আলহামদু লিল্লাহ।.
الزكاة (যাকাত)-এর শাব্দিক অর্থ: বৃদ্ধি, লাভ, বরকত ও পবিত্র করা।
দেখুন, লিসানুল আরাব (১৪/৩৫৮) ও ফাতহুল কাদীর (২/৩৯৯)।
আর الصدقة (সদকা) শব্দটি الصِّدق (আস্-সিদক বা সত্য) থেকে গৃহীত। যেহেতু সদকা করা সদকাকারীর ঈমানের সত্যতার দলীল। দেখুন: ফাতহুল কাদীর (২/৩৯৯)
শরয়ি পারিভাষিক সংজ্ঞা:
যাকাত হচ্ছে: বিভিন্ন শ্রেণীর সম্পদে আল্লাহ যে যাকাত ফরয করেছেন শরীয়তের বর্ণনা অনুযায়ী সেগুলো এর হকদারদেরকে প্রদান করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত পালন।
আর সদকা হলো: সম্পদ ব্যয় করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা; যে ব্যয় শরিয়ত আবশ্যক করেনি। অনেক সময় ফরয যাকাতকেও সদকা বলা হয়।
যাকাত আর সদকার মাঝে পার্থক্য নিম্নরূপ:
১. ইসলাম নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের মধ্যে যাকাতকে আবশ্যক করেছে। যথা: স্বর্ণ, রৌপ্য, ফসল, ফল-ফলাদি, ব্যবসার পণ্য এবং গবাদিপশু তথা উট, গরু ও ছাগল-ভেড়া।
আর সদকা কোনো নির্দিষ্ট বস্তুতে আবশ্যক নয়। বরং এটার ক্ষেত্রে মানুষ নির্দিষ্ট না করে যা খুশি দান করতে পারে।
২. যাকাতের জন্য কিছু শর্ত আছে; যেমন বর্ষপূর্তি ও নেসাব এবং প্রদেয় যাকাতের সম্পদের নির্ধারিত পরিমাণ আছে।
কিন্তু সদকার জন্য কোনো শর্ত নেই। সদকা যে কোনো সময়ে যে কোনো পরিমাণে দেওয়া যায়।
৩. যাকাত: আল্লাহ তায়ালা নির্দিষ্ট কিছু খাতে যাকাত বণ্টন করা আবশ্যক করেছেন। এদের বাহিরে অন্যদেরকে দেওয়া জায়েয নয়। আল্লাহর বাণীতে যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে:“যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাতের কাজে নিয়োজিত কর্মী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের জন্য এবং ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে যারা আছে তারা ও মুসাফিরদের খাতে। এটি আল্লাহ কর্তৃক ফরযকৃত। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”[সূরা তাওবাহ ৯:৬০]
আর সদকা যাকাতের আয়াতভুক্ত ব্যক্তিদেরকে দেওয়া যাবে, আবার অন্যদেরকেও দেওয়া যাবে।
৪. কারো উপর যাকাত আবশ্যক থাকা অবস্থায় যদি সে মারা যায়, তাহলে তার সম্পদ থেকে যাকাত বের করা উত্তরাধিকারী ব্যক্তিদের উপর আবশ্যক। ওসীয়ত ও উত্তরাধিকারীদের অংশের উপর যাকাত অগ্রাধিকার পাবে।
আর সদকাতে এর কোনোটি আবশ্যক নয়।
৫. যে ব্যক্তি যাকাত দিবে না সে শাস্তি পাবে; যেমনটা সহীহ মুসলিমে (৯৮৭) বর্ণিত হাদীসে আছে। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “সোনা-রূপা সঞ্চয়কারী ব্যক্তি যদি এর যাকাত আদায় না করে তবে জাহান্নামের আগুনে সেগুলোকে উত্তপ্ত করা হবে। তারপর এগুলোকে পাতের ন্যায় বানিয়ে এর দ্বারা তার পার্শ্ব এবং কপালে দাগ দেয়া হবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা শেষ করা পর্যন্ত এমন এক দিনে যে দিনের পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এরপর তাকে তার পথ দেখানো হবে; জান্নাতের দিকে অথবা জাহান্নামের দিকে। কোন উটের মালিক যদি এর যাকাত আদায় না করে তবে তাকে এক প্রশস্ত সমতল প্রান্তরে অধোমুখী করে শায়িত করা হবে। এরপর সে উট পূর্বের চাইতেও অধিক মোটাতাজা অবস্থায় মালিকের নিকট উপস্থিত হবে এবং তাকে পদদলিত করতে থাকবে। এদের শেষটি চলে গেলে আবার প্রথমটি ফিরে আসবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা করা পর্যন্ত এমন এক দিনে যে দিনের পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছর। এরপর তাকে তার পথ দেখানো হবে; জান্নাতের দিকে অথবা জাহান্নামের দিকে। বকরীর কোন মালিক যদি এর যাকাত আদায় না করে তবে তাকে প্রশস্ত সমতল প্রান্তরে শায়িত করা হবে। এরপর সে বকরী পূর্বের চেয়েও অধিক মোটাতাজা অবস্থায় মালিকের নিকট উপস্থিত হবে এবং স্বীয় খুর দ্বারা তাকে দলিত করবে ও শিং দ্বারা আঘাত করতে থাকবে। এদের মধ্যে সেদিন কোনটাই শিংবিহীন এবং উল্টো শিং বিশিষ্ট থাকবে না। যখন এদের শেষটি চলে যাবে তখন আবার প্রথমটি ফিরে আসবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা শেষ করা পর্যন্ত এমন এক দিনে যে দিনের পরিমাণ হবে তোমাদের হিসাব অনুসারে পঞ্চাশ হাজার বছর। এরপর তাকে তার রাস্তা দেখানো হবে, জান্নাতের দিকে অথবা জাহান্নামের দিকে। ... ”
আর সদকা ত্যাগকারী ব্যক্তির শাস্তি হবে না।
৬. যাকাত: চার মাযহাবের ঐকমত্যের ভিত্তিতে যাকাত মূল ও শাখা আত্মীয়দের কাউকে দেওয়া জায়েয নয়। মূল হল মা-বাবা, দাদা-নানাগণ এবং দাদী-নানীগণ। আর শাখা হল সন্তান-সন্ততি।
আর সদকা: মূল ও শাখা উভয় শ্রেণীর আত্মীয়কে দেওয়া জায়েয।
৭. যাকাত: ধনী ও উপার্জনে সক্ষম সবল ব্যক্তিকে দেওয়া জায়েয নয়।
উবাইদুল্লাহ ইবনে আদী বর্ণনা করেন, আমাকে দুই ব্যক্তি এই খবর দিয়েছেন যে, তারা বিদায় হজ্জের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেছিলেন। তখন তিনি যাকাতের মাল বণ্টন করছিলেন। সেই ব্যক্তিদ্বয় তাঁর কাছে কিছু যাকাতের মাল চাইলেন। তখন তিনি তাদের দিকে উপরে ও নীচে চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন। তিনি দেখলেন যে, আমরা শক্তিশালী। তখন তিনি বললেন: “তোমরা যদি চাও তবে আমি তোমাদের দু’জনকে দিব। (কিন্তু জেনে রাখো!) এই সম্পদে ধনী উপার্জনে সক্ষম সবল ব্যক্তির কোনো প্রাপ্য নেই।”[হাদীসটি আবু দাউদ (১৬৩৩) ও নাসাঈ (২৫৯৮) বর্ণনা করেন। ইমাম আহমদ ও অন্যান্যরা এটাকে সহীহ বলেছেন]
দেখুন, তালখীসুল হাবীর (৩/১০৮)।
আর সদকা: ধনী ও উপার্জনে সক্ষম সবল ব্যক্তিকে দেওয়া জায়েয।
৮. যাকাতের ক্ষেত্রে উত্তম হল স্থানীয় ধনীদের থেকে যাকাত আদায় করে স্থানীয় দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করা। বরং অনেক আলেম মনে করেন বিশেষ কোন কল্যাণ ছাড়া অন্য শহরে যাকাত স্থানান্তর করা জায়েয নেই।
আর সদকা: কাছের-দূরের সবার মাঝে বণ্টন করা যায়।
৯. যাকাত কাফের ও মুশরিকদেরকে দেওয়া জায়েয নেই।
আর সদকা কাফের ও মুশরিকদেরকে দেওয়া জায়েয।
যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “আর খাদ্যের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীদেরকে খাবার দান করে।”[সূরা ইনসান: ৮] কুরতুবী বলেন: মুসলিম দেশে বন্দি হিসেবে থাকে কেবল মুশরিক।
১০. একজন মুসলিমের জন্য নিজের স্ত্রীকে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই। ইবনুল মুনযির এই বিষয়ে ফকীহদের ইজমা (ঐকমত্য) বর্ণনা করেছেন।
আর সদকা স্ত্রীকে দেওয়া যেতে পারে।
এগুলো যাকাত ও সদকার মাঝে বিদ্যমান কিছু পার্থক্য।
সকল পুণ্যের কাজকে সদকা বলা হয়। বুখারী রাহিমাহুল্লাহ তার সহীহ বইয়ে বলেন: “অধ্যায়: প্রত্যেকটি সৎকাজই সদকা।” তারপর তিনি তাঁর সনদে জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “প্রতিটি সৎকাজই সদকা।”
ইবনে বাত্তাল বলেন: “হাদীসটি প্রমাণ করে যে, মানুষ প্রত্যেক যে ভাল কাজ করে বা যে ভাল কথা বলে এর বদলে তার জন্য একটি সদকা লেখা হয়।”
নববী বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “প্রতিটি সৎকাজ-ই সদকা” অর্থাৎ নেকীর দিক সদকার অধিভুক্ত।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।