আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
আলেমরা একমত যে শিশুর বোধশক্তির বয়স হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নারীই তাকে প্রতিপালন করার অধিকার বেশি রাখেন। কারণ জীবনের এই বয়সে শিশুর এমন মমতা ও এমন দেখাশোনার প্রয়োজন যেটা কেবল মহিলারাই করতে পারে। কিন্তু স্ত্রী যদি বিয়ে করে তাহলে এই অধিকার বাতিল হয়ে যায়। কারণ তখন সে তার সন্তানের দেখভাল ছেড়ে স্বামীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সন্তানের কল্যাণ ও স্বামীর কল্যাণের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। ইবনুল মুনযির রাহিমাহুল্লাহ এ ব্যাপারে আলেমদের ইজমা বর্ণনা করেছেন যে, বিয়ের মাধ্যমে মায়ের প্রতিপালন করার অধিকার বাতিল হয়ে যায়।
দেখুন: ইবনু আব্দুল বার রচিত ‘আল-কাফী’ (১/২৯৬) ও ‘আল-মুগনী’ (৮/১৯৪)।
এর পক্ষে দলীল হলো আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার হাদীস, তিনি বর্ণনা করেন, এক মহিলা বললেন: “হে আল্লাহর রাসূল! আমার পেট ছিল আমার এই ছেলের অবস্থানস্থল, আমার স্তনদ্বয় ছিল তার জন্য মশক, আমার কোলই ছিল তার আশ্রয়স্থল। তার বাবা আমাকে তালাক দিয়েছে এবং আমার কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নেয়ার ইচ্ছা করছে।” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ নারীকে বললেন: “তুমিই এ সন্তানের (পালনের) অধিক হকদার যতক্ষণ তুমি অন্য স্বামী গ্রহণ না করবে।”[হাদীসটি ইমাম আহমদ (৬৭০৭) ও আবু দাউদ (২২৭৬) বর্ণনা করেন। শাইখ আলবানী তার সহীহু আবি দাউদে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। ইবনু কাসীর তার ‘ইরাশাদুল ফকীহ’ বইয়ে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]
দুই:
আলেমদের ঐকমত্যে পিতার জন্য সন্তানদের খরচ দেওয়া আবশ্যক, সে স্ত্রীকে তালাক দিক কিংবা ধরে রাখুক। স্ত্রী দরিদ্র হোক কিংবা ধনী, স্ত্রীর জন্য সন্তানদের পিতার উপস্থিতিতে সন্তানদের জন্য খরচ করা আবশ্যক নয়।
তালাকপ্রাপ্ত নারী যদি সন্তানকে প্রতিপালন করে, তাহলে সন্তানের খরচ দেওয়ার দায়িত্ব তাদের বাবার। আর প্রতিপালনকারী এবং দুগ্ধদানকারী স্ত্রী সন্তানকে দুধ পান করানোর বিনিময়ে অর্থ চাইতে পারে।
সন্তানদের খরচের অন্তর্ভুক্ত হবে তাদের বাসস্থান, খাবার-পানীয়, পোশাক, শিক্ষা-দীক্ষা… প্রভৃতি যত বিষয় তাদের প্রয়োজন। আর এটির পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে প্রচলিত প্রথা অনুসারে এবং স্বামীর অবস্থাকে বিবেচনা করে। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী:
لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا سَيَجْعَلُ اللَّهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُسْرًا
“বিত্তবান ব্যক্তি তার বিত্ত অনুযায়ী ব্যয় করবে। আর যার জীবিকা সীমিত (সংকুচিত) করা হয়েছে, সে ব্যয় করবে আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকে। আল্লাহ যাকে যতটুকু দিয়েছেন তার চেয়ে বেশি তিনি কাউকে ব্যয় করতে বলেন না। কষ্টের পর আল্লাহ স্বাচ্ছন্দ্য দান করেন।”[সূরা তালাক: ৭] তাই স্থানভেদে ও ব্যক্তিভেদে এটি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।
স্বামী যদি বিত্তশালী হয় তাহলে তার বিত্তের মাত্রা অনুযায়ী খোরপোষ দিবে। আবার যদি দরিদ্র কিংবা মধ্যবিত্ত হয়, তাহলে নিজ অবস্থা অনুসারে সে দিবে। পিতা-মাতা যদি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের ব্যাপারে সম্মত হয়, হোক সেটা কম বা বেশি, তাহলে বিষয়টি দুজনের হাতে। আর দ্বন্দ্বের সময় বিচারক তাদের মাঝে ফয়সালা করবেন।
তালাকপ্রাপ্তা নারীর জন্য সন্তানকে দুধ পান করানোর বিনিময়ে অর্থ চাওয়া বৈধ, এ ব্যাপারে আলেমরা একমত।
ইবনু কুদামা রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “সন্তানকে দুগ্ধপান করানোর দায়িত্ব কেবলই পিতার। মা তালাকপ্রাপ্তা হলে তাকে সন্তানের দুগ্ধ পান করানোর কাজে বাধ্য করার অধিকার পিতার নেই। আমরা এ ব্যাপারে কোনো মতভেদ জানি না।”[সমাপ্ত][আল-মুগনী: (১১/৪৩০) ঈষৎ পরিবর্তিত]
তিনি আরো বলেন: ‘মা যদি তার দুধ পান করানোর ক্ষেত্রে অনুরূপ দুধের মূল্য চায়, তাহলে মা-ই তাকে দুধ পান করানোর অগ্রাধিকার রাখে; পিতা দুধ পান করানোর ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবী কাউকে পেয়ে যাক কিংবা না খুঁজে পাক।’[আল-মুগনী: (১১/৪৩১)]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “দুধ পান করানোর মূল্য তার জন্য, এ প্রসঙ্গে আলেমরা একমত। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “তারা যদি তোমাদের (বাচ্চাদের) দুধ পান করায় তাহলে তোমরা তাদেরকে মজুরি দাও।”[সমাপ্ত][আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা (৩/৩৪৭)]
তিন:
একদল আলেমের সংজ্ঞায়নে حضانة তথা প্রতিপালন করা বলতে বোঝানো হয়: ‘যে শিশু সঠিক-ভুল আলাদা করতে পারে না এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না, তার দেখভাল করা, তার প্রতিপালন করা এবং তার ক্ষতি হয় এমন কিছু থেকে তাকে রক্ষা করা।’[রাওদাতুত তালিবীন: (৯/৯৮)] এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো শিশুকে প্রতিপালন করা, তার বিষয়গুলো দেখাশোনা করা; সুতরাং এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হলো যার প্রতিপালন করা হচ্ছে তার কল্যাণ সাধন করা। আর তাই বাবা যদি সন্তানের প্রতি এই দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকে (তন্মধ্যে রয়েছে খরচ দেওয়া) তাহলে সে এর জন্য পাপী হবে। তার প্রতিপালনের অধিকার বাতিল হয়ে যাবে। আর-রাওদুল মুরবি গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে: “প্রতিপালিত শিশুকে এমন কারো হাতে সোপর্দ করা হবে না, যে তার দেখভাল করে না এবং তাকে যথাযথভাবে গড়ে তোলে না; কারণ এমনটি করা হলে প্রতিপালনের মূল লক্ষ্যই ব্যাহত হবে।”[আর-রাওদুল মুরবি (৩/২৫১)]
ইবনু কুদামা আল-মাকদিসী বলেন: “প্রতিপালনের দায়িত্ব সাব্যস্ত হয় সন্তানের কল্যাণের জন্য, সুতরাং তার ধ্বংস হবে এবং তার দ্বীন ধ্বংস হবে এমন কোনো বিষয় থাকলে তা সাব্যস্ত হবে না।”[আল-মুগনী: (৮/১৯০)]
ইবনুল কাইয়িম বলেন: “আমরা যেহেতু পিতা-মাতার একজনকে প্রাধান্য দিচ্ছি, সেহেতু আমাদেরকে বিবেচনায় নিতে হবে যে সে সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনা করবে কিনা। এ কারণে মালেক ও লাইস বলেছেন: মা যদি সংরক্ষিত স্থানে কিংবা সন্তোষজনক অবস্থায় না থাকে, তাহলে বাবা তার থেকে মেয়েকে নিয়ে নিতে পারবেন। অনুরূপভাবে ইমাম আহমদ থেকে তার প্রসিদ্ধ বর্ণনায়ও এমনটি বর্ণিত হয়েছে। তিনি সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণে পিতার ক্ষমতাকে বিবেচনা করেন। যদি পিতা এতে অবহেলা করে অথবা অক্ষম থাকে অথবা তার অবস্থা সন্তোষজনক না হয় অথবা অশ্লীলতার অনুমোদনকারী হয়ে থাকে, আর সন্তানের মা এর বিপরীত হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে মা মেয়েকে পাওয়ার অধিক হকদার। আমাদের শাইখ বলেন: বাবা-মায়ের কোনো একজন যদি সন্তানকে শিক্ষাদান এবং আল্লাহ যা আবশ্যক করেছেন সেটা পালনের নির্দেশদান পরিত্যাগ করে; তাহলে সে অবাধ্য। সন্তানের উপর তার অভিভাবকত্ব থাকবে না। বরং অভিভাবকত্বে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজ দায়িত্ব পালন না করলে অভিভাবকত্ব হারাবে। তার হাত থেকে দায়িত্ব কেড়ে নিয়ে এমন কাউকে দেওয়া হবে যে এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে। অথবা তার সাথে এমন কাউকে যুক্ত করা হবে যে তার সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করবে। কারণ লক্ষ্য হলো সাধ্যমত আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করা। … যদি ধরে নেওয়া হয় যে বাবা এমন এক নারীকে বিয়ে করল যে তার মেয়ের কল্যাণ বিবেচনা করে না এবং যথাযথ পরিচর্যা করে না, তার এই সৎমায়ের তুলনায় তার মা তার কল্যাণ সাধনে বেশি সক্ষম; তাহলে নিশ্চিতভাবে প্রতিপালনের দায়িত্ব মা-ই পাবে।”[যাদুল মাআদ (৫/৪২৪)]
শাইখ আব্দুর রহমান আস-সাদী বলেন: “যদি তাদের একজন নিজের উপর থাকা সন্তান প্রতিপালন এবং তাকে গড়ে তোলার দায়িত্বে অবহেলা করে, তাহলে তার অভিভাবকত্ব বাতিল হয়ে যায় এবং অন্যের জন্য দায়িত্ব নির্ধারিত হয়ে যায়।” [আল-ফাতাওয়া আস-সা’দিয়্যা (পৃ. ৫৩৫)]
সুতরাং এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, পিতা যদি সন্তানদের জন্য খরচ দেওয়া থেকে বিরত থাকে, তাহলে তাদেরকে প্রতিপালনের অধিকার সে হারিয়ে ফেলে; যদিও তার উদ্দেশ্য থাকে সন্তানদের মায়ের ক্ষতি করা। তার এই কাজ প্রমাণ করে যে সে তার সন্তানদের কল্যাণের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি নয়। এক্ষেত্রে মা তার সন্তানদের খরচের ব্যাপারে বিচারকের বিচারপ্রার্থী হতে পারে।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।