আলহামদু লিল্লাহ।.
সাহাবায়ে কেরামের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যবহার ছিল আল্লাহ্র নির্দেশ মোতাবেক। যেমনটি আল্লাহ্ তাআলার নিম্নোক্ত বাণীতে উদ্ধৃত হয়েছে: "আল্লাহ্র অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি কোমল আচরণ করেছিলেন। যদি আপনি রূঢ় ও কঠিনহৃদয় হতেন তাহলে অবশ্যই তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে যেত। আপনি তাদেরকে মাফ করে দিন, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং (গুরুত্বপূর্ণ) বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।"[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯]
এ আয়াতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর সাহাবীবর্গের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে তিনটি গুণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে:
এক: তাদের সাথে দয়ালু ও কোমল হওয়া এবং তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া। এটাই ছিল সাহাবীদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন: "তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল এসেছেন। তোমরা যাতে কষ্ট পাও তা তার জন্যও কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী এবং মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালু।"[সূরা তাওবা, আয়াত: ১২৮]
তাঁর দয়ার উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে তাদেরকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এবং তাদের মধ্যে যারা কিছুটা রূঢ় ব্যবহারে অভ্যস্থ ছিল তাদের প্রতিও তিনি ছিলেন দয়ালু ও ধৈর্যশীল। আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: "একবার আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হাঁটছিলাম। তাঁর গায়ে নাজরানী মোটা পাড়ের ডোরাকাটা চাদর ছিল। এমন সময় এক বেদুইনের সাথে দেখা হল। সে তাঁর চাদর ধরে জোরে টান দিল। আনাস বলেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গলার দিকে তাকিয়ে দেখলাম জোরে টান দেয়ার কারণে চাদরের পাড় তাঁর গলায় দাগ করে ফেলেছে। এরপর লোকটি বলল: হে মুহাম্মদ! আপনার কাছে আল্লাহ্র সম্পদের যা আছে সেটা থেকে আমাকে কিছু দেয়ার নির্দেশ দেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন। এরপর তার জন্য অনুদান দেয়ার নির্দেশ দিলেন।"[সহিহ বুখারী (৬০৮৮) ও সহিহ মুসলিম (১০৫৭)]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, "এক বেদুইন মসজিদে পেশাব করে দিল। লোকেরা তার উপর চড়াও হওয়ার জন্য ছুটে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বললেন: তাকে ছেড়ে দাও এবং তার পেশাবের উপর এক ذنوب (বালতি) কিংবা এক سجل (বালতি) পানি ঢেলে দাও (শব্দের ব্যাপারে রাবীর সন্দেহ)। তোমাদেরকে সহজ করার জন্য পাঠানো হয়েছে; কঠিন করার জন্য নয়।"[সহিহ বুখারী (৬১২৮)]
মুয়াবিয়া বিন হাকাম আস্-সুলামী (রাঃ) বলেন: "একবার আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে নামায পড়ছিলাম। তখন এক লোক হাঁচি দিল। আমি বললাম: ইয়ারহামুকাল্লাহ্ (আল্লাহ্ আপনার প্রতি দয়া করুন)। তখন লোকেরা চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম: আরে কী বিপদ! আপনাদের কী হল? আপনারা আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন? তখন তারা তাদের হাত দিয়ে রানের উপর আঘাত করল। যখন আমি দেখলাম যে তারা আমাকে চুপ করাতে চাচ্ছেন আমি চুপ করে গেলাম। এরপর যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায শেষ করলেন—আমার পিতামাতা তাঁর জন্য উৎসর্গ হোন! আমি তাঁর পূর্বে ও তাঁর পরে তাঁর চেয়ে উত্তম কোন শিক্ষাদাতা দেখিনি— আল্লাহ্র শপথ তিনি আমাকে ধমক দিলেন না, মারলেন না এবং গালমন্দও করলেন না। তিনি বললেন: নিশ্চয় এ নামাযে মানুষের কোন কথা বৈধ নয়। কেবল (বৈধ হল) তাসবীহ, তাকবীর ও কুরআন পাঠ।"[সহিহ মুসলিম (৫৩৭)]
সাহাবীদের সাথে তাঁর দয়াশীল হওয়ার আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে তিনি ছিলেন তাদের সাথে অত্যধিক হাসিখুশি।
জারীর বিন আব্দুল্লাহ্ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: "ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনদিন আমাকে তার কাছে প্রবেশে বাধা দেননি এবং যখনই আমাকে দেখেছেন মুচকি হেসেছেন।"[সহিহ বুখারী (৬০৮৯) ও সহিহ মুসলিম (২৪৭৫)]
আব্দুল্লাহ্ বিন আল-হারেছ বিন জায থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: "আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে অধিক মুচকি হাসতে আর কাউকে দেখিনি।"[সুনানে তিরমিযি (৩৬৪১), আলবানী 'সহিহ সুনানে তিরমিযি' গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
আল্লাহ্র সন্তুষ্টির দাবীসূচক ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে তাঁর রাগ ও ক্রোধ প্রকাশ পেত না এবং তিনি তাঁর সাহাবীবর্গের দ্বীনদারি সুরক্ষা করতেন।
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: "নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুটো বিষয়ের মধ্যে নির্বাচন করার স্বাধীনতা দেয়া হলে তিনি সহজটাই নির্বাচন করতেন; যতক্ষণ না তা গুনাহর কাজ না হত। যদি গুনাহর কিছু হত তাহলে গুনাহ থেকে তিনি সর্বাধিক দূরে অবস্থান করতেন। আল্লাহ্র শপথ! তাঁর সাথে কৃত দুর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি কখনও তাঁর নিজের জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি; যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্র মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না হত। আল্লাহ্র মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হলে তিনি প্রতিশোধ নিতেন।"[সহিহ বুখারী (৬৭৮৬)]
দুই: তিনি তাঁর সাহাবীবর্গের জন্য এবং যে তাকে ক্ষেপিয়েছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে, তিনি বলেন: "হে আল্লাহ্! মুহাম্মদ তো একজন মানুষ। মানুষ যেভাবে রাগ করে তিনিও সেভাবে রাগ করেন। আমি আপনার কাছ থেকে একটি অঙ্গীকার নিয়েছি যে অঙ্গীকারটি আপনি ভঙ্গ করবেন না। যে মুমিনকে আমি কষ্ট দিয়েছি, কিংবা গালি দিয়েছি কিংবা প্রহার করেছি আপনি সেটাকে তার জন্য গুনাহ মোচনকারী বানিয়ে দিন এবং নৈকট্যশীল কর্ম বানিয়ে দিন; যা কিয়ামতের দিন তাকে আপনার নিকটবর্তী করে দিবে।"[সহিহ বুখারী (৬৩৬১) ও সহিহ মুসলিম (২৬০১)]
তিন:
যে বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ অভিজ্ঞতা, প্রয়োজন ও যুক্তি নির্ভর সেক্ষেত্রে তিনি একা সিদ্ধান্ত দিতেন না। তাঁর সাহাবীবর্গের সাথে পরামর্শ করতেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদেরকেও অংশীদার করতেন— আল্লাহ্ তাআলার সেই কথাটি পালনার্থে: (গুরুত্বপূর্ণ) বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯]
ইবনে কাছির (রহঃ) বলেন:
"এ কারণে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন বিষয় সামনে আসলে তাদের সাথে পরামর্শ করতেন; মানসিকভাবে তাদেরকে প্রশান্ত করার জন্য এবং তারা যেন তাদের তৎপরতায় অধিক উদ্যোমী হয় সেজন্য। যেমনিভাবে তিনি বদরের দিন বণিক দলটিকে পাকড়াও করার জন্য বের হওয়ার ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন। তারা বলেছিল: ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে সাগর পাড়ি দেন আমরাও আপনার সাথে সাগর পাড়ি দিব। আপনি যদি আমাদের নিয়ে 'বারকাল গিমাদ'-এ গমন করেন আমরা আপনার সাথে সেখানেই যাব। মুসা আলাইহিস সালামের কওম যে কথা বলেছে "আপনি ও আপনার প্রভু গিয়ে লড়াই করুন। আমরা এখানে বসে আছি।" এমন কথা আমরা বলব না। বরঞ্চ আমরা বলব: আপনি এগিয়ে চলুন। আমরা আপনার সাথে আছি। আমরা আপনার সামনে, ডানে ও বামে থেকে লড়াই করব।
তিনি তাদের সাথে এ পরামর্শও করেছেন যে, অবস্থানস্থল কোথায় হবে? আল-মুনযির বিন আমর (যার উপাধি আল-মু'নিক লিইয়ামুত) পরামর্শ দিয়েছেন যে, শত্রুপক্ষ থেকে এগিয়ে যেতে। অনুরূপভাবে উহুদ যুদ্ধের সময় তিনি তাদের সাথে পরামর্শ করেছেন যে, মদিনাতে অবস্থান করবেন; নাকি শত্রুর দিকে বের হবেন। তখন অধিকাংশ সাহাবী শত্রুর দিকে বের হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পরামর্শ অনুযায়ী তিনি (মদিনা থেকে) বের হন।
অনুরূপভাবে খন্দকের যুদ্ধের দিন তিনি মদিনার ঐ বছরের এক তৃতীয়াংশ খেজুরের বিনিময়ে বিপক্ষ দলগুলোর সাথে সন্ধি করার ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করেছেন। তখন দুই সা'দ: সা'দ বিন মুয়ায ও সা'দ বিন উবাদা এতে আপত্তি জানালে তিনি এই প্রস্তাব বাদ দেন।
হুদাইবিয়ার দিনও তিনি মুশরিকদের ছেলেসন্তানদের উপর হামলা করার ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করেছেন। তখন আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) পরামর্শ দিয়েছেন যে, আমরা কারো সাথে যুদ্ধ করার জন্য আসিনি। আমরা উমরা করতে এসেছি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর (রাঃ) যা বলেছেন সেটা গ্রহণ করেন।
ইফকের ঘটনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
ওহে মুসলমানেরা! আপনারা আমাকে এমন লোকগুলোর ব্যাপারে পরামর্শ দিন যারা আমার পরিবারের উপর অপবাদ দিয়েছে। আল্লাহ্র শপথ! আমি আমার পরিবারের ব্যাপারে খারাপ কিছু জানি না। তারা এমন ব্যক্তির উপর অপবাদ দিয়েছে যার ব্যাপারে আমি ভাল ছাড়া অন্য কিছু জানি না।
তিনি আলী (রাঃ) ও উসামা (রাঃ) এর সাথে আয়েশা (রাঃ) কে ত্বালাক দেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করেছেন।
এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে যুদ্ধের বিষয়ে ও অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ করতেন।"[তাফসির ইবনে কাছির (২/১৪৯) থেকে সমাপ্ত]
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।