শুক্রবার 19 রমজান 1445 - 29 মার্চ 2024
বাংলা

হামদ ও শুকরের মধ্যে পার্থক্য

প্রশ্ন

হামদ ও শুকরের মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে?  

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

হামদ (প্রশংসা) ও শুকর (কৃতজ্ঞতা) এর মধ্যে কি পার্থক্য আছে— এ নিয়ে আলেমগণ দ্বিমত করেছেন:

প্রথম অভিমত: হামদ ও শুকর একই অর্থবোধক; এ দুটোর মাঝে কোন পার্থক্য নাই। ইবনে জারীর আত্‌তাবারী ও অন্যান্য আলেম এ অভিমতটিকে পছন্দ করেছেন।

তাবারী  (রহঃ) বলেন: " الْحَمْدُ لِلَّهِএর অর্থ হচ্ছে— শুকরিয়া একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্‌র জন্য; তিনি ব্যতীত আর যা কিছুর উপাসনা করা হয় তাদের জন্য নয়..."। এরপর তিনি বলেন: "আরবদের ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিদের মাঝে الحمد لله شكرًا কথাটির শুদ্ধতার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। যেহেতু এ কথাটি তাদের সকলের কাছে শুদ্ধ; এতে করে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কখনও شكر (কৃতজ্ঞতার)-এর স্থলে الحمد لله (প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য) বলা হয়। আবার কখনও الحمد (প্রশংসা)-এর স্থলে الشكر (কৃতজ্ঞতা) ব্যবহার করা হয়। কারণ যদি সেটা শুদ্ধ না হত তাহলে الحمد لله شكرًا বলা বৈধ হত না।"[তাফসিরে তাবারী (১/১৩৮) থেকে সমাপ্ত]

দ্বিতীয় অভিমত: হামদ ও শুকর একই অর্থবোধক নয়। বরং এ দুটোর মাঝে পার্থক্য আছে। এ পার্থক্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:

১। হামদ (প্রশংসা) মুখের সাথে খাস। পক্ষান্তরে শুকর (কৃতজ্ঞতা) এমন নয়। বরং শুকর মুখ, অন্তর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে হতে পারে।

২। হামদ (প্রশংসা) কোন নেয়ামত বা অনুগ্রহের বিপরীতে যেমন হতে পারে; তেমনি কোন কোন অনুগ্রহ ছাড়াও হতে পারে। পক্ষান্তরে, শুকর (কৃতজ্ঞতা) কেবল কোন অনুগ্রহের বিপরীতেই হয়ে থাকে।

ইবনে কাছির (রহঃ) ইবনে জারীর তাবারীর পূর্বোক্ত বক্তব্যকে খণ্ডন করতে গিয়ে বলেন (১/৩২): যেহেতু পরবর্তী আলেমদের অনেকের নিকট মশহুর হল: হামদ (প্রশংসা) হচ্ছে মৌখিকভাবে প্রশংসিতের আত্মগত গুণ ও পরার্থমুখী গুণের স্তুতি করা। আর শুকর (কৃতজ্ঞতা) কেবল পরার্থমুখী গুণের ক্ষেত্রে হয় এবং যা সম্পাদিত হয় মন, মুখ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে। কবি বলেন:

أفادتكم النعماءُ مني ثلاثةً ... يدي ولساني والضميرَ المُحَجَّبا

(আমার পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে আমার হাত, আমার মুখ ও লুক্কায়িত অন্তর।)

কিন্তু আলেমগণ এ নিয়েও দ্বিমত করেছেন যে, কোনটি অধিক আম (সার্বিক); হামদ নাকি শুকর? তবে, সূক্ষ্ম নিরীক্ষণ হল: এ দুটোর মাঝে আম (সার্বিক) ও খাস (বিশেষ)-এর সম্পর্কদ্বয় বিদ্যমান। যে যে ক্ষেত্রে শব্দদ্বয় ব্যবহৃত হয় সে দিক থেকে হামদ শুকরের চেয়ে আম। যেহেতু হামদ আত্মগত গুণ ও পরার্থমুখী গুণ উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যেমন বলা হয়: حمدته لفروسيته (আমি তার অশ্ব চালনার প্রশংসা করলাম)। আবার বলা হয়: حمدته لكرمه (আমি তার বদান্যতার প্রশংসা করলাম)। অন্য বিবেচনা থেকে হামদ শুকর-এর চেয়ে খাস। যেহেতু হামদ কেবল কথার মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। কিন্তু যে যে মাধ্যম দ্বারা হামদ ও শুকর সম্পাদিত হতে পারে সে বিবেচনা থেকে শুকর হামদের চেয়ে আম। যেহেতু শুকর কথা, কাজ ও নিয়তের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়; যেমনটি পূর্বেও বলা হয়েছে। আবার যেহেতু শুকর কেবল পরার্থমুখী গুণের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় তাই এ দিক থেকে শুকর হামদের চেয়ে খাস। যেমন এভাবে বলা যায় না যে, شكرته لفروسيته (আমি তার অশ্বচালনার জন্য শুকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) করলাম)। তবে, আপনি বলতে পারেন: شكرته على كرمه وإحسانه إليّ (আমার প্রতি তার বদান্যতা ও অনুগ্রহের জন্য আমি তাকে শুকরিয়া জানালাম)। পরবর্তী কোন কোন আলেম যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এই বক্তব্য সে সিদ্ধান্তের সারকথা।[সমাপ্ত]

এর উপর ভিত্তি করে আবু হিলাল আল-আসকারি এ দুটোর মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। তিনি বলেন: "হামদ ও শুকরের মধ্যে পার্থক্য: হামদ হচ্ছে মুখে ভাল কিছুর স্তুতি করা; সেটা কোন উত্তম গুণের সাথে সম্পৃক্ত হোক, যেমন- ইলম কিংবা কোন অনুগ্রহের সাথে সম্পৃক্ত হোক, যেমন- সদাচরণ।

আর শুকর: এমন কর্ম যা অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহের প্রেক্ষিতে উৎসারিত হয়; চাই সেটা হোক মৌখিক স্তুতি, কিংবা বিশ্বাস, কিংবা অন্তরের ভালবাসা, কিংবা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোন কর্ম বা সেবা।

জনৈক কবি এ পার্থক্যগুলোকে তার কথায় এভাবে লিখেছেন..[এরপর তিনি পূর্বোক্ত পংক্তিটি উল্লেখ করেছেন]।

সুতরাং হামদ হচ্ছে আম (সার্বিক); যেহেতু হামদ অনুকম্পা ও অন্য বিষয়কেও অন্তর্ভুক্ত করে। আবার মাধ্যমের বিবেচনা থেকে খাস (বিশেষ)। যেহেতু তা কেবল মৌখিকভাবেই সম্পাদিত হয়। আর শুকর এর বিপরীত। যেহেতু শুকরের সংশ্লিষ্টতা কেবল অনুগ্রহের সাথে, তবে শুকরের মাধ্যম কথা ও অন্য কিছুও হতে পারে। তাই এ দুটোর মাঝে সম্পর্ক হচ্ছে এক দিক থেকে আম (সার্বিক); অন্যদিক থেকে খাস (বিশেষ)। কোন ভাল গুণের মুখ দিয়ে স্তুতি করলে সেক্ষেত্রে এ দুটোর মিলন ঘটে। আবার বিচ্ছেদ ঘটে এমন ক্ষেত্রে; যেমন কারো 'ইলম' থাকার স্তুতির ক্ষেত্রে কেবল 'হামদ' এবং কোন ভাল গুণের কারণে কাউকে ভালবাসার ক্ষেত্রে কেবল 'শুকর'-এর ব্যবহার।[আল-ফুরুক আল-লুগাওয়িয়্যাহ (২০/২২০)]

ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) 'মাদারিজুস সালেকীন' গ্রন্থে (২/২৪৬) বলেন:

"শুকর; এর প্রকার ও কারণগুলো বিবেচনার দিক থেকে আম। আর যে বিষয়গুলোর সাথে সম্পৃক্ত সে বিবেচনা থেকে খাস। অন্যদিকে হামদ এর সম্পৃক্ত বিষয়গুলোর বিবেচনা থেকে আম এবং কারণগুলোর বিবেচনা থেকে খাস।

এ কথার অর্থ হচ্ছে: শুকর অন্তর দিয়ে সম্পাদিত হয়; অন্তর বিনয়ী হওয়া ও নত হওয়ার মাধ্যমে, মুখ দিয়ে সম্পাদিত হয়; মৌখিক স্তুতি ও স্বীকৃতির মাধ্যমে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়; অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অনুগত ও নত হওয়ার মাধ্যমে। আর শুকরের সাথে সম্পৃক্ত বিষয় হচ্ছে অনুগ্রহ; আত্মগত গুণাবলী নয়। তাই এভাবে বলা যায় না: شكرنا الله على حياته وسمعه وبصره وعلمه (আল্লাহ্‌র জীবন, তাঁর শ্রবণশক্তি, তাঁর দৃষ্টিশক্তি ও তাঁর জ্ঞানের কারণে আমরা তাঁর শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা জানালাম)। কিন্তু তিনি তাঁর এ সকল গুণের জন্যেও হামদপ্রাপ্য বা প্রশংসিত; যেমনিভাবে তিনি তার অনুগ্রহ ও ন্যায্যতার জন্যেও হামদপ্রাপ্য বা প্রশংসিত।

আর শুকর হয় অনুগ্রহ ও দয়ার ক্ষেত্রে। তাই যা কিছুর সাথে শুকর সম্পৃক্ত ঐ সব বিষয়ের সাথে হামদও সম্পৃক্ত; কিন্তু বিপরীতটা নয়। আর যে যে মাধ্যম দিয়ে হামদ প্রকাশ করা যায় সে সে মাধ্যম দিয়ে শুকরও প্রকাশ করা যায়; কিন্তু বিপরীতটা নয়। যেহেতু শুকর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমেও করা যায়; কিন্তু হামদ কেবল অন্তর ও কথা দ্বারা করা যায়।[সমাপ্ত]

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব