শুক্রবার 10 শাওয়াল 1445 - 19 এপ্রিল 2024
বাংলা

ঋণ ও ক্রয়বিক্রয়ের মধ্যে পার্থক্য

প্রশ্ন

আমি জনৈক বোনের কাছ থেকে কর্জে হাসানা হিসেবে কিছু স্বর্ণ নিয়েছি এবং অঙ্গীকার করেছি যে, নির্দিষ্ট সময়ের পর আমি সমান ওজনের স্বর্ণ তাকে ফেরত দিব। দয়া করে আপনারা আমাকে জানাবে, এটা কি সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে? জাযাকুমুল্লাহু খাইরা।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

সুদের বহু জাত ও প্রকার বর্ণনা করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে বহু টেক্সট উদ্ধৃত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উবাদা বিন সামেত (রাঃ) এর হাদিসটি। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, লবণের বিনিময়ে লবণ সমান সমান ও হাতে হাতে (বিক্রি কর)। আর যদি প্রকারগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয় তাহলে তোমরা হাতে হাতে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বিক্রি করতে পার।[সহিহ মুসলিম (১৫৮৭)]

দুই:

ঋণ দেয়া জায়েয এবং মুসলমানদের ইজমার ভিত্তিতে এটি একটি মুস্তাহাব আমল; চাই সেটা সুদ সংবেদনশীল সম্পদগুলোর মাধ্যমে হোক কিংবা অন্য সম্পদগুলোর মাধ্যমে হোক।

ইবনুল কাত্তান ‘আল-ইক্বনা ফি মাসায়িলিল ইজমা’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-১৯৭) বলেন: “আলেমদের মধ্য থেকে প্রত্যেক যার কাছ থেকে ইলম মুখস্ত করা হত তারা এই মর্মে ইজমা (মতৈক্য) করেছেন যে, দিনার, দিরহাম, গম, যম, খেজুর ও স্বর্ণ এবং প্রত্যেক যে খাদ্যের সদৃশ পাওয়া যায় সেটা ওজনযোগ্য হোক কিংবা মাপনযোগ্য; সেটা ঋণ নেয়া জায়েয।[সমাপ্ত]

দুই:

প্রশ্নকারীর কাছে স্বর্ণ দিয়ে স্বর্ণ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি জাগার ভিত্তি হলো: যেহেতু সেটি সুদশ্রেণীয় সম্পদের একটির সাথে অপরটির বিনিময়; কিন্তু হস্তান্তর বিলম্বে। এর জবাব নিম্নোক্ত পয়েন্টে:

১। শরিয়তের দলিল ‘হাতে হাতে’ উল্লেখ করে ‘নগদে হস্তান্তর’ হওয়ার যে শর্তটি আরোপ করা হয়েছে সেটি ক্রয়বিক্রয়ের ক্ষেত্রে। যেহেতু হাদিসে বলা হয়েছে: যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বেচাকেনা করতে পার এ সংক্রান্ত দলিলগুলোতে ঋণ এর কথা উল্লেখ নেই।

২। কর্জ দেয়াটা হলো একটি দান, সহমর্মিতা ও দয়া; বেচাকেনা এমনটি নয়। বেচাকেনা হলো: মূল সম্পদের বিনিময়; সেটা আর ফেরত না দিয়ে।

ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) ‘ইলামুল মুওয়াক্কিঈন আন রাব্বিল আলামীন’ গ্রন্থে (২/১১) বলেন: পক্ষান্তরে কর্জ: যিনি বলেছেন যে, এটি কিয়াসের বিপরীত; তার সংশয়টি হলো: এটি সুদশ্রেণীয় সম্পদকে সুদশ্রেণীয় সম্পদ দিয়ে বিনিময় করা; কিন্তু হস্তান্তর বিলম্বে করা। এটি ভুল। কারণ কর্জ হলো উপযোগ দান করা শ্রেণীয়; যেমন আরিয়া। এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটাকে منيحة (মানীহা- অনুগ্রহ হিসেবে ধার দেয়া জিনিস) বলেছেন। তিনি বলেন: أو منيحة ذهب أو منيحة ورق (কিংবা স্বর্ণের মানিহা বা রৌপ্যের মানিহা)। এটি সহমর্মিতাশ্রেণীয়; বিনিময়শ্রেণীয় নয়। কারণ বিনিময়ের ক্ষেত্রে প্রত্যেকে তার মূল সম্পদটা এমনভাবে প্রদান করে যে, সেটা আর তার কাছে ফিরে আসে না। আর কর্জ হচ্ছে আরিয়া ও মানিহা শ্রেণীয়...। এটি কোনভাবে বেচাকেনা শ্রেণীয় নয়; বরং সহমর্মিতা, দান ও সদকাশ্রেণীয়।[সমাপ্ত]

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) ‘আল-শারহুল মুমতি’ গ্রন্থে (৯/৯৩) বলেন: এটি সহমর্মী চুক্তি; এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্জগ্রহীতাকে কর্জ দেয়া জিনিসটির মালিক বানিয়ে দেয়া...। অতএব, সেটি একটি সহমর্মিতামূলক চুক্তি; এর দ্বারা বিনিময় ও লাভ উদ্দেশ্য নয়; বরং এটি নিতান্ত অনুগ্রহ। এ কারণে কর্জ দেয়া জায়েয; যদিও কর্জের রূপটি সুদের রূপের মত। কেননা কেউ যদি এক দিরহাম দিয়ে এক দিরহামকেই বিক্রি করে; কিন্তু লেনদেন নগদ নগদ না হয় তাহলে সেটাই সুদ। আর যদি কেউ কাউকে এক দিরহাম ঋণ দেয় এবং একমাস পর (ঋণগ্রহীতা) সেটি তাকে ফেরত দেয়; তদুপরি সেটা সুদ হবে না। যদিও সেটি সুদেরই রূপ। এতে নিয়ত ছাড়া আর কোন পার্থক্য নেই। যখন ঋণ দেয়ার মাধ্যমে উদ্দেশ্য হলো সহমর্মিতা ও অনুকম্পা করা তখন সেটি জায়েয।

৩। এটি সুবিদিত যে, সেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানা থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ একে অপরের কাছ থেকে নগদ অর্থ, দিরহাম, দিনার, সব ধরণের সম্পদ ও সব ধরণের জিনিস যেমন- যব, উট; ধার নেয় এবং সদৃশ জিনিস ফেরত দেয়। কেউ বলে না যে, এটি সুদ। আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ইহুদী থেকে বাকীতে খাবার কিনলেন এবং তার কাছে নিজের লোহার বর্মটি বন্ধক রাখলেন।[সহিহ বুখারী (২২৫১) ও সহিহ মুসলিম (১৬০৩)] যব সুদশ্রেণীয় পণ্য।

আমরা যদি কর্জ নেয়ার ক্ষেত্রে নগদ প্রদানকে আবশ্যক করতাম তাহলে সকল সুদশ্রেণীয় সামগ্রীতে ঋণের অস্তিত্ব থাকত না।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব