আলহামদু লিল্লাহ।.
সান্ত্বনা দেয়া মানে: সমবেদনা জানানো ও সওয়াব প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতিতে ধৈর্য ধারণ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং মৃত ব্যক্তি ও বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা। ফিকাহবিদগণ এভাবেই এর সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন। যেমনটি উল্লেখ করেছেন ইবনে মুফলিহ ‘আল-ফুরু’ গ্রন্থে (২/২২৯)।
নিঃসন্দেহে সান্ত্বনা বিপদগ্রস্তের কষ্ট লাঘব করে, তার দুঃশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করে। এ কারণে শরিয়তে বিপদগ্রস্তকে সান্ত্বনা দেয়া মুস্তাহাব। যার মাধ্যমে নেকী ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে এবং ধৈর্য ধারণ ও তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে পারস্পারিক সহযোগিতা বাস্তবায়িত হয়। সত্য ও ধৈর্যের প্রতি পারস্পারিক উপদেশ দান বাস্তবায়িত হয়।
এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে তাদের বিপদমুসিবতে সান্ত্বনা দিতেন। এখনও মুসলমানেরা একে অপরকে সান্ত্বনা দেয়, একে অপরের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে। সান্ত্বনা দান শরিয়তে অনুমোদিত হওয়া ও মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে আলেমগণ একমত।
ইমাম নববী বলেন: সান্ত্বনা দেয়া মানে— ধৈর্য ধারণ করানো এবং এমন কিছু উল্লেখ করা যা মৃতের পরিবারকে শান্ত করে, তাদের দুঃখকে হালকা করে, তাদের বিপদকে লাঘব করে। এটি মুস্তাহাব। কেননা এতে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ রয়েছে। এবং এটি আল্লাহ্ তাআলার বাণী: “নেকী ও তাকওয়ার কাজে একে অপরকে সহযোগিতা কর” [সূরা মায়িদা, আয়াত: ২] এর নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত।
সান্ত্বনা দেয়ার পক্ষে এটি সর্বাধিক ভাল দলিল। সহিহ হাদিসে সাব্যস্ত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে ততক্ষণ আল্লাহ্ সে বান্দার সাহায্যে থাকেন।”[আল-আযকার (পৃষ্ঠা ১৪৮-১৪৯) থেকে সমাপ্ত]
সান্ত্বনা দান এমন সব কথার মাধ্যমে সাধিত হতে পারে যে কথা বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে শান্ত করবে, ধৈর্যশীল করবে, তাকে আল্লাহ্র কাছে সওয়াবপ্রাপ্তির প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে। শাওকানী বলেন: “প্রত্যেক যা কিছু বিপদগ্রস্তকে ধৈর্যশীল করে তোলে সেটাই হলো সান্ত্বনা দান; সেটা যে কথার মাধ্যমে হোক না কেন। সান্ত্বনাদানকারী এর বদৌলতে হাদিসগুলোতে উল্লেখিত সওয়াব পাবেন।[নাইলুল আওতার (৪/১১৭)]
সান্ত্বনা দেয়ার যে ভাষ্যগুলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে উদ্ধৃত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে:
إنَّ لله ما أَخذَ، ولهُ ما أَعطى، وكل شيءٍ عندَه بَأَجلٍ مسمَّى فاصْبِرْ وَاحْتَسِبْ
(নিশ্চয় আল্লাহ্ যা নিয়েছেন তা নেয়ার অধিকার তার এবং যা দিয়েছেন তা দেয়ার অধিকার তার। তাঁর কাছে প্রত্যেক জিনিসের নির্দিষ্ট আয়ু রয়েছে। সুতরাং তুমি ধৈর্য ধারণ কর ও সওয়াবপ্রাপ্তির নিয়ত কর)।
ইমাম নববী বলেন: সবচেয়ে উত্তম সান্ত্বনা দান হলো যা আমাদের কাছে সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক মেয়ে তার ছেলে বাচ্চা বা মেয়ে বাচ্চার মৃত্যুতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডাকার জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন। তখন তিনি সে লোককে বলেছিলেন: তুমি তার কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জানাও যে, আল্লাহ্ যা নিয়েছেন তা নেয়ার অধিকার তার এবং তিনি যা দিয়েছেন তা দেয়ার অধিকারও তাঁর। এবং তাঁর কাছে সবকিছুর নির্দিষ্ট আয়ু রয়েছে। তুমি তাকে নির্দেশ দাও যাতে করে সে ধৈর্য ধারণ করে ও সওয়াবপ্রাপ্তির নিয়ত করে...। এভাবে সম্পূর্ণ হাদিসটি উল্লেখ করেন।
আমি (ইমাম নববী) বলব: এই হাদিস ইসলামের অন্যতম একটি মহান নীতি। যাতে ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়, শাখা বিষয়, শিষ্টাচার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে; বিপদাপদে, দুশ্চিন্তাতে ও রোগেশোকে ধৈর্য ধারণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
“আল্লাহ্ যা নিয়েছেন তা নেয়ার অধিকার তার” এর মর্ম হচ্ছে: গোটা বিশ্বের মালিক আল্লাহ্ তাআলা। সুতরাং তিনি যা গ্রহণ করেছেন তা তোমাদের মালিকানাধীন নয়। বরং তাঁর মালিকানাধীন; যা তোমাদের কাছে ধার হিসেবে ছিল তিনি সেটাই গ্রহণ করেছেন। আর “তিনি যা দিয়েছেন তা দেয়ার অধিকারও তাঁর”: এর অর্থ হচ্ছে তিনি তোমাদেরকে যা উপহার দিয়েছেন সেটাও তাঁর মালিকানার বাইরে নয়। বরং সেটাও তাঁর মালিকানাধীন; তিনি তাতে যা খুশি করতে পারেন।
“তাঁর কাছে সবকিছুর নির্দিষ্ট আয়ু রয়েছে” এর অর্থ হচ্ছে: সুতরাং ভেঙ্গে পড়ো না। কারণ তিনি যাকে উঠিয়ে নিয়েছেন তার নির্দিষ্ট আয়ু শেষ। এ আয়ুর আগপিছ ঘটা অসম্ভব। সুতরাং এ সব কিছু যদি তোমাদের জানা থাকে তাহলে ধৈর্য ধারণ কর এবং তোমাদের উপর নেমে আসা এই বিপদকে সওয়াবের কারণ মনে কর।[আল-আযকার (পৃষ্ঠা-৫০ থেকে সমাপ্ত]
সান্ত্বনা দেয়ার স্থান ও পদ্ধতি: এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কিছু নেই। সান্ত্বনা দান মসজিদে দেখা করা, রাস্তায় দেখা করা কিংবা কর্মস্থলে দেখা করার মাধ্যমে হতে পারে, টেলিফোনে কথা বলার মাধ্যমে হতে পারে, মেসেজের মাধ্যমে হতে পারে, বাসায় যাওয়ার মাধ্যমে হতে পারে এবং সান্ত্বনা দেয়ার যে সব রীতি মানুষের মাঝে প্রচলিত আছে সেগুলোর মাধ্যমেও হতে পারে।
সান্ত্বনা দেয়ার সময়: মৃতব্যক্তির মৃত্যুর পর থেকে শুরু হয়। দাফনের আগে ও পরে সান্ত্বনা দেয়া মুস্তাহাব। সান্ত্বনা দান তিনদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
শাইখ বিন বায (রহঃ) বলেন:
“সান্ত্বনা দেয়ার নির্দিষ্ট কোন সময় বা নির্দিষ্ট কোন দিন নেই। বরং দাফনের সময় ও দাফনের পর থেকে অনুমোদিত। কঠিন বিপদের ক্ষেত্রে অবিলম্বে সান্ত্বনা দেয়াটা উত্তম। মৃতব্যক্তির মৃত্যুর তিনদিন পরেও সান্ত্বনা দেয়া জায়েয; যেহেতু সময় নির্দিষ্ট করণের পক্ষে কোন দলিল নেই।”[ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা (২/৪৩) থেকে সমাপ্ত]
স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্রে (৯/১৩৪) এসেছে: “সান্ত্বনা দেয়ার নির্দিষ্ট কোন সময় ও স্থান নেই।”[সমাপ্ত]
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।