বৃহস্পতিবার 25 জুমাদাল ছানী 1446 - 26 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

যিনি বসে বসে নামায পড়েন তার জন্য তাকবীরে তাহরীমা দাঁড়িয়ে বলা কি ওয়াজিব?

প্রশ্ন

যে ব্যক্তি ফরয নামায বসে বসে পড়েন তার তাকবীরে তাহরীমা বলা সংক্রান্ত ব্যাপারে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই। তার জন্য দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলা কি ওয়াজিব; এরপর তিনি বসবেন? যদি তিনি দাঁড়িয়ে তাকবীর বলতে ভুলে যান; বসা অবস্থায় বলেন সেক্ষেত্রে তাকে কি নামাযটি পুনরায় আদায় করতে হবে? আমার বাবা যোহরের সুন্নত নামায বসে বসে আদায় করছিলেন। যেহেতু তার হাঁটুতে ব্যথ্যা আছে। তিনি রুকু সেজদা করতে পারেন। কিন্তু দাঁড়াতে তার খুব কষ্ট হয়। তিনি যখন ফরয নামায আদায় করেছেন তখনও বসে বসে আদায় করেছেন; তাকবীর দেয়ার জন্য দাঁড়াননি। এমতাবস্থায় তার উপর কি কোন কিছু বর্তাবে?

আলহামদু লিল্লাহ।.

কিয়াম বা দাঁড়ানো ফরয নামাযের একটি রুকন; এটি ছাড়া নামায শুদ্ধ হয় না। তাই দাঁড়াতে অপারগ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো জন্য বসে বসে নামায আদায় করা জায়েয নয়। 

ফরয নামাযের তাকবীরে তাহরীমা বলার জন্য দাঁড়ানোকে আলেমগণ ওয়াজিব মর্মে উদ্ধৃত করেছেন।

ইমাম নববী (রহঃ) "আল-মাজমু" গ্রন্থে (৩/২৯৬) বলেন: "তাকবীরে তাহরীমার প্রতিটি হরফ মুসল্লি দাঁড়ানো অবস্থায় উচ্চারণ করা ওয়াজিব। যদি কোন একটি হরফ দাঁড়ানো অবস্থায় উচ্চারিত না হয় তাহলে তার নামায ফরয নামায হিসেবে সংঘটিত হবে না।"[সমাপ্ত]

আল-আখযারি আল-মালেকি বলেন: "নামাযের ফরযগুলো হচ্ছে— নির্দিষ্ট নামাযের নিয়ত, তাকবীরে তাহরীমা ও তাকবীরে তাহরীমা বলার জন্য দাঁড়ানো, সূরা ফাতিহা ও সূরা ফাতিহা পড়ার জন্য দাঁড়ানো এবং রুকু...।[সমাপ্ত]

আল-খিরাশি (রহঃ) "শারহু মুখতাসারি খলিল" গ্রন্থে (১/২৬৪) নামাযের ফরযগুলো বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: "আমল অনুসরণের ভিত্তিতে সক্ষম, মাসবুক নয় (জামাতের রাকাত ছুটে গেছে এমন নয়) এমন ব্যক্তির জন্য ফরয নামাযের তাকবীরে তাহরীমা বলার জন্য দাঁড়ানো। অতএব, তাকবীরে তাহরীমা বসে কিংবা ঝুঁকে পড়া অবস্থায় উচ্চারণ করলে সেটা জায়েয হবে না।"[সমাপ্ত]

"আল-মাওসূআ আল-ফিকহিয়্যা আল-কুয়েতিয়্যা" গ্রন্থে (১৩/২২০) এসেছে— "যে নামাযের জন্য কিয়াম বা দাঁড়ানো ফরয সে নামাযে মুসল্লির দাঁড়িয়ে তাকবীর বলা ওয়াজিব। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) কে বলেছেন: "তুমি দাঁড়িয়ে নামায আদায় কর, যদি তা না পার তাহলে বসে বসে আদায় কর, যদি সেটাও না পার তাহলে কাত হয়ে শুয়ে আদায় কর।" ইমাম নাসাঈ একটু বাড়তি বর্ণনা করেছেন: "যদি সেটাও না পার তাহলে চিৎ হয়ে শুয়ে নামায আদায় কর"। কিয়াম বা দাঁড়ানো আদায় হবে পিঠ খাড়া রাখার মাধ্যমে।

সুতরাং বসা অবস্থায় কিংবা নুয়ে পড়া অবস্থায় তাকবীরে তাহরীমা বললে সেটা আদায় হবে না। এখানে দাঁড়ানো দ্বারা উদ্দেশ্য হবে— যা হুকমি দাঁড়ানো (যা দাঁড়ানোর স্থলাভিষিক্ত) কেও অন্তর্ভুক্ত করে; যাতে করে কোন ওজরের কারণে বসে বসে ফরয নামায আদায়কারীর বসাও এর মধ্যে শামিল হয়ে যায়।"[সমাপ্ত]

অসুস্থ ব্যক্তি নামাযের ক্ষেত্রে নীতি হল: নামাযের যে যে রুকন ও ওয়াজিব তার পক্ষে আদায় করা সম্ভবপর সেগুলো সে আদায় করবে। আর যেগুলো আদায় করা তার সাধ্যে নেই সেগুলো তার জন্য মওকুফ হবে।

অতএব, তিনি যদি দাঁড়িয়ে নামায শুরু করতে সক্ষম হন তাহলে দাঁড়িয়ে নামায শুরু করা তার উপর ওয়াজিব। এরপর যদি দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্য কষ্টকর হয় তাহলে তিনি বসে পড়বেন। আরও জানতে দেখুন: 263252 নং প্রশ্নোত্তর।

খলিল আল-মালেকির 'মুখতাসারু' নামক গ্রন্থে এসেছে—"যদি দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা পড়তে অপারগ হন তাহলে বসে পড়বেন।"

আল-হাত্তাব এর ব্যাখ্যাতে বলেন:

"ইবনে আব্দুস সালাম বলেন:... এক্ষেত্রে যা বাঞ্ছনীয় সেটা হল: যদি সে ব্যক্তি কিছুটাও দাঁড়াতে সক্ষম হন তাহলে ততটুকু দাঁড়াবেন। হোক সেটা তাকবীরে তাহরীমা বলার মত সময় পরিমাণ কিংবা এর চেয়েও বেশি পরিমাণ। কেননা তার উপর দায়িত্ব হচ্ছে—তেলাওয়াতকালে দাঁড়ানো। যদি কেউ পরিপূর্ণ কিয়াম (দাঁড়ানো) ও পরিপূর্ণ তেলাওয়াত করতে না পারে তাহলে সে ব্যক্তি যতটুকু পারে ততটুকু করবে; বাকীটুকু তার জন্য মওকুফ হবে।[সমাপ্ত]

ইবনে ফারহুন বলেন: অর্থাৎ যদি কেউ মাথা ঘুরানোর কারণে বা অন্য কোন কারণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা শেষ করতে অপারগ হয়; কিন্তু বসে বসে পড়তে সক্ষম হয় তাহলে প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী সে সাধ্যমত সেটা পালন করবে এবং বাকীটুকুর জন্য দাঁড়ানো তার উপর থেকে মওকুফ হবে। বাকীটুকু সে বসে বসে আদায় করবে।

(সতর্কীকরণ) গ্রন্থাকারের বক্তব্য থেকে আপাতঃ মনে হয় যে, তাকে দাঁড়াতেই হবে না; এমনকি তাকবীরে তাহরীমার জন্যেও না— বিষয়টি এমন নয়। তবে তার বক্তব্যের সাথে যদি এ শর্তযুক্ত করা হয় যে, 'যদি তিনি দাঁড়ালে এরপর আর বসতে না পারেন' তাহলে হতে পারে...।[মাওয়াহিবুল জালিল (২/৫) থেকে সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত]

হানাফি মাযহাবের 'আল-ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়্যা' গ্রন্থে (১/১৩৬) এসেছে:

"চতুর্দশ পরিচ্ছেদ: অসুস্থ ব্যক্তির নামায:

যদি অসুস্থ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায পড়তে অক্ষম হয় তাহলে বসে বসে পড়বে। রুকু করবে, সেজদা করবে। হেদায়া গ্রন্থে এভাবে বলা হয়েছে।

অক্ষমতার সবচেয়ে সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে— যদি দাঁড়ালে তার শারীরিক কোন ক্ষতি হয়...। যদি দাঁড়ালে তার কষ্ট হয় তাহলে দাঁড়ানো বর্জন করা জায়েয হবে না। আল-কাফী গ্রন্থে এভাবে বলা আছে।

যদি কেউ কিছু সময় দাঁড়ানোর সক্ষমতা রাখে; গোটা সময় নয়—তাহলে তাকে তার সাধ্যমত দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়া হবে। এমনকি কেউ যদি শুধু তাকবীরে তাহরীমা উচ্চারণ করার মত সময় দাঁড়াতে সক্ষম হয়; তেলাওয়াত করার সময় দাঁড়াতে সক্ষম না হয় কিংবা তেলাওয়াতের কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হয়; গোটা সময় নয়—তাহলে তাকে দাঁড়িয়ে তাকবীর দেওয়া ও সাধ্যানুযায়ী দাঁড়িয়ে ক্বিরাত পড়ার নির্দেশ দেয়া হবে। এরপর সে যদি অক্ষম হয়ে পড়ে তখন বসে যাবে...।"[সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত]

শাইখ মুহাম্মদ মুখতার আল-শানক্বিতি বলেন:

"ওজরগ্রস্ত ব্যক্তি যিনি দাঁড়াতে পারেন না তিনি বসে বসে নামায পড়বেন...।

 যদি কেউ দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলতে সক্ষম হয় তাহলে সে এসে সরাসরি বসে পড়ে তাকবীরে তাহরীমা বলবে না; বরং দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলবে। কেননা তার পক্ষে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলা সম্ভব। এরপর তার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হলে বসে পড়বে। যদি তার পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভবপর না হয় কিংবা কঠিন হয় যেমন পক্ষাঘাত গ্রস্তের অবস্থা তাহলে সেক্ষেত্রে সে ব্যক্তি বসে বসে তাকবীরে তাহরীমা বলবে। আর যদি তার পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভবপর হয় তাহলে সে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করবে এবং চেয়ারটিকে তার পিছনেই রাখবে; এতে কোন অসুবিধা নেই। যদি তার কষ্ট হয় তাহলে সে ব্যক্তি বসে পড়বে। যেহেতু ফিকাহ-এর একটি সূত্র হচ্ছে— أن الضرورة تقدر بقدرها" (জরুরী অবস্থা বা অনন্যোপায় অবস্থাকে তার সীমায় সীমিত রাখা হবে)। এই সূত্রের আরেকটি উপ-সূত্র হচ্ছে— ما أبيح للحاجة يُقَدَّر بقدْرِها (প্রয়োজনের তাগিদে যা বৈধ করা হয়েছে সেটা তার সীমাতে সীমাবদ্ধ থাকবে)

সুতরাং তার জরুরী অবস্থা হচ্ছে— দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হওয়া; তাই আমরা বলব: আপনি দাঁড়িয়ে তাকবীর দিয়ে বসে পড়ুন। যদি কারো জরুরী অবস্থা এমন হয় যে, তিনি দাঁড়াতেই পারেন না; তাহলে আমরা বলব: আমি বসে বসেই তাকবীর দিন; কোন অসুবিধা নেই।

এটির বিধান এর অবস্থাভেদে। ওটির বিধান সেটির অবস্থাভেদে। এ ব্যাপারে মানুষকে সাবধান করতে হবে। কেননা কখনও কখনও আপনি দেখবেন যে, যে ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম তিনি বসে বসে তাকবীর দিচ্ছেন। অথচ তিনি দাঁড়াতে পারেন, কোন কোন ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে চেয়ার নিতে পারেন, চেয়ার বহন করে বের হতে পারেন—এমন ব্যক্তির পক্ষে তাকবীরে তাহরীমার রুকনটি বসে বসে পালন করার রুখসত (ছাড়) দেয়া যায় না। তাকে এ বিষয়ে সাবধান করতে হবে। যদি কেউ দাঁড়াতেই না পারে আমরা বলব: তিনি বসে পড়ুন।"[শারহু যাদিল মুস্তাকনি' (২/৯১ শামেলার নম্বর অনুযায়ী)]

এ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার বাবাকে ঐ নামায পুনরায় আদায় করতে হবে; যে নামাযে তিনি তাকবীরে তাহরীমা দাঁড়িয়ে বলতে ভুলে গেছেন; যদি তার জানা থেকে থাকে যে, তাকবীরে তাহরীমা দাঁড়িয়ে বলা তার জন্যে আবশ্যক ছিল।

আর যদি শরিয়তের হুকুম না জানার কারণে বসে বসে নামায পড়ে থাকেন এবং ধারণা করেন যে, যার জন্য বসে বসে নামায পড়া জায়েয তার জন্য বসে বসে তাকবীর বলাও জায়েয; তাহলে তার জন্য ঐ নামায পুনরায় পড়া আবশ্যক হবে না। আরও জানতে দেখুন: 45648 নং, 193008 নং ও 50684 নং প্রশ্নোত্তর।

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব