আলহামদু লিল্লাহ।.
আপনি আপনার স্ত্রীর কথার উত্তর না দেয়া কিংবা আপনার স্ত্রীর সাথে রেগে, প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে কথা বলা তালাক নয়। আপনি তালাক নিয়ে যতই চিন্তা করুন না কেন, কিংবা মনে মনে কথা বলুন না কেন, কিংবা নিয়ত ও সংকল্প করুন না কেন– মুখে উচ্চারণ না করলে তালাক হবে না। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় আল্লাহ্ তাআলা আমার উম্মতের ওয়াসওয়াসা (শুচিবায়ু), মনে মনে কথা বলা ক্ষমা করে দিয়েছেন; যতক্ষণ না সে কর্ম করে কিংবা কথা বলে”।[সহিহ বুখারী (৬৬৬৪) ও সহিহ মুসলিম (১২৭)]
আলেমগণ এ হাদিসের উপরে এভাবে আমল করে আসছেন যে, কেউ যদি মনে মনে তালাক দেয় তাহলে কথা বলার আগ পর্যন্ত কিছুই হবে না।
বরং কোন কোন আলেমের মতে, শুচিবায়ুতে আক্রান্ত ব্যক্তি উচ্চারণ করলেও তালাক হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ব্যক্তি তালাক দেয়াকেই উদ্দেশ্য করে থাকে। শাইখ বিন উছাইমীন (রহঃ) বলেন: “শুচিবায়ুতে আক্রান্ত ব্যক্তি মুখে তালাক উচ্চারণ করলেও তালাক হবে না; যদি না সে ব্যক্তির তালাক দেয়া উদ্দেশ্য হয়। কেননা এ শব্দের উচ্চারণ শুচিবায়ুতে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে যায়। বরং সে ব্যক্তি জবরদস্তির শিকার– শব্দটি বের হওয়ার শক্তি প্রবল হওয়ার কারণে এবং প্রতিরোধ করার শক্তি দুর্বল হওয়ার কারণে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “জবরদস্তি অবস্থায় কোন তালাক নেই”। সুতরাং শান্ত অবস্থায় সে ব্যক্তির যদি তালাক দেয়ার প্রকৃত ইচ্ছা না থাকে তাহলে তার তালাক কার্যকর হবে না। এই যে বিষয়টি, অর্থাৎ ব্যক্তি তার ইচ্ছা ও ইখতিয়ারের বাইরে কিছু করতে বাধ্য হওয়া, সে কারণে তালাক পতিত হবে না।[সমাপ্ত, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা (৩/২৭৭) থেকে সংকলিত]
আমরা আপনাকে পরামর্শ দিব যে, আপনি শুচিবায়ুর কুমন্ত্রণাদাতার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না, তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন। সে আপনাকে দিয়ে যা করাতে চায় এর বিপরীতটা করবেন। কেননা শুচিবায়ুর কুমন্ত্রণাদাতা শয়তান, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে– ঈমানদারদেরকে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত করা। এর সর্বোত্তম প্রতিকার হচ্ছে– বেশি বেশি আল্লাহ্র যিকির করা, আউযুবিল্লাহ্ পড়া তথা বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং যেসব গুনাহ্ ও ইসলাম বিরোধী কাজের কারণে ইবলিস বনী আদমের উপর ভর করে সেগুলো থেকে দূরে থাকা। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও তাদের রবেরই উপর নির্ভর করে তাদের উপর তার (শয়তানের) কোন আধিপত্য নেই।”[সূরা নাহল, আয়াত: ৯৯]
ইবনে হাজার আল-হাইতামি তাঁর ‘আল-ফাতাওয়া আল-ফিকহিয়্যা আল-কুবরা’ গ্রন্থে (১/১৪৯) শুচিবায়ু (ওয়াসওয়াসা) এর প্রতিকার সম্পর্কে যা উল্লেখ করেছেন এখানে সেটা উল্লেখ করা যেতে পারে: “তাঁকে ওয়াসওয়াসা এর প্রতিকার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: এর ঔষধ একটাই সেটা হচ্ছে–শুচিবায়ুকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যাওয়া; এমনকি মনের মধ্যে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও। কেননা কেউ যদি সেটাকে ভ্রুক্ষেপ না করে তাহলে সেটা স্থির হবে না। কিছু সময় পর চলে যাবে; যেমনটি তাওফিকপ্রাপ্ত লোকেরা যাচাই করে পেয়েছেন। আর যে ব্যক্তি শুচিবায়ুকে পাত্তা দিবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করবে সে ব্যক্তির শুচিবায়ু বাড়তেই থাকবে; এক পর্যায়ে তাকে পাগলের কাতারে নিয়ে পৌঁছাবে কিংবা পাগলের চেয়েও নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছাবে। যেমনটি আমরা অনেক মানুষের মাঝে দেখেছি, যারা শুচিবায়ুতে আক্রান্ত হয়ে এতে কান দিয়েছেন এবং এর শয়তানের কথা শুনেছেন। যে শয়তানের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাবধান করে বলেছেন: “তোমরা পানি ব্যবহারে শুচিবায়ু (কুমন্ত্রণাদাতা শয়তান) থেকে বেঁচে থাক, যাকে ‘ওয়ালাহান’ ডাকা হয়। অহেতুক কাজ করানো ও বাড়াবাড়ির কুমন্ত্রণা দেয়ার কারণে তাকে এই নামে ডাকা হয়। যেমনটি আমি ‘শারহু মিশকাতিল আনওয়ার’ নামক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেছি। সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে আমি যে পরামর্শ দিয়েছি এর সমর্থনমূলক বর্ণনা এসেছে যে, যে ব্যক্তি শুচিবায়ুতে আক্রান্ত হয়েছে সে যেন ‘আউযুবিল্লাহ্’ পড়ে এবং (দুঃশ্চিন্তাকে বাড়তে না দিয়ে) থেমে যায়। আপনি এ প্রতিকারটি একটু ভেবে দেখুন; যে প্রতিকারের পরামর্শ দিয়েছেন এমন ব্যক্তি যিনি তাঁর উম্মতকে লক্ষ্য করে মনগড়া কোন কথা বলেন না। জেনে রাখুন, যে ব্যক্তি এই প্রতিকার অবলম্বন করা থেকে বঞ্চিত সে আসলেই বঞ্চিত। কেননা, সর্বসম্মতিক্রমে শুচিবায়ু শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। আর এই লানতপ্রাপ্ত শয়তানের সর্বাত্মক উদ্দেশ্য হচ্ছে – মুমিনকে বিভ্রান্তির ডোবাতে ফেলে দেয়া, পেরেশান করে রাখা, জীবনকে ভারাক্রান্ত করে তোলা, অন্তরকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিষাদময় করে ফেলা; যাতে এক পর্যায়ে তাকে ইসলাম থেকে এমনভাবে বের করে ফেলতে পারে যে সে টেরও পাবে না। (নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ কর”[সূরা ফাতির, আয়াত: ৬] হাদিসের অন্য এক বর্ণনায় শুচিবায়ুগ্রস্ত ব্যক্তির ব্যাপারে এসেছে, সে যেন বলে: “আমি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি”। নিঃসন্দেহে যে ব্যক্তি নবীদের আদর্শগুলো পর্যালোচনা করে দেখবে, বিশেষতঃ আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ; সে দেখতে পাবে যে, তাঁর আদর্শ ও শরিয়ত হচ্ছে- সহজ, সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ সাদা, পরিষ্কার ও এত সরল যে তাতে কোন বক্রতা নেই। “তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখেননি”[সূরা হাজ্জ, আয়াত: ৭৮] যে ব্যক্তি তা ভেবে দেখবে এবং এর প্রতি যথাযথভাবে ঈমান আনবে তার থেকে শুচিবায়ু রোগ ও এর শয়তানের কুমন্ত্রণাগ্রস্ত হওয়া দূর হয়ে যাবে। ইবনে সুন্নির গ্রন্থে আয়েশা (রাঃ) এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, “যে ব্যক্তি এই ওয়াসওয়াসা দ্বারা আক্রান্ত হবে সে যেন তিনবার বলে, আমরা আল্লাহ্র প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি। এতে করে, তার থেকে এটি দূর হয়ে যাবে”।
আল-ইয্য ইবনে আব্দুস সালাম ও অপরাপর আলেমগণও আমরা যা উল্লেখ করেছি এ রকম কথা উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন: ওয়াসওয়াসা বা শুচিবায়ু এর প্রতিষেধক হচ্ছে- ব্যক্তি এ বিশ্বাস করা যে, এটি শয়তানী কুমন্ত্রণা। ইবলিস এটি তার অন্তরে আরোপ করছে এবং তার সাথে লড়াই করছে। এতে করে সে ব্যক্তি জিহাদ করার সওয়াব পাবে। কেননা সে ব্যক্তি আল্লাহ্র শত্রুর সাথে লড়াই করছে। যদি কেউ এভাবে অনুভব করতে পারে তাহলে শয়তান তার থেকে পালিয়ে যাবে। সৃষ্টির সূচনাকালে মানুষকে যেভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে মানুষের উপর শয়তানকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এটা সে জাতীয় পরীক্ষা; যাতে করে এর মাধ্যমে আল্লাহ্ সত্যকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন এবং মিথ্যাকে বাতিল গণ্য করবেন, যদিও কাফেরেরা তা অপছন্দ করুক না কেন।
সহিহ মুসলিমে (২২০৩) উসমান বিন আবুল আস (রাঃ) এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: শয়তান আমার মাঝে এবং আমার নামায ও তেলাওয়াতের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি বললেন: এমন শয়তানকে ‘খিনযিব’ বলা হয়। এমনটি ঘটলে আপনি আউযুবিল্লাহ্ পড়ুন (অর্থাৎ শয়তান থেকে আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় চান) এবং বামদিকে তিনবার থুথু ফেলুন। তখন আমি এভাবে করলাম। ফলে আল্লাহ্ শয়তানকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন।
এর মাধ্যমে ইতিপূর্বে আমি যা উল্লেখ করেছি তার যথার্থতা জানা যায় যে, ওয়াসওয়াসা (শুচিবায়ু) শুধু এমন সব ব্যক্তির উপর ভর করে যার মাঝে অজ্ঞতা, নির্বুদ্ধিতা প্রভাব সৃষ্টি করে রেখেছে, তার নিজের কোন বিবেচনাশক্তি নেই। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি ইলম ও বিবেক-বুদ্ধির উপর অবিচল আছে সে ব্যক্তি কখনও অনুসরণের পথ ছেড়ে বিদাতের পথে হাঁটবে না। নিকৃষ্টতম বিদাতী হচ্ছে– শুচিবায়ুগ্রস্ত ব্যক্তিরা। এরপর ইমাম মালেক (রাঃ) তাঁর শিক্ষক রাবিআ – তাঁর যামানায় আহলে সুন্নাহ্র সর্বোচ্চ নেতা-সম্পর্কে বলেন: দুইটি বিষয়ে রাবিআ সকল মানুষের চেয়ে দ্রুতগতি ছিলেন: মলমুত্র থেকে পবিত্র হওয়া ও ওযু করার ক্ষেত্রে। এমনকি অন্য কেউ…। আমি বলব: অর্থাৎ অন্য কেউ না করলেও। (সম্ভবতঃ তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন: অন্য কেউ ওযু না করলেও)।
ইবনুল হুরমুয মলমুত্র থেকে পবিত্র হওয়া ও ওযু করার ক্ষেত্রে ধীরগতি ছিলেন। তিনি বলতেন: আমি পরীক্ষার শিকার, তোমরা আমাকে অনুসরণ করো না।
ইমাম নববী (রহঃ) জনৈক আলেম থেকে বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তি ওযু কিংবা নামাযে শুচিবায়ু রোগে আক্রান্ত তার জন্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা মুস্তাহাব। কেননা শয়তান যিকির শুনলে দূরে চলে যায়। আর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ হচ্ছে–প্রধান যিকির। শুচিবায়ু দূর করার উত্তম মহাষৌধ হচ্ছে– বেশি বেশি আল্লাহ্র যিকিরে মশগুল থাকা।[ইবনে হাজার হাইতামি এর বক্তব্য সমাপ্ত]
আমরা আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন যে শুচিবায়ুতে আপনি আক্রান্ত তা দূর করে দেন। আমাদের ও আপনার ঈমান, দ্বীনদারি ও তাকওয়া বাড়িয়ে দেন।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।