) তা দেখেছি। তবে তোমাদের দিকে বের হতে আমাকে অন্য কিছু বাধা দেয়নি; শুধু আমি ভয় করেছি যে, এ নামায তোমাদের উপর ফরয করে দেয়া হয় কিনা? এটি ছিল রমযান মাসে।"
এ হাদিসটি প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ্র মাধ্যমে তারাবীর নামায জামাতের সাথে পড়া শরিয়তসম্মত। তবে তিনি জামাতের সাথে তারাবী পড়া বাদ দিয়েছেন এ ভয়ে না জানি সেটা উম্মতের উপর ফরয করে দেওয়া হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মারা গেলেন তখন এ আশংকা দূর হয়ে গেল যেহেতু শরিয়ত স্থিতিশীল হয়ে গেছে।
২। আবু যার থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি ইমামের সাথে কিয়াম (অর্থাৎ তারাবীর নামায) আদায় করবে যতক্ষণ না ইমাম নামায শেষ করেন; তার জন্য সম্পূর্ণ রাত কিয়াম করার সওয়াব লেখা হবে।”[সুনানে তিরমিযি (৮০৬), আলবানী 'সহিহুত তিরমিযি' গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
৩। আব্দুর রহমান বিন আব্দুল ক্বারী থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: "রমযান মাসের কোন এক রাতে আমি উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) এর সাথে মসজিদে গেলাম। গিয়ে দেখতে পেলাম মানুষ বিভিন্ন দলে বিভক্ত। কেউ নিজে নিজে নামায পড়ছে। কারো ইমামতিতে কিছু লোক নামায পড়ছে। তখন উমর (রাঃ) বললেন: আমি মনে করি এদের সকলকে যদি একজন ক্বারীর পেছনে একত্রিত করি তাহলে সেটা উত্তম হবে। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এবং উবাই বিন কাব (রাঃ) এর অধীনে তাদেরকে একত্রিত করলেন।"[সহিহ বুখারী (২০১০)]
হাফেয ইবনে হাজার বলেন:
"ইবনুত ত্বীন ও অন্যান্য আলেম বলেছেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ রাতগুলোতে যাদেরকে তার সাথে নামায পড়ার অনুমোদন করেছিলেন সেখান থেকে উমর (রাঃ) এটি উদ্ভাবন করেছেন। যদিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জন্য সেটা অপছন্দ করেছেন। কিন্তু তিনি অপছন্দ করার কারণ ছিল তাদের ওপর ফরয করে দেয়ার আশংকা। যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা গেলেন তখন এ আশংকা কেটে গেল এবং উমর (রাঃ) এর নিকট এভাবে নামায পড়াটা অগ্রগণ্য প্রতীয়মান হল; যেহেতু বিচ্ছিন্নভাবে নামায পড়াটা অনৈক্য। এবং যেহেতু এক ইমামের পেছনে সম্মিলিতভাবে নামায পড়া অনেক মুসল্লির জন্য কর্মচাঞ্চল্যকর। উমর (রাঃ) এর অভিমতের প্রতি জমহুর আলেম ঝুঁকেছেন।"[ফাতহুল বারী থেকে সমাপ্ত]
ইমাম নববী 'আল-মাজমু' গ্রন্থে (৩/৫২৬) বলেন:
আলেমদের ইজমার ভিত্তিতে তারাবীর নামায সুন্নত...। তারাবী নামায একাকী ও জামাতের সাথে আদায় করা জায়েয আছে। কিন্তু কোনটি উত্তম? এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ দুইটি অভিমত রয়েছে। মাযহাবের আলেমদের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সঠিক অভিমত হল: জামাতের সাথে আদায় করা উত্তম। দ্বিতীয় অভিমত হল: একাকী আদায় করা উত্তম।
আমাদের মাযহাবের আলেমগণ বলেন: মতভেদ রয়েছে ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে যার কুরআন মুখস্থ আছে, একাকী নামায পড়লেও সে অলসতার আশংকা করে না এবং সে হাজির না হলেও মসজিদে তারাবীর জামাত প্রতিষ্ঠিত হতে অসুবিধা হবে না। যদি উল্লেখিত বিষয়গুলোর কোন একটি পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে কোন মতভেদ ছাড়া জামাতের সাথে তারাবী পড়া উত্তম।
আল-শামেল গ্রন্থকার বলেন: আবুল আব্বাস ও আবু ইসহাক বলেন: সাহাবায়ে কেরামের ইজমা ও আলেমদের ইজমার ভিত্তিতে জামাতের সাথে তারাবীর নামায পড়া একাকী পড়ার চেয়ে উত্তম।[সমাপ্ত]
তিরমিযি বলেন:
"ইবনুল মুবারক, আহমাদ, ইসহাক প্রমুখের মনোনীত অভিমত হচ্ছে রমযান মাসে ইমামের সাথে (তারাবী) নামায পড়া।"
তুহফাতুল আহওয়াযি গ্রন্থে বলেন:
কিয়ামুল লাইল অধ্যায়ে এসেছে: আহমাদ বিন হাম্বলকে বলা হল: রমযান মাসে কোন ব্যক্তি সবার সাথে নামায পড়াটা আপনি পছন্দ করেন; নাকি একাকী নামায পড়াটা পছন্দ করেন?
তিনি বলেন: সবার সাথে নামায পড়া। তিনি আরও বলেন: আমার পছন্দ হল ইমামের সাথে (তারাবী) নামায পড়া ও বিতির (নামায) পড়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: "কেউ যদি ইমামের সাথে কিয়াম পালন করে যতক্ষণ না ইমাম শেষ করেন তার জন্য অবশিষ্ট রাত কিয়াম পালন লিখে দেওয়া হবে।" আহমাদ (রহঃ) বলেন: সবার সাথে কিয়াম পালন করে শেষে তাদের সাথে বিতির পড়বে। ইমাম নামায শেষ করার আগে নামায ছেড়ে চলে যাবে না।
আবু দাউদ বলেন: আমি রমযান মাসে তার সাথে (অর্থাৎ ইমাম আহমাদের সাথে) ছিলাম। তিনি ইমামের সাথে বিতির পড়তেন। শুধু একরাতে আমি হাযির হইনি।
ইসহাক (রহঃ) বলেন: আমি আহমাদকে বললাম: রমযান মাসের কিয়ামুল লাইল এর ক্ষেত্রে জামাতের সাথে নামায পড়া আপনার কাছে প্রিয়; নাকি একাকী নামায পড়া? তিনি বললেন: আমার কাছে জামাতের সাথে নামায পড়ে সুন্নতকে পুনর্জীবিত রাখা পছন্দনীয়। তিনি যে মত দিয়েছেন ইসহাকও অনুরূপ অভিমত দেন।[সমাপ্ত][দেখুন: আল-মুগনী (১/৪৫৭)]
শাইখ উছাইমীন "মাজালিসু শাহরি রামাযান" এ (পৃষ্ঠ-২২) বলেন:
"নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই প্রথম ব্যক্তি যিনি মসজিদে জামাতের সাথে তারাবীর নামায পড়ার সুন্নত চালু করেন। এরপর তিনি উম্মতের উপর ফরয হওয়ার ভয়ে ছেড়ে দেন...। এরপর তিনি পূর্বোক্ত হাদিসদ্বয় উল্লেখ করেন। এরপর তিনি বলেন: কোন ব্যক্তির তারাবীর নামায বাদ দেওয়া উচিত নয়; যাতে করে সওয়াবের অধিকারী হন। ইমাম তারাবীর নামায ও বিতির নামায শেষ করার আগে চলে যাবেন না; যাতে করে গোটা রাত নামায পড়ার সওয়াব পেতে পারেন।[সংক্ষেপিত]
শাইখ আলবানী "কিয়ামু রামাযান" গ্রন্থে বলেন:
রমযান মাসে কিয়ামুল লাইল জামাতের সাথে আদায় করা শরিয়তসম্মত। বরং একাকী আদায় করার চেয়ে উত্তম। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া নিজেই সেটা করেছেন এবং এর ফজিলত নিজ ভাষাতে বর্ণনা করেছেন।
তবে মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে তিনি সাহাবীদেরকে নিয়ে কিয়াম পালন করেননি এই ভয়ে যে, না জানি তাদের উপর ফরয করে দেওয়া হয়। ফরয করা হলে তারা এ নামায আদায়ে অক্ষম হয়ে পড়ত; যেমনটি 'সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম' এবং অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে এসেছে। আল্লাহ্ তাআলা শরিয়তকে পরিপূর্ণ করে দেয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর এ ভয়টি কেটে যায়। ভয় কেটে যাওয়ার মাধ্যমে কারণের ফলাফলটিও দূর হয়ে যায়; সেটি হচ্ছে রমযান মাসে কিয়ামুল লাইল জামাতে আদায় না করা এবং পূর্বের হুকুমটি অটুট হয়ে যায়; সেটি হচ্ছে জামাতের সাথে নামায আদায়ের শরয়ি স্বীকৃতি। তাই উমর (রাঃ) এ আমলটিকে জীবিত করেছেন; যেমনটি সহিহ বুখারী ও অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।[আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা (২৭/১৩৮)]
উমর (রাঃ) এর যামানা থেকে সুপথ গ্রহণকারী খলিফাগণ ও মুসলিম জনসাধারণ জামাতের সাথে তারাবীর নামায আদায় করে আসছে। উমর (রাঃ) সেই ব্যক্তি যিনি তারাবীর নামাযের জন্য মানুষকে এক ইমামের পেছনে একত্রিত করেছেন...।
আবু ইউসুফ থেকে আসাদ বিন আমর বর্ণনা করেন তিনি বলেন: আমি আবু হানিফা (রহঃ) কে তারাবীর নামায সম্পর্কে এবং উমর (রাঃ) যা করেছেন সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: তারাবীর নামায সুন্নতে মুয়াক্কাদা। উমর (রাঃ) নিজ থেকে ধারণা করে কিছু করেননি। এক্ষেত্রে তিনি নতুন কিছু প্রবর্তনকারী নন। তিনি তাঁর কাছে যে দলিল ছিল ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে আমল ছিল সেটা ছাড়া এ নির্দেশ দেননি। উমর (রাঃ) এ সুন্নত চালু করেছেন এবং মুসলমানদেরকে উবাই বিন কাব (রাঃ) পেছনে একত্রিত করেছেন। আনসার ও মুহাজিরদের ভরা উপস্থিতিতে উবাই (রাঃ) জামাতের সাথে এ নামায আদায় করেছেন অথচ তাদের একজনও তার বিরোধিতা করেনি। বরং তারা সকলে তাকে সহযোগিতা করেছেন, সম্মতি দিয়েছেন এবং এটি পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।[সমাপ্ত]
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।