শুক্রবার 8 রবীউছ ছানী 1446 - 11 অক্টোবর 2024
বাংলা

আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসা ঈমানের সর্বাধিক শক্তিশালী বন্ধন

প্রশ্ন

আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসা এবং এ ভালোবাসার অধিকার ও দাবী আদায় করা কি ইবাদত ও আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের মাধ্যম? এটা কি নফল ইবাদতের মর্যাদায়; নাকি হজ্জের, যেমনটি হাসান বসরী জনৈক ব্যক্তিকে বলেছিলেন, ওহে আ’মাশ তুমি কি জান না, তোমার ভাইয়ের প্রয়োজনে বের হওয়া এক হজ্জের পর অপর হজ্জ আদায় করার সমান। তিনি কি তাকে উৎসাহমূলকভাবে এ কথাটি বলেছেন; নাকি আসলে এর সওয়াব এ রকম? একজন মানুষ যাকে আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসে তার সাথে কোন পদ্ধতিতে সম্পর্ক রক্ষা করবে, যাতে করে রহমানের ছায়ায় অবস্থান করতে পারে এবং আমাদের জন্য রহমানের মহব্বত অনিবার্য হয়?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসা ঈমানের সবচেয়ে মজবুত বন্ধন। এটি এমন এক মহান ভিত্তি যার উপর মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠিত। এর মাধ্যমে মানুষের মাঝে সম্প্রীতি ও মেলবন্ধন তৈরী হয়। ফলে তারা একে অপরকে ভালোবাসে, সাক্ষাত করে, উপদেশ দেয়, বংশ গড়ে, ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে। এর মাধ্যমে তারা মুসলিম ভ্রাতৃত্বের অর্থ পূর্ণ করে। এর মাধ্যমে তারা তাদের লেনদেন, সঙ্গিত্ব ও আচার-আচরণে ঈমানের স্বাদ অনুভব করে। ইমাম আহমাদ (১৮৫২৪) বারা বিন আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “ঈমানের সবচেয়ে মজবুত বন্ধন হচ্ছে আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহ্‌র জন্য ঘৃণা করা।” মুসনাদ গ্রন্থের তাহকীককারীগণ হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন। অনুরূপভাবে আলবানিও ‘সহিহুত তারগীব’ গ্রন্থে হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।

অতএব, আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসা নেকীর কাজ ও উত্তম আমল।

সহিহ বুখারী (১৩), সহিহ মুসলিম (৪৫) ও সুনানে নাসাঈ (৫০১৭)-তে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে (হাদিসটির ভাষ্য নাসাঈর) যে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “ঐ সত্তার কসম যার হাতে রয়েছে মুহাম্মদের প্রাণ, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজের জন্য যে কল্যাণটি ভালোবাসে তার (মুসলিম) ভাইয়ের জন্যেও সে কল্যাণটিকে ভালোবাসে”।

হাফেয ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন: কারমানী বলেন: ঈমানের মধ্যে এটাও পড়বে, নিজের জন্য যা অপছন্দ করে তার (মুসলিম) ভাইয়ের জন্যেও সেটাকে অপছন্দ করবে”।[ফাতহুল বারী (১/৫৮)]

যদি মুসলিমের জন্য কল্যাণকে ভাল না বাসলে ওয়াজিব ঈমান পূর্ণতা লাভ না করে তাহলে সরাসরি মুসলিমকে ভালোবাসা ও মুসলিমের সাথে মৈত্রী গড়া এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত ও অধিক মর্যাদার।

দুই:

ইবনে ইবনে আবুদ্দুনিয়া ‘কাযাউল হাওয়াইজ’ (পৃষ্ঠা-১০৩) গ্রন্থে ও ‘ইস্তিনাউল মারুফ’ (পৃষ্ঠা-১৬৩) গ্রন্থে ‘হাকাম বিন সিনান’ এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, মালিক বিন দিনার আমাদের নিকট হাদিস বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন, হাসান (রহঃ) মুহাম্মদ বিন নূহ ও হুমাইদ আত্‌-তাওয়িলকে তার ভাইয়ের এক প্রয়োজনে পাঠালেন এবং বললেন: তোমরা সাবেত আল-বুনানীর কাছে যাবে এবং তাকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাবে। তারা সাবেতের কাছে গেলে সে বলল: আমি ইতিকাফে আছি। তখন হুমাইদ হাসান (রহঃ) এর কাছে ফিরে এসে সাবেত যা বলেছে সেটা জানাল। তখন হাসান তাকে বললেন: তুমি তার কাছে ফিরে যাও এবং বল যে, ওহে উমাইশ! তুমি কি জান না যে, তোমার ভাইয়ের প্রয়োজনে গমন করা তোমার জন্য হজ্জের পর হজ্জ আদায় করার চেয়ে উত্তম?”

এই বর্ণনাটির সনদ দুর্বল। আল-হাকাম বিন সিনান হাদিসে দুর্বল। ইবনে মায়িন, নাসাঈ, ইবনে সাদ ও আবু দাউদ প্রমুখ আলেম তাকে দুর্বল বলেছেন। ইবনে হিব্বান বলেছেন: তিনি ছিকাহ (নির্ভরযোগ্য) বর্ণনাকারীগণ থেকে এককভাবে মাওযু হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাকে নিয়ে মশগুল হওয়া চলে না।[তাহযীবুত তাহযীব (২/৩৬৭) থেকে সমাপ্ত]

এই বর্ণনাটিকে সঠিক ধরা হলে এতে মুসলমানদের প্রয়োজন পূরণ করার প্রতি উৎসাহিত করার দলিল এতে রয়েছে।

এর চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ হচ্ছে ইবনে উমর (রাঃ) এর হাদিস: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমি আমার কোন এক ভাইয়ের প্রয়োজনে সাথে যাওয়া আমার কাছে আমার এই মসজিদে একমাস ইতিকাফ করার চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজনে সাথে গিয়ে তার প্রয়োজনটি সম্পন্ন করে দেয় আল্লাহ্‌ ঐ দিন তার পদযুগল অবিচল রাখবেন যেইদিন পাগুলো স্থির থাকবে না।[তাবারানী (১৩৬৪৬), ইবনে বিশরান-এর ‘আল-আমালি’ প্রমুখ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী ‘সিলসিলা সহিহা’ গ্রন্থে (৯০৬) হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।

ইবনুল মুবারক তাঁর ‘আল-যুহদ’ গ্রন্থে (৭৪৬) আবু জাফর থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: এক লোক হুসাইন বিন আলী (রাঃ) এর কাছে এসে কোন এক প্রয়োজনে তাঁর সহযোগিতা চাইল। লোকটি এসে তাঁকে ইতিকাফ অবস্থায় পেল। তখন তিনি বললেন: আমি ইতিকাফে না থাকলে তোমার সাথে যেতাম এবং তোমার প্রয়োজনটির সমাধান করে দিতাম। লোকটি বের হয়ে হাসান বিন আলী (রাঃ) এর কাছে গেল এবং তার কাছে নিজের কাজের কথা জানাল। তখন হাসান (রাঃ) তার সাথে তার প্রয়োজনে বের হলেন। তখন লোকটি বলল: আমি আমার প্রয়োজনে আপনার সাহায্য চাওয়াটা পছন্দ করছিলাম না। আমি হুসাইন (রাঃ) এর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন: আমি ইতিকাফে না থাকলে তোমার সাথে বের হতাম। তখন হাসান (রাঃ) বললেন: আল্লাহ্‌র জন্য আমার যে ভাই তার কোন প্রয়োজন সম্পন্ন করে দিতে পারা আমার কাছে একমাস ইতিকাফ করার চেয়ে উত্তম।”

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন:

“মুসলমানদের কাজে সহযোগিতা করা ইতিকাফ করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর উপকার নিজের গণ্ডি পেরিয়ে অন্যদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করে। ব্যক্তিগত উপকারের চেয়ে নৈর্ব্যক্তিক উপকার অধিক উত্তম। তবে ব্যক্তিগত আমলটা যদি ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ ও ফরয শ্রেণীর হয় তাহলে নয়।”।[মাজমুউ ফাতাওয়া ও রাসাঈলিল উছাইমীন (২০/১৮০)]

তিন:

যেই সাতজনকে আল্লাহ্‌ ছায়া দিবেন, যেইদিন আল্লাহ্‌র ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না তাদের মধ্যে রয়েছে: “এমন দুই ব্যক্তি যারা একে অপরকে আল্লাহ্‌র জন্য ভালবেসেছে; এর ভিত্তিতে একত্রিত হয়েছে ও বিচ্ছিন্ন নিয়েছে।”।[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম]

ইমাম আহমাদ (২২০০২) উবাদা বিন সামেত (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “আমার ভালোবাসা তাদের জন্য অবধারিত যারা আমার জন্য একে অপরকে ভালোবাসে, আমার ভালোবাসা তাদের জন্য অবধারিত যারা আমার জন্য একে অপরের সাথে সাক্ষাত করে, আমার ভালোবাসা তাদের জন্য অবধারিত যারা আমার জন্য একে অপরের পেছনে খরচ করে, আমার ভালোবাসা তাদের জন্য অবধারিত যারা আমার জন্য একে অপরের সাথে মুসাফাহা করে ও যোগাযোগ রাখে।”[আলবানী ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে (৪৩২১) হাদিসটিকে ‘সহিহ’ বলেছেন]

সত্য ভালোবাসা, আল্লাহ্‌র জন্য একনিষ্ঠতা, নেককাজে সহযোগিতা, একে অপরকে উপদেশ দেয়া, নেক কথা ও কাজে একত্রিত হওয়া এবং গুনাহর কথা ও কাজ বর্জন করার ক্ষেত্রে একত্রিত হওয়ার মাধ্যমে বান্দা এই উচ্চ মনযিলে ও উন্নত স্তরে পৌঁছুতে পারে। তাছাড়া নিজের জন্য যা পছন্দ করে মুসলিম ভাইয়ের জন্যেও তা পছন্দ করা, নিজের জন্য যা অপছন্দ করে মুসলিম ভাইয়ের জন্যেও তা অপছন্দ করা, মুসলিম ভাইয়ের খুশিতে খুশি হওয়া, দুঃখে দুঃখী হওয়া, নেকীর কাজে সহযোগিতা করা, দুনিয়া ও আখেরাতের যা কিছু তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তাতে তাকে সহযোগিতা করা, তার অনুপস্থিতিতে তার মর্যাদা রক্ষা করা, তাকে বা তার পরিবারের কোন সদস্যকে সহযোগিতা করা থেকে পিছপা না হওয়া, তার ভাল দিকগুলো উল্লেখ করা, তার দোষ ঢেকে রাখা, তার গিবত না করা, অপবাদ না দেয়া, তার সাথে ঔরশজাত ভাইয়ের মত আচরণ করা; বরং তার চেয়েও ভাল আচরণ করা।

মোটকথা: ব্যক্তি নিজে যে আচরণ পেতে পছন্দ করে মুসলিম ভাইয়ের সাথে কথা ও কাজে, সাক্ষাতে বা অন্তরালে সে রকম আচরন করা।

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব