আলহামদু লিল্লাহ।.
যে ব্যক্তি অন্য কারো কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে তার উপর আবশ্যক হল সে যে মুদ্রাতে ঋণ নিয়েছে অনুরূপ মুদ্রাতে ঋণ পরিশোধ করা; ঋণ গ্রহণের সময় ঋণের যে মূল্য ছিল সেটা নয়। বরঞ্চ চুক্তিপত্রে এটা উল্লেখ করা জায়েয নেই যে, গৃহীত মুদ্রা বাদ দিয়ে অন্য মুদ্রাতে ঋণ পরিশোধ করা হবে। যেমন, কেউ একজন সৌদি রিয়ালে ঋণ নিয়ে ঋণ গ্রহণের সময় মিশরী মুদ্রাতে সেটার মূল্য কত ছিল তা হিসাব করে মিশরী মুদ্রায় ঋণ পরিশোধ করা জায়েয নয়। যদি কেউ স্বাচ্ছন্দচিত্তে দুটো মুদ্রার মাঝে মূল্যের যে ব্যবধান সেটা পরিশোধ করতে চায় তাহলে জায়েয হবে; তবে দাবী করে নয়। এই মর্মে ফিকাহ একাডেমিগুলোর ফতোয়া ও আমাদের অনেক বিজ্ঞ আলেমের ফতোয়া রয়েছে।
'মুদ্রার দর পরিবর্তন' সংক্রান্ত বিষয়ে কুয়েতে অনুষ্ঠিত 'ইসলামী ফিকাহ একাডেমি'-এর পঞ্চম সেমিনার-এ (১-৬ জুমাদাল উলা ১৪০৯ হিঃ মোতাবেক ১০-১৫ ডিসেম্বর ১৯৮৮খ্রিঃ) সিদ্ধান্ত নং ৪২(৪/৫) তে বলা হয়েছে:
'মুদ্রার দর পরিবর্তন' সংক্রান্ত বিষয়ে সদস্যবর্গ ও বিশেষজ্ঞগণের পেশকৃত গবেষণাপত্র অবহিত হওয়া ও এর উপর আলোচনা-সমালোচনা শুনার পর এবং তৃতীয় সেমিনারের সিদ্ধান্ত নং ২১(৩/৯) অবহিত হওয়ার পর যাতে রয়েছে যে, "কাগুজে মুদ্রাগুলো মুদ্রা হিসেবে ধর্তব্য। এগুলোর পরিপূর্ণ মূল্যমান রয়েছে। যাকাত, সুদ, সালাম ব্যবসা কিংবা অন্যান্য বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে স্বর্ণ-রৌপ্যের জন্য যেসব শরয়ি বিধি-বিধান প্রযোজ্য এগুলোর ক্ষেত্রেও সেসব বিধি-বিধান প্রযোজ্য": কমিটি নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত দেয়:
"কোন বিশেষ মুদ্রায় সাব্যস্ত ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে অনুরূপ মুদ্রায় ধর্তব্য; মূল্য নয়। কেননা ঋণ পরিশোধ করতে হয় অনুরূপ জিনিস দিয়ে। তাই কারো যিম্মাদারিতে সাব্যস্ত ঋণ সেটা যে উৎস থেকেই হোক না কেন; সেটাকে বাজার দরের সাথে সম্পৃক্ত করা জায়েয হবে না।
[একাডেমির ম্যাগাজিন (সংখ্যা-৫, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১৬০৯)]
শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:
"আমার এক দ্বীনি ভাই 'হাসান' আমাকে দুই হাজার তিউনেশিয়ান দিনার ঋণ দিয়েছে। আমরা একটি চুক্তিপত্রও লিখেছি। চুক্তিপত্রে আমরা ঐ অংকের অর্থের জার্মানি মুদ্রায় মূল্য উল্লেখ করেছি। ঋণের নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পর (সেটা ছিল এক বছর) জার্মানি মুদ্রার দাম বেড়ে যায়। এখন আমি যদি তাকে চুক্তিপত্রে যা আছে সেটা পরিশোধ করি তাহলে বিষয়টি এমন হবে যে, আমি তার থেকে যা ঋণ নিয়েছি তার চেয়ে তিনশত তিউনেশিয়ান দিনার বেশি পরিশোধ করলাম। এমতাবস্থায় ঋণদাতার জন্য এই অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা কি জায়েয হবে; নাকি সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে...? বিশেষত সে জার্মানি মুদ্রায় পরিশোধ করাটা চাচ্ছে; যাতে করে সে জার্মানি থেকে গাড়ী কিনতে পারে।
জবাবে তিনি বলেন: ঋণদাতা 'হাসান' যে অর্থ ঋণ দিয়েছে সেটা ছাড়া আর কিছু সে পাবে না। আর তা হল দুই হাজার তিউনেশিয়ান দিনার। তবে, আপনি যদি এর চেয়ে বেশি তাকে দিতে সম্মত হন তাহলে কোন অসুবিধা নেই। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: "মানুষের ঐ ব্যক্তি উত্তম যে উত্তমভাবে (ঋণ) পরিশোধ করে"।[সহিহ মুসলিম] সহিহ বুখারীতে এসেছে এ ভাষায়: "উত্তম মানুষদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত যে উত্তমরূপে (ঋণ) পরিশোধ করে"।
পক্ষান্তরে, উল্লেখিত চুক্তিপত্রটি অকার্যকর। এর ভিত্তিতে কোন কিছু অবধারিত হবে না। যেহেতু এটি শরিয়ত বিরোধী চুক্তি। শরয়ি দলিলগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, ঋণ দাবী করার সময় যেই দর সেই দর ছাড়া ঋণ বিক্রি করা জায়েয নয়। তবে, ঋণগ্রহীতা যদি সদাচরণ ও উপঢৌকনস্বরূপ বেশি দিতে সম্মত হয় তাহলে পূর্বোক্ত হাদিসের ভিত্তিতে সেটা জায়েয হবে।"[সমাপ্ত]
[ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা (২/৪১৪)]
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) প্রশ্নকারীর অনুরূপ প্রশ্নের জবাবে বলেন:
"আবশ্যক হচ্ছে- আপনি তাকে যা ঋণ দিয়েছেন সেটা ডলারে ফেরত দেওয়া। কেননা এই ঋণটাই আপনি তাকে প্রদান করেছেন। কিন্তু, তা সত্ত্বেও আপনার দুইজন যদি এই মর্মে সমঝোতা করেন যে, সে আপনাকে মিশরী পাউন্ড ফেরত দিবে; তাতে কোন অসুবিধা নেই। ইবনে উমর (রাঃ) বলেন: আমরা দিরহামে উট বিক্রি করে দিরহামের পরিবর্তে দিনার গ্রহণ করতাম। আবার দিনারে বিক্রি করে দিরহাম গ্রহণ করতাম। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: "কোন অসুবিধা নেই; যদি ঐ দিনের মূল্য গ্রহণ কর এবং তোমরা দুইজন বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে তোমাদের মাঝে কোন লেনদেন না রাখ।" কারণ এটি হচ্ছে- ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর নগদ নগদ লেনদেন। এটি রৌপ্য দিয়ে স্বর্ণ বিনিময় করার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সুতরাং আপনি ও সে যদি এই মর্মে একমত হন যে, সে আপনাকে এ ডলারগুলোর পরিবর্তে মিশরী পাউন্ড প্রদান করবে এই শর্তে যে, আপনি তার সাথে যে সময়ে মুদ্রা পরিবর্তন করতে একমত হয়েছেন সে সময়ে যে দর এর চেয়ে বেশি পাউন্ড গ্রহণ করবেন না তাহলে এতে কোন অসুবিধা নেই। যেমন- ২০০০ ডলার যদি ২৮০০ পাউন্ড এর সমান হয় তাহলে আপনার জন্য ৩০০০ পাউন্ড গ্রহণ করা জায়েয হবে না। কিন্তু আপনার জন্য ২৮০০ পাউন্ড গ্রহণ করা কিংবা শুধু ২০০০ ডলার গ্রহণ করা জায়েয হবে। মানে আপনি সেই দিনের বাজার দরে গ্রহণ করবেন কিংবা এর চেয়ে কমে গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ বেশি গ্রহণ করবেন না। কেননা আপনি যদি বেশি গ্রহণ করেন তাহলে আপনি এমন কিছু গ্রহণ করলেন যেটার গ্যারান্টি (ক্ষতিপূরণ) দেয়া আপনার দায়িত্বে প্রবেশ করেনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন লাভ থেকে নিষেধ করেছেন যেটার ক্ষতির দায়িত্ব ব্যক্তির উপরে ছিল না। পক্ষান্তরে, যদি কম গ্রহণ করেন তাহলে সেটা হবে ব্যক্তি তার কিছু অধিকার ছেড়ে দিল; বাকীটুকু আদায় করল। এতে কোন অসুবিধা নেই। [সমাপ্ত]
[ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা (২/৪১৪, ৪১৫)]
দুই পক্ষের কোন এক পক্ষ যদি এই হুকুমের বিপরীত করে তাহলে সে দুই মুদ্রার মূল্যের মাঝে যে ব্যবধান সেটা অন্যায়ভাবে গ্রহণকারী হবে। এটি হারাম। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: "হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।"[সূরা নিসা, আয়াত: ২৯]
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।