বুধবার 17 জুমাদাল ছানী 1446 - 18 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

নিমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার হুকুম ও শর্তাবলি

প্রশ্ন

মাঝে মাঝে আমি ছোটখাট কিংবা বড় উপলক্ষে দাওয়াত পাই ..। এ সমস্ত দাওয়াতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গীবত চর্চা, খোঁচা মারা, পারস্পরিক বড়াই করা, পোশাক নিয়ে প্রতিযোগিতা করা, (আমার মতো) যারা সাধারণ পোশাক পরে তাদের নিয়ে উপহাস করা এবং চোগলখুরী ঘটে থাকে। সেক্ষেত্রে করণীয় কী? তাছাড়া আমার ঘরোয়া কাজকর্ম থাকে (আমি কোনো গৃহকর্মী আনতে চাই না। এ দাওয়াতগুলোতে যারা আসে তাদের অধিকাংশের গৃহকর্মী থাকে। তাই তারা অবসর সময় পায়)। এদিকে আমার স্বামী ও ঘরের মানুষজন আমার মুখাপেক্ষী। বাড়িতে আমার কাটানো প্রতিটি মিনিটের প্রভাব আছে, ইন শা আল্লাহ। এটিই আমার প্রথম দায়িত্ব। তাছাড়া আমি কুরআন কিংবা উপকারী বই পড়ার জন্য অতিরিক্ত সময় চাই। আমি এমন কোনো তুচ্ছ জনসমাগমে হাজির হতে চাই না যেগুলোর উপকারিতার চেয়ে অপকারিতা বেশি; যদিওবা এর কিছু উপকারিতা থেকে থাকে। আমাকে উপদেশ দিন, আমার করণীয় উপযুক্ত কাজ কী? আমার জন্য যদি হাজির না হওয়াটাই সঠিক হয়, তাহলে না যাওয়ার উপযুক্ত কৈফিয়ত কী হতে পারে? যে মহিলা আমাকে দাওয়াত দিয়েছে, সে যদি আমার প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ধারণ করে, আমাকে বিপদে পড়তে দেখলে যদি সে খুশি হয় এবং আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলে, তাহলেও কি তার দাওয়াতে উপস্থিত হওয়া আমার উপর আবশ্যক থাকবে?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

সহীহ বুখারী (১১৬৪) ও মুসলিমে (৪০২২) বর্ণিত আছে, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: “মুসলিমের উপর মুসলিমের অধিকার পাঁচটি: সালামের জবাব দেওয়া, অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, জানাযায় উপস্থিত হওয়া, দাওয়াতে সাড়া দেওয়া এবং হাঁচির জবাব দেওয়া।”

যে প্রকার দাওয়াতে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে মুসলিম আদিষ্ট সে দাওয়াতকে আলেমরা দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন:

এক: বিবাহের দাওয়াত। অধিকাংশ আলেমের মতে শরয়ী ওজর না থাকলে এই দাওয়াতে সাড়া দেওয়া আবশ্যক। এমন কিছু ওজরের উল্লেখ নিম্নে আসবে ইন শা আল্লাহ। এর আবশ্যকতার পক্ষে দলীল হলো বুখারী (৪৭৭৯) ও মুসলিমে (২৫৮৫)-এ বর্ণিত হাদীস: আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “সবচেয়ে নিকৃষ্ট খাবার ঐ ওলীমার খাবার, যে খাবারে যে আসতে চায় তাকে (অর্থাৎ মিসকীনকে) বাধা দেওয়া হয় এবং যাকে আহ্বান করা হয় সে (অর্থাৎ ধনী) আসতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। আর যে ব্যক্তি দাওয়াত গ্রহণ করল না সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করল।”

দুই: বিবাহের দাওয়াত ছাড়া অন্যান্য দাওয়াত। অধিকাংশ আলেম মনে করেন যে এই দাওয়াতে সাড়া দেওয়া মুস্তাহাব। কেবল কিছু শাফেয়ী এবং যাহেরীরা এর বিরোধিতা করেছেন এবং এটি আবশ্যক করে দিয়েছেন। এই দাওয়াতে সাড়া দেওয়া মুস্তাহাবের মতটি জোরালো মনে করাই বরং সঠিক মতের কাছাকাছি হবে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

কিন্তু আলেমরা দাওয়াতে সাড়া দেওয়ার বেশ কিছু শর্ত উল্লেখ করেছেন। এই শর্তগুলো না পাওয়া গেলে দাওয়াতে উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব কিংবা মুস্তাহাব হবে না। বরং উপস্থিত হওয়া হারাম হবে। শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে উছাইমীন এই শর্তগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করে বলেন:

১- দাওয়াতের স্থানে মন্দকাজ হবে না। যদি মন্দকাজ সংঘটিত হয়, আর সেটি প্রতিহত করার সক্ষমতা তার থাকে, তাহলে তার জন্য সেটি করার জন্য উপস্থিত হওয়া আবশ্যক হবে। এর কারণ দুটি: দাওয়াতে সাড়া দেওয়া ও মন্দকে পরিবর্তন করা। আর যদি সেটি দূর করতে না পারে, তাহলে তার জন্য উপস্থিত থাকা হারাম হবে।

২- ওলীমায় আহ্বানকারী ব্যক্তি এমন কেউ না হওয়া যাকে ত্যাগ করা আবশ্যক অথবা সুন্নাহ।[যেমন: যে প্রকাশ্য পাপ করে। তাকে পরিত্যাগ করলে এই লাভ হবে যে হয়তো সে তাওবা করবে]

৩- দাওয়াত প্রদানকারী ব্যক্তি মুসলিম হওয়া। অন্যথায় আবশ্যক হবে না। কারণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের হক …”

৪- ওলীমার খাবার বৈধ হওয়া, যা খাওয়া জায়েয।

৫- দাওয়াতের আহ্বানে সাড়া দিলে ওয়াজিব ছেড়ে দেওয়া অথবা এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিত্যাগ করার ব্যাপার যেন না ঘটে। যদি এমনটি হয়, তাহলে আহ্বানে সাড়া দেওয়া হারাম হবে।

৬- এতে সাড়াদানকারীর ক্ষতি নিহিত না থাকা। যেমন: যদি তার সফরের প্রয়োজন হয় অথবা পরিবারের সদস্যকে রেখে যেতে হয় যারা তার উপস্থিতির মুখাপেক্ষী অথবা এ ধরনের অন্য কোনো ক্ষতি।[আল-কাওলুল মুফীদ (৩/১১১) থেকে ঈষৎ পরিবর্তিত]

কিছু আলেম আরেকটি শর্ত বৃদ্ধি করেন:

৭- দাওয়াতকারী দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্দিষ্টভাবে দাওয়াত দেওয়া। যদি একটি আম মজলিসে উপস্থিত সবাইকে তার ওলীমায় উপস্থিত হওয়ার আহ্বান করেন এবং তাদের মধ্যে দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তিও থাকেন, তাহলে অধিকাংশের মতে তার উপস্থিতি আবশ্যক নয়।

এখান থেকে বোঝা যায় যে এ ধরনের দাওয়াতে উপস্থিতি আপনার উপর আবশ্যক নয়; বরং হারাম হবে। যদি আপনি সেখানে মন্দকে পরিবর্তন করতে না পারেন অথবা আপনার উপস্থিতির কারণে স্বামীর অধিকার কিংবা সন্তানের অধিকার নষ্ট হয়; যেমন: তাদেরকে প্রতিপালন করা, তাদেরকে দেখভাল করার ওয়াজিব দায়িত্ব। অধিকন্তু, আপনি যদি দাওয়াত প্রদানকারীদের ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে বাঁচতে না পারেন। এই ওজরের কারণে যেখানে ওয়াজিব দাওয়াতে উপস্থিত থাকার আবশ্যকতা রহিত হয়ে যায় সেখানে এর থেকে নিচের পর্যায়ের দাওয়াত তো আরো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাতিল হয়ে যায়।

নারীকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তাকে যে দাওয়াতে যেতে আহ্বান করা হয়েছে সেখানে যাওয়ার জন্য আগে নিজের স্বামীর কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। আপনার কর্তব্য হলো, আপনি এ বোনদেরকে তাদের দ্বীনী-দুনিয়াবী উপকার হয় এমন কাজে নিজেদের মজলিস ও সময় ব্যয় করার উপদেশ দিবেন। কারণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এমন-সব মজলিসের পরিণতি থেকে সতর্ক করেছেন যেগুলোতে আল্লাহ তাআলার স্মরণ করা হয় না। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “কোন সম্প্রদায় যদি এমন কোনো মজলিসে বসে যাতে আল্লাহর যিকির করা হয় না এবং তাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দরূদ পাঠ করা হয় না সেটি তাদের জন্য আফসোসের ব্যাপার হবে। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন তো তাদেরকে শাস্তি দেবেন। আর যদি চান তো তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।”[হাদীসটি তিরমিযী (৩৩০২) বর্ণনা করেন। তিনি বলেন: এটি হাসান সহীহ হাদীস। শাইখ আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন, যেমনটা সহীহুত তিরমিযীতে (৩/১৪০) বলেছেন]

সুনানে আবু দাউদে (৪২১৪) ও অন্যান্য গ্রন্থে আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “কোনো সম্প্রদায় যদি এমন কোনো মজলিস থেকে উঠে যায় যেখানে আল্লাহর স্মরণ করা হয় না; তারা যেন একটি গাধার মৃতদেহ থেকে উঠে গেল, আর সেটি তাদের জন্য আফসোসের কারণ হবে।”[ইমাম নববী রিয়াদুস সালিহীন গ্রন্থে (৩২১) হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন এবং শাইখ আলবানীও এই মতের ক্ষেত্রে তার অনুসরণ করেছেন]

সুতরাং তাদের কাছে মৌখিকভাবে কিংবা লিখিতভাবে এই উপদেশগুলো পৌঁছে দিন। আর যদি আপনি এর চেয়ে বাড়তি কিছু করে তাদেরকে নিজের বাড়িতে দাওয়াত দেন এবং তাদের এই সমাবেশের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আপনি আল্লাহর যিকিরের একটি জলসার আয়োজন করতে পারেন। এর সাথে আপনি তাদের কাছে প্রিয় এমন বৈধ কিছু বিষয় যুক্ত করতে পারেন। হতে পারে আল্লাহ আপনার বদৌলতে এমন মজলিসগুলো থেকে উপকৃত হওয়ার উত্তম ধারা চালু করে দিতে পারেন।

আল্লাহই তৌফিকদাতা।

সূত্র: শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ