আমরা আশা করছি, আপনাদের ওয়েবসাইট Islam Q&A (ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব) কে সাপোর্ট দেয়ার জন্য মুক্তহস্তে দান করবেন; যাতে করে ইনশা আল্লাহ্ ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সেবায় আপনাদের ওয়েবসাইট তার পথ চলা অব্যাহত রাখতে পারে।
রমযান মাসে ইবাদতের জন্য অবসর হওয়া কিংবা ইলম অর্জন করা— কোনটি উত্তম?
আলহামদু লিল্লাহ।.
মাহে রমযান একটি মহান মাস। এ মাসকে আল্লাহ্ কল্যাণের মৌসুম বানিয়েছেন। তাকওয়া ও বরকতের সম্বল বানিয়েছেন। এ মাসে আল্লাহ্ কুরআন নাযিল করেছেন। তিনি বলেন: “রমযান মাস; যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসে (স্বগৃহে) উপস্থিত থাকবে, সে যেন এ মাসটি রোযা থাকে।”[সূরা বাকারা, আয়াত ২: ১৮৫]
এটি গণীমত অর্জন ও লাভবান হওয়ার মাস। বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী মৌসুমকে কাজে লাগায়; যাতে করে তিনি নিজের লাভ বাড়াতে পারে। এ মাসকে কাজে লাগানো যাবে ইবাদতের মাধ্যমে, অধিক নামাযের মাধ্যমে, কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে, মানুষকে ক্ষমা করে দেয়ার মাধ্যমে, অন্যের প্রতি ইহসান করার মাধ্যমে, গরীবদের প্রতি দান করার মাধ্যমে এবং ইত্যাদি অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযান মাসে এমন ইবাদত করতেন অন্য মাসগুলোতে যা করতেন না। ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন শ্রেষ্ঠ দানবীর মানুষ। তিনি সর্বাধিক দানবীর হতেন রমজান মাসে; যখন জিব্রাইল (আঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাত করত। জিব্রাইল (আঃ) প্রতি রাতে তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন এবং একে অপরকে কুরআন পাঠ করে শুনাতেন। নিশ্চয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুক্ত বাতাসের চেয়ে অধিক দানবীর ছিলেন।”[সহিহ বুখারী (৬) ও সহিহ মুসলিম (২৩০৮)]
ইবনে রজব (রহঃ) বলেন: “শাফেয়ি বলেছেন: আমি পছন্দ করি ব্যক্তি রমযান মাসে তার দান বাড়াবে— রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণে এবং যেহেতু রমযান মাসে মানুষ নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য সাহায্যের মুখাপেক্ষী থাকে এবং যেহেতু অনেক মানুষ রোযা ও নামাযে ব্যস্ত থাকায় উপার্জন করতে পারে না। তাই দানশীল মানুষদের রমযান মাসে দানশীল হওয়াটা কাম্য।”[লাতায়েফুল মাআরিফ (পৃষ্ঠা-১৬৯)]
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “যখন (রমযানের) শেষ দশক প্রবেশ করত তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাত জাগতেন, তাঁর পরিবারকে জাগিয়ে দিতেন, পরিশ্রম করতেন, লুঙ্গি বেঁধে নিতেন।”[সহিহ বুখারী (২০২৪) ও সহিহ মুসলিম (১১৭৪)]
সালাফদের আদর্শ ছিল যখন রমযান প্রবেশ করত তখন তারা সবকিছু ছেড়ে ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন; বিশেষতঃ কুরআন তেলাওয়াতে।
তাদের কারো কারো সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি ইলমের মজলিসগুলো বাদ দিয়ে ইবাদতে ও কুরআন তেলাওয়াতে সময় দিতেন।
ইবনে রজব ‘লাতায়িফুল মাআরিফ’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-১৭১) বলেন:
“রমযান প্রবেশ করলে যুহরী বলতেন: এই মাস শুধু কুরআন তেলাওয়াত ও মানুষকে খাওয়ানোর মাস।
ইবনে আব্দুল হাকাম বলেন: যখন রমযান প্রবেশ করত তখন মালেক (রহঃ) হাদিস পাঠ ও আলেমদের সাথে মজলিস করা থেকে অবসর নিতেন এবং মুসহাফ থেকে কুরআন তেলাওয়াতে মনোনিবেশ করতেন।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন: যখন রমযান প্রবেশ করত তখন সুফিয়ান ছাওরী সব ইবাদত বাদ দিয়ে কুরআন তেলাওয়াতে মনোনিবেশ করতেন।”[সমাপ্ত]
রমযান মাসে সলফে সালেহীনদের ইবাদত ও কুরআন তেলাওয়াতের জন্য অবসর নেয়ার পক্ষে আরও প্রমাণ বহন করে, রমযান মাসে তাদের বেশি বেশি কুরআন খতম দেয়ার বর্ণনাগুলো।
আব্দুর রহমান বিন আব্দুল্লাহ্ থেকে বর্ণিত তিনি আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণনা করেন: তিনি রমযান মাসে প্রতি তিনদিনে খতম দিতেন। আর রমযান ছাড়া অন্য সময়ে এক জুমা থেকে অপর জুমায় খতম দিতেন।[তাফসিরে ‘সাঈদ ইবনে মানসুর’ (২/৪৫২) ও বাইহাকীর ‘আস্-সুনান আল-কুবরা (২/৪৪৯)]
ইব্রাহিম আন-নাখাঈ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আল-আসওয়াদ রমযান মাসের প্রত্যেক দুই রাতে কুরআন খতম করতেন। তিনি মাগরিব ও এশার মাঝের সময়টুকু ঘুমাতেন। অন্য সময়ে প্রতি ছয়দিনে কুরআন খতম দিতেন।[মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক (১/৫৬৫), তাফসিরে সাঈদ বিন মানসুর (২/৪৪৯), বর্ণনাটির সনদ সহিহ]
আবু ইউসুফ (রহঃ) বলেন: আবু হানিফা (রহঃ) প্রতি দিন ও রাতে কুরআন খতম করতেন। যখন রমযান মাস আসত তখন ঈদের রাত ও ঈদের দিন সহ বাষট্টি বার কুরআন খতম করতেন।[আখবার আবু হানিফা ও আসহাবিহি (পৃষ্ঠা-৫৫) থেকে সমাপ্ত]
রাবীঈ বিন সুলাইমান (রহঃ) বলেন: শাফেয়ি প্রতি রাতে কুরআন খতম করতেন। যখন রমযান আসত তখন প্রতি রাতে এক খতম ও প্রতি দিনে এক খতম করতেন। এভাবে রমযান মাসে তিনি ষাট বার কুরআন খতম করতেন।[তারিখু বাগদাদ ও যুয়ুলুহু (২/৬১)]
মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল আল-বুখারীর ছাত্রগণ রমযান মাসের প্রথম রাতে তার কাছে সমবেত হত। তিনি তাদেরকে নিয়ে নামায পড়তেন। প্রতি রাকাতে বিশ আয়াত তেলাওয়াত করতেন। এভাবে কুরআন খতম করা পর্যন্ত।
অনুরূপভাবে শেষ রাতে কুরআনের অর্ধেক থেকে এক তৃতীয়াংশ পড়তেন। এভাবে প্রতি তিনদিনে শেষ রাতে কুরআন খতম করতেন। আর দিনের বেলায় প্রতিদিন এক খতম দিতেন।[শুআবুল ঈমান (৩/৫২৪) থেকে সমাপ্ত]
পূর্বোক্ত আলোচনার সারকথা:
রমযান মাসে উত্তম হলো ইবাদতে মনোনিবেশ করা। বিশেষতঃ কুরআন তেলাওয়াতে। তদুপরি কিছু ইলমী মজলিসে হাযির হতে ও কিছু বই পড়তে বাধা নেই। যাতে করে এর মাধ্যমে মনকে চাঙ্গা রাখা যায় এবং উপকারী কিছুর মাধ্যমে মনকে কিছুটা শৈথিল্য দেয়া যায়। যদি এমন কোন সুযোগ থাকে এবং রমযানের বিশেষ আমলে বিঘ্ন না ঘটে। তবে ইতিপূর্বে যা উল্লেখ করা হয়েছে সেটাকে বিবেচনায় রেখে। অর্থাৎ মূল মনোযোগ হবে ইবাদতে মগ্ন থাকা। নফল আমল, কুরআন তেলাওয়াত, দান-সদকা, বদান্যতা ও মানুষের উপকার ইত্যাদি বেশি বেশি করা। গোটা মাসে এটাই হবে ব্যক্তির করণীয়।
রমযান মাসে ইবাদতের জন্য অবসর হওয়ার পক্ষে আরও যে বিষয়টি উৎসাহ জোগায় তাহলো: রমযান মাসে নেক আমলের সংখ্যা ও মানকে বর্ধিত করা হয়।
বিন বায (রহঃ) বলেন: “রমযানের এই মহান মর্যাদার কারণে রমযানের নেক আমলের রয়েছে মহান মর্যাদা ও বহুগুণ বৃদ্ধি। অন্যদিকে এ মাসে বদ আমলের গুনাহ অন্য মাসের তুলনায় জঘন্য ও বড়। তাই একজন মুসলিমের উচিত এই মাসকে ইবাদত-বন্দেগী ও নেক আমলে কাজে লাগানো এবং বদ আমলগুলো বর্জন করা। আশা করা যায় আল্লাহ্ তাআলা তার আমলগুলো কবুল করে নিয়ে তার প্রতি অনুগ্রহ করবেন এবং তাকে সত্যের উপর অবিচল থাকার তাওফিক দিবেন। কিন্তু বদ আমল সবসময় সম সংখ্যায় থাকে। এর সংখ্যা বাড়ানো হয় না। না রমযানে; আর না অন্য সময়ে। অন্যদিকে নেক আমলের সংখ্যা দশগুণ থেকে বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়।”[ফাতাওয়া বিন বায (১৫/৪৪৭) থেকে সমাপ্ত]
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।