রবিবার 21 জুমাদাল ছানী 1446 - 22 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

কবরের জায়েয পরিচর্যা ও হারাম পরিচর্যা

প্রশ্ন

আমার এক আত্মীয় তার মায়ের কবরের পরিচর্যা করার জন্য অন্য ভাইদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা চায়। মায়ের কবরটা ধুলোয় ধূসরিত হয়ে গিয়েছে। চারদিকে ছোট ছোট গাছ জন্মেছে। কবরটি লোহার খাঁচা দিয়ে ঘেরাও করা এবং সাদা প্রলেপ দিয়ে রং করা। এর উপর মৃত ব্যক্তির নাম ও জন্ম তারিখ ইত্যাদি লেখা আছে। এই কবর দেখাশোনা ও পরিচর্যায় টাকা দেওয়া কি তাদের জন্য জায়েয হবে?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

ইসলামী শরীয়তে কবরের সম্মান-মর্যাদা ব্যাপক। কবরকে অবহেলা করা এবং কবরকে আক্রান্ত করা কারো জন্য জায়েয নেই। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের উপর বসাকে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের কারো জন্য কবরের উপর বসার চেয়ে অঙ্গারের উপর বসা এবং এই অঙ্গারে (পরনের) কাপড় পুড়ে চামড়ায় পৌঁছে যাওয়া তার জন্য উত্তম হবে।”[সহিহ মুসলিম (৯৭১)]

এই নিষেধাজ্ঞার দাবি হলো মুসলিমরা কবরকে ততটুকু পরিচর্যা করবে যতটুকুর মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির সম্মান রক্ষিত হয় এবং মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে। তার কবরকে যেন কোনোভাবে ক্ষতি করা ও অমর্যাদা করা না হয়। এটি নিম্নোক্ত পন্থাসমূহে বাস্তবায়িত হবে:

১- কবরের মাথার কাছে একটি চিহ্ন রাখা, যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান সাহাবী উসমান ইবনে মাযউনের কবরে দিয়েছিলেন। আবু দাউদ (৩২০৬) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘(কবরস্থ) ব্যক্তির মাথার কাছে পাথর অথবা কাঠ অথবা এমন কিছু চিহ্ন হিসেবে প্রদান করা সুন্নত। এমনটি বলেছেন শাফেয়ী, গ্রন্থপ্রণেতা (অর্থাৎ শীরাযী) এবং মাযহাবের সকল আলেম।’[সমাপ্ত][আল-মাজমূ’ (৫/২৬৫)] ।

২- কেবল এক বিঘত পরিমাণ কবর উঁচু করা; এর চেয়ে বেশি নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর এমনটিই ছিল। ইবনে কুদামা রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “কবর যমীন থেকে এক বিঘত উঁচু হবে, যাতে বোঝা যায় এটি কবর। তখন মানুষজন সতর্ক থাকবে এবং কবরবাসীর জন্য দোয়া করবে। … সামান্য পরিমাণ ছাড়া কবর উঁচু করা মুস্তাহাব নয়।”[আল-মুগনী (২/১৯০)] আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা (১১/৩৪২) এ প্রসঙ্গে ফকীহদের ঐকমত্য উল্লেখ করেছে।

৩- গোটা কবরস্থানকে একটি প্রাচীর দিয়ে ঘের দেয়া বাঞ্চনীয়; যা কবরস্থানকে সংরক্ষিত রাখবে এবং আশেপাশের জায়গা থেকে আলাদা রাখবে। তাছাড়া এটি ছোট বাচ্চাদের দুষ্টুমি ও যে সব পশু কবরের অবমাননা করে সেগুলো থেকেও কবরকে রক্ষা করবে।[দেখুন: ফাতাওয়াশ শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম (৩/২১১-২১২), সুহাইবানীর ‘আহকামুল মাকাবির’ (৪৫৭)]

দুই:

আত্মীয়-স্বজনের কবর রক্ষণাবেক্ষণে মানুষজন যে সমস্ত হারাম পদ্ধতি অবলম্বন করে, সেগুলো নানাবিধ। পরিবেশভেদে এটি বিভিন্ন হয়ে থাকে। তন্মধ্যে রয়েছে:

১- কবরকে যমীনের চেয়ে এক বিঘতের বেশি উঁচু করা। দলীল হলো আলী ইবনে আবী ত্বালিবকে লক্ষ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “কোনো প্রতিকৃতিকে না ভেঙে রেখে দিবে না এবং কোন উঁচু কবরকে সমান না করে ছেড়ে দিবে না।”[হাদীসটি মুসলিম (৯৬৯) বর্ণনা করেন]

২- কবরের উপর কিছু নির্মাণ করা। সেটি যা কিছুই নির্মাণ করা হোক না কেন। উঁচু হোক কিংবা নিচু। গম্বুজ কিংবা খানকা কিংবা অন্য যে কোনো কিছুর আকৃতিতে। আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা (৩২/২৫০) গ্রন্থে এসেছে: “মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলীরা মনে করেন যে কবরের উপর কোনো কিছু নির্মাণ করা মৌলিকভাবে মাকরূহ। এর কারণ জাবের (রাঃ) এর হাদীস: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরকে চুনকাম করতে এবং কবরের উপর কিছু নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন। সেটি গম্বুজ কিংবা ঘর কিংবা এই দুটি ছাড়া ভিন্ন কিছু হোক না কেন। হানাফীরা বলেন: সৌন্দর্যের জন্য হলে হারাম হবে। আর দাফন করার পর কবরকে মজবুত করার জন্য করা হলে মাকরূহ হবে।”[সমাপ্ত]

৩- নানাপ্রকার সৌন্দর্যবর্ধক রং কিংবা চুন দিয়ে প্রলেপ দেওয়া। আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা (৩২/২৫০) গ্রন্থে এসেছে: “কবর চুনকাম মাকরূহ হওয়ার বিষয়টিতে ফকীহরা একমত। কেননা জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর চুনকাম করতে, কবরের উপর বসতে এবং কবরের উপর কিছু নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন। মাহাল্লী বলেন: চুনকাম হলো চুন-সুরকি দিয়ে সাদা করা। উমাইরা বলেন: নিষেধাজ্ঞার হিকমত হলো: কবরের সৌন্দর্যবর্ধন। তিনি আরও বলেন: এটি শরয়ি অনুমোদনহীন খাতে অর্থ নষ্ট করা।”[সমাপ্ত]

৪- কবরকে প্রাচীর বা বেড়া দিয়ে ঘের দেয়া (এটি কবরস্থানকে অবাঞ্চিত কোন কিছু ও অবমাননা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রাচীর নয়)। কেননা এতে কবরের উপর হারাম কিছু নির্মাণ করার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। শাইখ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “কবরকে এ ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ আকৃতির বেড়া দিয়ে ঘেরাও করা এক প্রকার মন্দ কাজ যা মানুষকে আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্যতার দিকে এবং কবরবাসীকে এমন সম্মান করার দিকে ধাবিত করে যা শরীয়তে জায়েয নেই। এটি দৃশ্যমান ও জ্ঞাত বিষয়।”[দেখুন: তাহযীরুস সাজিদ: (পৃ. ৮৯)]

৫- কবরের উপর স্তুতিমূলক বা শোক কথা বা অনুরূপ কিছু লেখা; যা মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করার অন্তর্ভুক্ত কিংবা এটি মৃত ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শনে সীমালঙ্ঘনের দরজা খুলে দেয়।

৬- কবরের উপর বৃক্ষ রোপণ করা এবং সবুজ উদ্ভিদ লাগানো। এটি কবরের ক্ষেত্রে মুসলিমদের রীতি নয়। বরং এটি খ্রিষ্টানদের রীতি। ইতঃপূর্বে (14370), (41643) ও (48958) নং প্রশ্নের উত্তরে এর বিবরণ প্রদান করা হয়েছে।

তিন:

উপর্যুক্ত বর্ণনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, কবরের শরিয়ত অনুমোদিত রক্ষণাবেক্ষণে বলতে গেলে কোনো টাকা-পয়সাই প্রয়োজন হয় না; যতক্ষণ কবর অবমাননা ও ময়লা আবর্জনা থেকে সুরক্ষিত থাকে। পক্ষান্তরে, কবর রঙিন করা ও কবরের উপর কিছু নির্মাণ করা কবরের হারাম পরিচর্যার অন্তর্ভুক্ত। একইভাবে কবরকে লোহার শিক দিয়ে ঘিরে ফেলাও হারাম। কবরের উপর ধুলো থাকা কবরের জন্য কোনো লাঞ্ছনার বিষয় নয়। বরং কবরগুলো সবসময় এমনই; কবরবাসীকে ধুলোর নিচে দাফন করা হয়।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব