রবিবার 21 জুমাদাল ছানী 1446 - 22 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা ও তার পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার পদ্ধতি

প্রশ্ন

আমার বাবা সম্প্রতি হজ্জ করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। আমাদের এখানে প্রচলিত প্রথা হলো মানুষ তাদের সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য আসে। তারপর সবাই হাত তুলে সূরা ফাতিহা পড়ে ও মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করে। আমি জানি এটা জায়েয নয়। এই প্রচলন থেকে দূরে থাকার জন্য আমি অনেক চেষ্টা করেছি। আমার কিছু প্রশ্ন আছে:

  • সমবেদনা জানানোর সময় যা করণীয় ও যা বর্জনীয়?
  • মৃত ব্যক্তিকে বহনের সময় কী বলা উচিত?
  • মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার সময় কী বলা উচিত?
  • মৃত ব্যক্তির নাম দিয়ে কি কবরের উপর কোনো চিহ্ন দেওয়া যাবে?
  • দাফন শেষ করার পরে কোন দোয়া পড়তে হবে?
  • মৃত ব্যক্তির কবরে কিছু পানি রাখা কতটুকু সঠিক?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

জানাযা বহন করা ও অনুসরণ করা আবশ্যক। এটা মুসলিমদের উপর মৃত মুসলিমের অন্যতম অধিকার। যে ব্যক্তি এই আমল করেন তার জন্য বিপুল নেকীর কথা বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি বাড়ি থেকে জানাযায় উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত থাকবে, অন্য বর্ণনায়- যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে নেকীর আশায় নামায পড়া পর্যন্ত কারো লাশ অনুসরণ করবে, সে এক কীরাত্ব সওয়াবের অধিকারী হবে। আর যে ব্যক্তি মৃতের দাফন হয়ে যাওয়া পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে, তার জন্য দুই কীরাত্ব। জিজ্ঞাসা করা হল: দুই কীরাত্ব কী? তিনি বললেন: দুটি বিশাল পর্বত সমতুল্য (সওয়াব)।”[বুখারী, কিতাবুল জানাইয: (১২৪০)]

লাশ অনুসরণের সময় শরীয়তের বিরুদ্ধে যায় এমন কাজ করা জায়েয নেই। যথা: উচ্চৈঃস্বরে কাঁদা, ধূপ নিয়ে অনুসরণ করা। এর সাথে আরো যুক্ত হবে: লাশের সামনে উচ্চৈঃস্বরে যিকির করা। কারণ এটা বিদাত। কাইস ইবন আব্বাদ বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীরা লাশের সামনে উচ্চৈঃস্বরে যিকির করা অপছন্দ করতেন।” কারণ এতে খ্রিষ্টানদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা হয়।

দুই: দাফন:

মুসলিমকে কাফরের সাথে দাফন করা যাবে না। কাফেরকেও মুসলিমের সাথে দাফন করা যাবে না। মুসলিমকে মুসলিমদের কবরস্থানে দাফন করতে হবে।

সুন্নাহ হল মৃত ব্যক্তিকে কবরের পেছন দিক থেকে প্রবেশ করানো। কবরে মৃত ব্যক্তিকে ডান কাতে রাখতে হবে। আর চেহারা কিবলামুখী করতে হবে। যিনি তাকে কবরের বগলী গর্তে রাখবেন তিনি বলবেন: بِسْمِ اللهِ وَعَلَى سُنَّةِ رَسُوْلِ اللهِ أَوْ عَلَى مِلَّةِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ (আল্লাহর নামে, রাসূলের সুন্নাতের উপর অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিল্লাতের উপর।)[সুনানুত তিরমিযী, কিতাবুল জানাইয (৯৬৭), শাইখ আলবানী সহীহু সুনানি আবি দাউদে হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন (৮৩৬)]

কবরের কাছে থাকা ব্যক্তির জন্য কবরের বগলী গর্ত ঢেকে ফেলার পর দুই হাত ভরে তিন মুঠ মাটি কবরে ছিটিয়ে দেওয়া মুস্তাহাব।

দাফন শেষ করার পর কয়েকটি কাজ করা সুন্নাহ:

যমীন থেকে কবর এক বিঘত পরিমাণ উঁচু করা। কবরকে যমীনের সমান সমান না রাখা; যাতে করে কবর হিসেবে চেনা যায় এবং কবরের মর্যাদা রক্ষা করা হয়; অবমাননা না করা হয়। ভূমি থেকে কবরকে এক বিঘত উচু করা হবে। একটা পাথর বা অন্য কিছু দিয়ে চিহ্ন দিতে সমস্যা নেই; যাতে তার পরিবারের কেউ মারা গেলে তার পাশে দাফন করা যায়। কবরের মাটিতে পানি ছিটিয়ে দেয়া; যেন মাটি শক্ত হয়ে থাকে; উড়ে না যায়।

মৃতব্যক্তিকে তালকীন দেয়া যাবে না; কিছু মানুষ যা করে থাকে। বরং কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তার দৃঢ়তার জন্য দোয়া করবে, তার জন্য ক্ষমা চাইবে এবং উপস্থিত লোকদেরকেও এই নির্দেশ দিবে। যেহেতু উসমান বিন আফ্‌ফান রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিসে এসেছে যে, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন: “তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা চাও এবং তার দৃঢ়তার জন্য দোয়া করো। কারণ তাকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”[সুনানে আবি দাউদ, আল-জানাইয (২৮০৪), শাইখ আলবানী তার সহীহু সুনানি আবি দাউদে (২৭৫৮) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]।

কবরের কাছে কুরআন থেকে কিছুই পড়বে না। কারণ এটা বিদাত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সম্মানিত সাহাবীরা এটি করেননি। কবরের উপর কিছু নির্মাণ করা, কবর পাকা করা এবং সেখানে কিছু লেখা হারাম। কারণ জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর পাকা করতে, এর উপর বসতে এবং এর উপর কিছু নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন।”[সহীহ মুসলিম, আল-জানাইয (১৬১০)]। আবু দাউদে আছে: “তিনি কবর পাকা করতে, কবরের উপরে লিখতে এবং কবরকে পদদলিত করতে নিষেধ করেছেন।”[আল-জানাইয (৩২২৬), শাইখ আলবানী সহীহু সুনানি আবি দাউদে (২৭৬৩) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]।

তিন:

মৃতের পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়া শরীয়তসম্মত। আর সান্ত্বনা এমন কিছুর মাধ্যমে দিতে হয় যেটা তাদেরকে প্রবোধ দিবে, তাদের দুঃখ দূর করবে এবং তাদেরকে ধৈর্যধারণের দিকে ধাবিত করবে বলে ধারণা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সান্ত্বনা দেয়া সম্পর্কে যা সাব্যস্ত হয়েছে যদি সেটা তার মনে থাকে তাহলে তা দিয়ে সান্ত্বনা দিবে। অন্যথায় সাধ্যমত যে কোন সুন্দর কথা দিয়ে সান্ত্বনা দিবে; যা দিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল হয় এবং শরীয়তেরও বরখেলাফ না হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে (সান্ত্বনার দোয়া হিসেবে) বর্ণিত হয়েছে: إِنَّ لِلَّهِ مَا أَخَذَ، ‌وَلَهُ ‌مَا ‌أَعْطَى، وَكُلُّ شَيءٍ عِنْدَهُ إِلَى أَجَلٍ مُسَمَّىً فَلْتَصْبِرْ وَلْتَحْتَسِبْ (নিশ্চয় আল্লাহ যা নিয়ে গেছেন সো তো তাঁরই। আর যা কিছু দিয়েছেন সেটাও তাঁরই। তাঁর কাছে সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। কাজেই সবর করুন এবং সওয়াবের আশা করুন।)[বুখারী (১২০৪)]

দুটি বিষয় পরিহার করা আবশ্যক:

১. তাযিয়া তথা সান্ত্বনা দেয়ার জন্য সবাই সমবেত হওয়া; যদিও মানুষদের মাঝে এমন প্রথার প্রচলন থাকে।

২. সান্ত্বনা দিতে আশা ব্যক্তিদের আতিথেয়তার জন্য মৃত ব্যক্তির পরিবারের খাবার প্রস্তুত করা।

বরং সুন্নাহ হল মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য এমন কোন খাবার প্রস্তুত করা যা তাদেরকে পরিতৃপ্ত করবে।

আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ।

আরো জানার জন্য দেখা যেতে পারে: আলবানী রাহিমাহুল্লাহুর ‘আল-জানাইয’ বই এবং শাইখ আল-ফাওযানের ‘আল-মুলাখ্‌খাসুল ফিকহী’ (২১৩-২১৬)।

সূত্র: শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ