রবিবার 23 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 24 নভেম্বর 2024
বাংলা

মদিনা মোনাওয়ারা যিয়ারতকারীর জন্য কিছু ইসলামী দিক-নির্দেশনা

প্রশ্ন

প্রশ্ন: আমি কিছু ভাইদেরকে চিনি যারা এ বছর হজ্জ আদায় করার পর মসজিদে নববী যিয়ারত করবে; তারা আপনাদের কাছে নসীহত ও দিক-নির্দেশনা চাচ্ছে।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

আলহামদুলিল্লাহ।

রাসূলের শহরে আগমনাকারী প্রিয় ভাইগণ! আপনারা উত্তম স্থানে এসেছেন, উত্তম গনিমত নিতে এসেছেন। ত্বাইবা শহরে আপনাদের অবস্থান শুভ হোক। আল্লাহ আপনাদের নেক আমলগুলো কবুল করে নিন। আপনাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো পূর্ণ করে দিন। মোস্তফা-মোখতারের হিজরত ও নুসরতের ভূমিতে আপনাদের স্বাগতম। শ্রেষ্ঠতম সাহাবাদের হিজরতস্থলে, আনসারদের বাসভূমিতে আপনাদের স্বাগতম। এখন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মসজিদ যিয়ারতকারী ভাইদের জন্য কিছু দিক-নির্দেশনা উল্লেখ করব:

১. ত্ববা শহর আগমনকারী প্রিয় ভাইগণ, মক্কার পরে সর্বোত্তম স্থান ও মর্যাদাবান শহরে আপনারা এসেছেন; সুতরাং এ শহরকে যেভাবে মর্যাদা দেয়া দরকার সেভাবে মর্যাদা দিন, এর পবিত্রতা রক্ষা করুন, এখানে আদব ও শিষ্টাচারের পরাকাষ্ঠা বজায় রেখে চলুন। জেনে রাখুন, যে ব্যক্তি এখানে কোন অন্যায় করবে আল্লাহ তাকে কঠোর শাস্তি দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন: “মদিনা হচ্ছে- হারাম (পবিত্রস্থান)। যে ব্যক্তি মদিনাতে কোন অন্যায় করবে, কিংবা কোন অন্যায়কারীকে আশ্রয় দিবে তার উপর আল্লাহর লানত, ফেরেশতাদের লানত এবং সকল মানুষের লানত। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কোন ফরয কিংবা নফল আমল কবুল করবেন না।”[সহিহ বুখারী (১৮৬৭) ও সহিহ মুসলিম (১৩৭০)]

সুতরাং যে ব্যক্তি মদিনাতে কোন গুনাহর কাজ করবে কিংবা কোন গুনাহকারীকে আশ্রয় দিবে, রক্ষা করবে; সে ব্যক্তি নিকৃষ্ট আযাবের সম্মুখীন হবে, আল্লাহর গযবের শিকার হবে।

মারাত্মক গুনাহ হচ্ছে- মদিনার পবিত্র পরিবেশকে প্রকাশ্যে বিদাত করার মাধ্যমে কলুষিত করা। নানারকম কুসংস্কারের মাধ্যমে এ শহরকে দূষিত করা। বিদাতী প্রবন্ধ-নিবন্ধ, শিরকী বই-পুস্তক ও শরিয়ত গর্হিত বিষয়াদি প্রচার করার মাধ্যমে এ ভূমির পবিত্রতা নষ্ট করা। এসব গুনাহকারী ও গুনাহকারীকে আশ্রয়দাতা উভয়ে সমান পাপী।

২. মসজিদে নববী যিয়ারত করা সুন্নত; ওয়াজিব নয়। হজ্জের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই; এটি হজ্জকে পূর্ণ করবে এমন কিছু নয়। মসজিদে নববীর যিয়ারতকে হজ্জের সাথে সম্পৃক্ত করে যেসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে এর সবগুলো মাওজু (বানোয়াট) ও মিথ্যা। যে ব্যক্তি তাঁর মদিনার সফরের মাধ্যমে মসজিদে নববী যিয়ারত ও মসজিদে নববীতে নামায পড়ার উদ্দেশ্য করবে তার উদ্দেশ্য পূণ্যময়, তাঁর আমল সওয়াবসম্ভাব্য। আর যে ব্যক্তির সফরের উদ্দেশ্য কবর যিয়ারত ও কবর-ওয়ালাদের কাছে সাহায্যপ্রার্থনা ছাড়া অন্য কিছু নয় তার উদ্দেশ্য হারাম, তার কর্ম মন্দ। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তিন মসজিদ ছাড়া অন্য কোন গন্তব্যে সফর করা যাবে না: মসজিদে হারাম, আমার এই মসজিদ ও মসজিদে আকসা।”[সহিহ বুখারী (১১৮৯) ও সহিহ মুসলিম (১৩৯৭)]

জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: “সফর করার সবচেয়ে উত্তম গন্তব্য হচ্ছে- আমার এ মসজিদ ও বাইতুল আতিক (কাবা)”[মুসনাদে আহমাদ (৩/৩৫০), আলবানী তাঁর ‘আল-সিলসিলাতুস সহিহা’ গ্রন্থে (১৬৪৮) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

৩. মদিনার মসজিদে নামায আদায়ের সওয়াব বহুগুণ; আলেমদের বিশুদ্ধ মতানুযায়ী সেটা ফরয নামায হোক কিংবা নফল নামায হোক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আমার এ মসজিদে নামায আদায় করা অন্য মসজিদে নামায আদায় করার চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি সওয়াব; তবে মসজিদে হারাম ছাড়া”[সহিহ বুখারী (১১৯০) ও সহিহ মুসলিম (১৩৯৪)]

তবে, নফল নামায ঘরে পড়া মসজিদে পড়ার চেয়ে উত্তম; এমনকি সেটা বর্ধিত সওয়াবের চেয়েও উত্তম। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “ব্যক্তির সর্বোত্তম নামায হচ্ছে তার নিজ ঘরে নামায আদায় করা; শুধু ফরয নামায ছাড়া।”[সহিহ বুখারী (৭৩১)ও সহিহ মুসলিম (৭৮১)]

৪. এ মহান মসজিদের যিয়ারতকারী প্রিয় ভাই, জেনে রাখুন মসজিদে নববীর কোন অংশ স্পর্শ করে কিংবা চুম্বন করে বরকত গ্রহণ করা জায়েয নয়; সেটা মসজিদের পিলার, দেয়াল, দরজা, মেহরাব কিংবা মিম্বর যাই হোক না কেন। অনুরূপভাবে নবীজির হুজরা স্পর্শ করা, চুম্বন করা কিংবা কাপড় দিয়ে মুছে বরকত নেয়া জায়েয নয়; হুজরার চতুর্দিকে তাওয়াফ করাও জায়েয নয়। যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করে ফেলেছেন তার উপর তওবা করা ও পুর্নবার এমন কাজ না করা ফরয।

৫. যে ব্যক্তি মসজিদে নববী যিয়ারত করবেন তার জন্য রিয়াযুল/রিয়াদুল জান্নাতে দুই রাকাত নামায আদায় করা কিংবা যত রাকাত তিনি পারেন নামায পড়া বিধানসম্মত। যেহেতু এর ফযিলত সাব্যস্ত। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: “আমার ঘর ও আমার মিম্বরের মাঝের স্থানটুকু- রাওদাতুন মিন রিয়াদিল জান্নাহ (জান্নাতের এক টুকরা বাগান) এবং আমার হাউজ আমার মিম্বরের উপর রয়েছে।”[সহিহ বুখারী (১১৯৬) ও সহিহ মুসলিম (১৩৯১)]

ইয়াজিদ ইবনে আবু উবাইদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি সালামা বিন আকওয়া এর সাথে আসতাম এবং মুসহাফের নিকটবর্তী পিলারের কাছে নামায পড়তাম। অর্থাৎ রিয়াদুল জান্নাতে। আমি বললাম: হে আবু মুসলিম, আপনাকে দেখি এ পিলারের কাছে নামায পড়তে বেশি আগ্রহী? তিনি বলেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ পিলারের কাছে নামায পড়তে আগ্রহী দেখেছি।[সহিহ বুখারী (৫০২) ও সহিহ মুসলিম (৫০৯)]

তবে, রিয়াদুল জান্নাতে নামায পড়ার আগ্রহ যেন অন্য মানুষকে কষ্ট দেয়া, দুর্বলকে ধাক্কা দেয়া কিংবা মানুষের ঘাড় টপকে যাওয়ার পর্যায়ে গিয়ে না ঠেকে।

৬. মদিনা যিয়ারতকারী ও মদিনার বাসিন্দাদের জন্য মসজিদে কুবাতে এসে নামায আদায় করার বিধান রয়েছে— নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণে ও উমরার সওয়াব পাওয়ার নিমিত্তে। সাহল বিন হানিফ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি (তার ঘর থেকে) বের হয়ে এই মসজিদে আসবে অর্থাৎ মসজিদে কুবাতে এবং নামায আদায় করবে সে ব্যক্তি উমরার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে” [মুসনাদে আহমাদ (৩/৪৮৭) ও সুনানে নাসাঈ (৬৯৯), আলবানি তাঁর ‘সহিহ তারগীব’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন (১১৮০, ১১৮১)]

সুনানে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে এসেছে- “যে ব্যক্তি তাঁর ঘর থেকে পবিত্রতা অর্জন করবে অতঃপর মসজিদে কুবাতে এসে নামায আদায় করবে সে উমরার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে।”[সুনানে ইবনে মাজাহ (১৪১২)]

সহিহ বুখারী (১১৯১) ও সহিহ মুসলিমে (১৩৯৯) এসেছে- “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি শনিবার পায়ে হেঁটে কিংবা সওয়ারী হয়ে মসজিদে কুবাতে এসে দুই রাকাত নামায আদায় করতেন।”

৭. সম্মানিত যিয়ারতকারী ভাই, মসজিদে নববী ও মসজিদে কুবা এ দুই মসজিদ ছাড়া মদিনার আর কোন মসজিদ যিয়ারত করার বিধান নেই। কুরআন-হাদিসে ও সাহাবায়ে কেরামের আমলে যদি কোন ভূখণ্ড যিয়ারত করার দলিল না থাকে তবে কোন যিয়ারতকারীর জন্য কিংবা অন্য কারো জন্য নেকীর আশায় সে ভূখণ্ডের উদ্দেশ্যে সফর করা ও সেখানে গিয়ে ইবাদত করার কোন বিধান নেই; ।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে স্থানগুলোতে বা মসজিদগুলোতে নামায পড়েছেন সেগুলো খুঁজে খুঁজে সেখানে নামায পড়া, দোয়া করা, ইত্যাদি ইবাদত করা শরিয়তের বিধানে নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব স্থানকে উদ্দেশ্য করার আদেশ করেননি, যিয়ারত করতে উদ্বুদ্ধ করেননি। মারুর বিন সুওয়াইদ (রহঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “আমরা উমর বিন খাত্তাম (রাঃ) এর সাথে বের হয়েছিলাম। পথে আমরা একটি মসজিদ পেলাম। লোকেরা ছুটে গিয়ে সে মসজিদে নামায আদায় করল। তখন উমর (রাঃ) বললেন: তাদের কি হয়েছে? তারা বলল: এই মসজিদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায আদায় করেছেন। তখন উমর (রাঃ) বললেন: হে লোক সকল, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতেরা এ ধরণের কর্মের মাধ্যমে ধ্বংস হয়েছে। এমনকি তারা এ স্থানগুলোতে উপাসনালয় স্থাপন করেছে। এ ধরণের কোন স্থান অতিক্রম করার সময় যদি কারো নামাযের সময় হয় তাহলে সে নামায পড়তে পারে। আর যার নামাযের সময় না হয় সে তার যাত্রা অব্যাহত রাখবে।[মুসান্নাফ ইবনে আবু শায়বা (৭৫৫০)]

৮. মসজিদে নববী যিয়ারতকারী পুরুষদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবর ও তাঁর দুই সাহাবী আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ) এর কবর যিয়ারত করে সালাম দেয়া ও তাদের জন্য দোয়া করা বিধানসম্মত। পক্ষান্তরে, আলেমদের বিশুদ্ধ মতানুযায়ী নারীদের জন্য কবর যিয়ারত করা নাজায়েয। দলিল হচ্ছে- সুনানে আবু দাউদ (৩২৩৬), সুনানে তিরমিযি (৩২০) ও সুনানে ইবনে মাজাহ (১৫৭৫) গ্রন্থে ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর যিয়ারতকারী নারীদের উপর লানত করেছেন”[আলবানী ‘ইসলাহুল মাসাজিদ’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]

আরেকটি দলিল হচ্ছে, সুনানে তিরমিযি (১০৫৬) গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক কবর যিয়ারতকারী নারীদের উপর লানত করেছেন। তিরমিযি বলেন: হাদিসটি হাসান। এ হাদিসটি মুসনাদে আহমাদ (২/৩৩৭), সুনানে ইবনে মাজাহ (১৫৭৪) ও মিশকাতুল মাসাবিহ (১৭৭০) গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে। আলবানী ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে (৮৪৩) হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।

কবর যিয়ারত করার পদ্ধতি হচ্ছে- যিয়ারতকারী কবরের সামনে এসে কবরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলবেন: “আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ”। এরপর একহাত সমান ডানে সরে এসে আবু বকর (রাঃ) এর কবরে সালাম দিবেন। বলবেন: “আসসালামু আলাইকা ইয়া আবা বাকর”। আরও একহাত ডানে সরে এসে উমর (রাঃ) এর কবরে সালাম দিবেন। বলবেন: “আসসালামু আলাইকা ইয়া উমর”।

৯. মদিনা শরিফ যিয়ারতকারী পুরুষদের জন্য বাকঈ কবরস্থানে শায়িতদের কবর যিয়ারত করা ও উহুদের যুদ্ধে শহিদদের কবর যিয়ারত করার বিধান রয়েছে; যাতে করে তাদেরকে সালাম দিয়ে তাদের জন্য দোয়া করা যায়। বুরাইদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, তারা কবর যিয়ারতে বের হলে রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে (এ দোয়াটি পড়া) শিক্ষা দিতেন: ‘আসসালামু আলাইকুম আহলাদ্‌ দিয়ার মিনাল মু’মিনীন ওয়াল মুসলিমীন। ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লাহিকুন। নাসআলুল্লাহ লানা ও লাকুমুল আফিয়া’ (অর্থ- এ কবরগুলোর মুমিন, মুসলমান বাসিন্দারা! আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। নিশ্চয় আল্লাহ যখন চাইবেন তখন আমরাও আপনাদের সাথে মিলিত হব। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য ও আপনাদের জন্য নাজাত প্রার্থনা করছি)।[সহিহ মুসলিম (৯৭৪ ও ৯৭৫)]

১০. দুইটি মহান উদ্দেশ্যে কবর যিয়ারতের বিধান দেয়া হয়েছে:

এক. যিয়ারতকারী নিজে উপদেশ গ্রহণ করা।

দুই. যার কবর যিয়ারত করা হচ্ছে তার জন্য দোয়া করা, রহমত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।

কবর যিয়ারত করার শর্ত হচ্ছে বাতিল কোন কথা না বলা। এর মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য হচ্ছে- শিরকি ও কুফরি করা। বুরাইদা তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। তবে, এখন যারা যিয়ারত করতে চায় তারা যিয়ারত করতে পার। কিন্তু, কোন বাতিল কথা বলবে না।”[সুনানে নাসাঈ (২০৩৩), আলবানী ‘সিলসিলা সহিহা’ গ্রন্থে (৮৮৬) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম মুসলিমও (৯৭৭) হাদিসটি বর্ণনা করেছেন; তবে, ‘বাতিল কথা বলবে না’ এ অংশটি ছাড়া।

সুতরাং এ কবরগুলো তাওয়াফ করা, কিংবা অন্য কোন কবর তাওয়াফ করা, কবরের দিকে নামায পড়া, কবরের মাঝখানে নামায পড়া, কিংবা কবরের নিকটে কুরআন তেলাওয়াত, দোয়া ইত্যাদি ইবাদত করা জায়েয নেই্। কেননা এসব কর্ম সৃষ্টিকুলের প্রতিপালকের সাথে শির্ক করার মাধ্যম, এগুলোর মাধ্যমে কবরগুলোকে ইবাদতের স্থান বানানো হয়; যদিও কবরের উপরে কোন স্থাপনা তৈরী করা না হোক। আয়েশা (রাঃ) ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মৃত্যুর সময় নিজের মুখের উপর এক টুকরা কাপড় দিয়ে ছিলেন। যখন তিনি তাপ অনুভব করতেন তখন কাপড়টি সরিয়ে রাখতেন। এ অবস্থায় তিনি বলেন: “ইহুদি ও খ্রিস্টানদের উপর আল্লাহর লানত হোক; তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদ বানিয়েছে।” তিনি তাদের কর্ম থেকে সাবধান করতে গিয়ে এ কথা বলেন।[সহিহ বুখারী (৪৩৬) ও সহিহ মুসলিম (৫২৯)]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ হচ্ছে তারা যারা কিয়ামত সংঘটনের সময় জীবিত থাকবে এবং তারা যারা কবরগুলোকে মসজিদ বানাবে।”[মুসনাদে আহমাদ (১/৪০৫), এ হাদিসটি প্রধান অংশ ‘মুয়াল্লাক’ হিসেবে সহিহ বুখারীর ‘ফিতান’ অধ্যায়ের এর ‘যুহুরুল ফিতান’ পরিচ্ছেদে (৭০৬৭) উদ্ধৃত হয়েছে এবং সহিহ মুসলিমের ‘ফিতান’ অধ্যায়ের ‘কুরবুস সাআ’ পরিচ্ছেদে (২৯৪৯) উদ্ধৃত হয়েছে; তবে সেখানে কবরকে মসজিদ বানানোর বিষয়টি বর্ণিত হয়নি।

আবু মারছাদ আল-গানাওয়ি (রাঃ) বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি: “তোমরা কবরের উপর বসো না এবং কবরের দিকে নামায পড়ো না।”[সহিহ মুসলিম (৯৭২)]

আবু সাঈদ আল-খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “গোটা পৃথিবী নামাযের স্থান; কেবল কবরস্থান ও বাথরুম ছাড়া”[মুসনাদে আহমাদ (৩/৮৩), সুনানে তিরমিযি (৩১৭) আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’ গ্রন্থে (১/৩২০) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের মাঝখানে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন।[সহিহ ইবনে হিব্বান (১৬৯৮), হাইছামি ‘মাজমাউল যাওয়ায়েদ’ গ্রন্থে (২/২৭) এ হাদিস সম্পর্কে বলেন: ‘হাদিসটির রাবীগণ সহিহ হাদিসের রাবী’]

কবরের উপর সিজদা দেয়া নাজায়েয। বরং এটি জাহেলি পৌত্তলিকতা, চিন্তাধারার অস্বাভাবিকতা ও বিবেকবুদ্ধির দৈন্যতা। যিয়ারতকারীদের জন্য এ কবরগুলোকে স্পর্শ করে, চুম্বন করে, শরীরের বিশেষ অংশ স্পর্শ করিয়ে বরকত গ্রহণ করা নাজায়েয। রোগ নিরাময়ের জন্য কবরের মাটি সংগ্রহ করা, গায়ে মাখানো, কিংবা গোসল করার জন্য কিছু মাটি সাথে নেয়া নাজায়েয। বরকতের নিয়তে যিয়ারতকারীর জন্য তার চুলের কিংবা শরীরের কোন কিছু অথবা টিস্যু পেপার কবরে পুতে রাখা কিংবা তার ছবি বা তার সাথে থাকা অন্য কিছু কবরে রেখে আসা নাজায়েয। অনুরূপভাবে নগদ অর্থ কিংবা শষ্যবীজ বা এ জাতীয় কোন খাদ্যদ্রব্য কবরে নিক্ষেপ করা নাজায়েয। যে ব্যক্তি এমন কোন কর্মে লিপ্ত হয়েছে তার উপর ফরয তওবা করে নেয়া এবং এমন কর্মে পুনরায় লিপ্ত না হওয়া। কবরে সুগন্ধি লাগানো, কবরওয়ালাদের দিয়ে কসম করা নাজায়েয। কবরওয়ালাদের ওসিলা দিয়ে কিংবা তাদের মর্যাদা ও অধিকারের দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা নাজায়েয; বরং এটি হারাম ওসিলা ও শির্কের বাহন। কবর উঁচু করা ও কবরের উপর স্থাপনা নির্মাণ করা নাজায়েয। কেননা কবর উঁচু করা ও কবরের উপর স্থাপনা নির্মাণ করা কবরকে সম্মান করার মাধ্যম এবং কবর দ্বারা ফিতনাগ্রস্ত হওয়ার কারণ। যারা খরিদকৃত খাদ্য বা সুগন্ধি এসব গর্হিত কাজে ব্যবহার করবে মর্মে জানা যায় তাদের কাছে এগুলো বিক্রি করাও নাজায়েয।

মৃতব্যক্তিদের কাছে বিপদমুক্তি-প্রার্থনা করা কিংবা সাহায্য প্রার্থনা করা কিংবা মদদ চাওয়া, অথবা অভাব দূর করার জন্য তাদেরকে ডাকা, কিংবা দুশ্চিন্তা দূর করা, কল্যাণ আনয়ন ও অকল্যাণ দূর করার জন্য প্রার্থনা করা শির্কে আকবার (বড় শির্ক); এটি করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মুসলিম মিল্লাত থেকে বের হয়ে যাবে এবং এটি তাকে পৌত্তলিক উপাসকে পরিণত করবে। কারণ দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা এক আল্লাহ ছাড়া কেউ দূর করতে পারে না; তাঁর কোন শরিক নেই্। আল্লাহ তাআলা বলেন: “তিনিই আল্লাহ্‌ তোমাদের রব। আধিপত্য তাঁরই। আর তোমরা তাঁর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো খেজুর আঁটির আবরণেরও অধিকারী নয়। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে না। আর তোমরা তাদেরকে যে শরীক করেছ তা তারা কিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞ আল্লাহর মত কেউই আপনাকে অবহিত করতে পারে না।”।[সূরা ফাতির, আয়াত: ১৩-১৪]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: বলুন, ‘তোমরা আল্লাহ্‌ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ্‌ মনে কর তাদেরকে ডাক, অতঃপর দেখবে যে, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার বা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই। তারা যাদেরকে ডাকে তারাই তো তাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিটকতর হতে পারে, আর তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয় আপনার রবের শাস্তি ভয়াবহ।”[সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৫৬-৫৭]

আল্লাহই ভাল জানেন।

সূত্র: শাইখ সালাহ আল-বুদাইর, ইমাম ও খতীব, মসজিদে নববী