রবিবার 21 জুমাদাল ছানী 1446 - 22 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

আমি কিভাবে অলসতা থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং ইউনিভার্সিটির পড়াশুনায় শ্রেষ্ঠ হতে পারি?

প্রশ্ন

আমি এমন একজন যুবক যে সদ্য ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশ করেছে। কিন্তু আমি অলস, অকর্মন্য ও অ-নিয়মানুবর্তী। আমি সময়ের গুরুত্ব দিই না। আমি ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হতে চাই। কারণ সেকেন্ড ইয়ারে এমন একটি সাবজেক্ট আছে যাতে কেবল মাত্র প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের ফাস্টবয়কে কবুল করা হয়। সিরিয়াসলি আমি এই সাবজেক্টে ভর্তি হতে আগ্রহী। দয়া করে এমন কিছু পদক্ষেপ উপস্থাপন করুন যাতে করে আমি সে আশা বাস্তবায়ন করতে পারি। 

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

প্রিয় ভাই,

অলসতা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা; যা মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলকাম ও উত্তীর্ণ হতে বাধাগ্রস্ত করে। এটি বিধ্বংসী রোগ; যা মানবাত্মাকে আক্রমণ করে, সংকল্পকে দুর্বল করে দেয়, কল্যাণকর কোন কর্মে অগ্রসর হওয়া থেকে বাধা দেয়। এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অলসতা থেকে আল্লাহ্‌র কাছে বেশি বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন:

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الكَسَلِ وَالهَرَمِ، وَالمَأْثَمِ وَالمَغْرَمِ، وَمِنْ فِتْنَةِ القَبْرِ وَعَذَابِ القَبْرِ، وَمِنْ فِتْنَةِ النَّارِ وَعَذَابِ النَّارِ، وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الغِنَى، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الفَقْرِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ المَسِيحِ الدَّجَّالِ ...

(হে আল্লাহ্‌! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি অলসতা থেকে, বার্ধক্য থেকে, পাপ থেকে, ঋণ থেকে, কবরের পরীক্ষা ও কবরের আযাব থেকে, আগুনের ফিতনা ও আগুনের আযাব থেকে, ধনাঢ্যের মন্দ পরীক্ষা ও দারিদ্রের পরীক্ষা থেকে এবং আপনার কাছে আশ্রয় চাই মসীহ দাজ্জালের পরীক্ষা থেকে।)[সহিহ বুখারী (৬৩৬৮) ও সহিহ মুসলিম (৫৮৯)]

আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু তালহাকে বললেন: “তোমাদের বালকদের মধ্য থেকে আমার খেদমত করার জন্য একজন বালক সন্ধান কর। তখন আবু তালহা আমাকে তার বাহনের পিছনে চড়িয়ে নিয়ে এলেন। যখনই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাত্রা বিরতি করতেন আমি তাঁর সেবা করতাম। সে সময় আমি তাঁকে বেশি বেশি বলতে শুনেছি:

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الهَمِّ وَالحَزَنِ، وَالعَجْزِ وَالكَسَلِ، وَالبُخْلِ وَالجُبْنِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ

(হে আল্লাহ্‌! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুশ্চিন্তা থেকে, দুঃখ থেকে, অক্ষমতা থেকে, অলসতা থেকে, কৃপণতা থেকে, ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার থেকে এবং লোকদের হেনস্থা থেকে।)”[সহিহ বুখারী (৫৪২৫)]

আব্দুল্লাহ্‌বিন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সন্ধ্যায় উপনীত হতেন তখন বলতেন:

أَمْسَيْنَا وَأَمْسَى الْمُلْكُ لِلَّهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ

(আমরা সন্ধ্যায় উপনীত হয়েছি এমতাবস্থায় যে, সমস্ত রাজত্ব ও সমুদয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য। এক আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। তাঁর কোনো শরীক নেই।) হাসান বলেন: যুবাইদ আমার কাছে হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ইব্রাহিম থেকে এ হাদিসটিতে আরও মুখস্ত করেছেন:

لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، اللهُمَّ! أَسْأَلُكَ خَيْرَ هَذِهِ اللَّيْلَةِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ هَذِهِ اللَّيْلَةِ، وَشَرِّ مَا بَعْدَهَا، اللهُمَّ! إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْكَسَلِ وَسُوءِ الْكِبَرِ، اللهُمَّ! إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابٍ فِي النَّارِ وَعَذَابٍ فِي الْقَبْرِ

(রাজত্ব তাঁরই। প্রশংসা তাঁরই। আর তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। হে আল্লাহ্‌! আমি এ রাতের কল্যাণ আপনার কাছে প্রার্থনা করছি এবং এ রাতের ও এর পরবর্তীর অকল্যাণ থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। হে আল্লাহ্‌! আমি আপনার কাছে অলসতা ও বার্ধক্যের মন্দ অবস্থা থেকে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ্‌! আমি আপনার কাছে জাহান্নামের যে কোন শাস্তি ও কবরের যে কোন শাস্তি থেকে আশ্রয় চাই।)[সহিহ মুসলিম (২৭২৩)]

প্রিয় ভাই, এই ভয়ানক রোগ থেকে মুক্তির জন্য আমরা আপনাকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অনুসরণ করার পরামর্শ দিচ্ছি:

এক:

আপনার উপর আবশ্যক এ বিশ্বাস করা যে, সবকিছু আল্লাহ্‌র হাতে। তাই আপনার কর্তব্য আল্লাহ্‌র কাছে ধর্ণা দেয়া, অধিক হারে দোয়া করা, বারংবার দোয়া করা; বিশেষতঃ দোয়া কবুলের সময়গুলোতে। দোয়া কবুলের সময়গুলো জানতে 22438 নং প্রশ্নোত্তরটি পড়ুন।

দুই:

আপনার কর্তব্য নিজেকে বেশি বেশি এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা স্বল্প একটি সময়। অতি দ্রুত তা ফুরিয়ে যাবে। এর কষ্ট ও আরাম, দুঃখ ও আনন্দ পার হয়ে যাবে। কেবল রেজাল্ট ও কর্মফল ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। তাই আপনার উচিত লাস্ট ইয়ারে পরিশ্রমী ছাত্রের যে আনন্দ ও নিজের প্রতি তার যে সন্তুষ্টি সে দৃশ্যটি সর্বদা কল্পনা করা; যখন সে তার পরিশ্রমের ফলাফল নিয়ে বাড়ী ফিরে এবং অবহেলাকারীর আফসোসকে কল্পনা করা; যখন সে দুঃখিত ও ভারাক্রান্ত চিত্তে তার পরিবারের কাছে ফিরে আসে।

পরিণতি কল্পনা করা কর্মোদ্যম ও চঞ্চলতা অর্জন এবং নির্জীবতা ও অলসতা ত্যাগের সবচেয়ে বড় প্রণোদনা। এই গূঢ় রহস্যের কারণে আমরা কুরআন-সুন্নাহতে অসংখ্য দলিল দেখতে পাই যেগুলো জান্নাতে নেককারদের অবস্থা ও মর্যাদা নিয়ে আলোচনা করে এবং জাহান্নামে পাপীদের দুরবস্থা ও বেইজ্জতি নিয়ে আলোচনা করে।

তিন:

আপনার কর্তব্য বর্তমান মূহুর্তকে অবহেলা না করা। তা করলে দীর্ঘসূত্রতা (করছি করব ভাব) আপনাকে পেয়ে বসবে। তখন আপনি এই মূহূর্তে আপনার অবস্থার দিকে না তাকিয়ে ভাববেন যে, এখনও সময় আছে। শীঘ্রই কাল বা পরশু কিংবা পরীক্ষা কাছে আসলে আপনি পড়বেন। কারণ দীর্ঘসূত্রতা অলসতা এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কাজে কালক্ষেপণের কারণ।

ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন:

“দীর্ঘসূত্রতা থেকে ইবাদতে অলসতা ও তওবাতে গড়িমসি জন্ম নেয়।”[ফাতহুল বারী (১১/২৩৭) থেকে সমাপ্ত]

যখনই আপনি পড়াশুনা করার সুযোগ পান তখনই আপনি এ কথা চিন্তা করুন যে, এ সুযোগ হয়তো পুনরায় পাবেন না। হতে পারে নানা ব্যস্ততা কিংবা নানা প্রতিবন্ধকতা আপনার উপর ঝেঁকে বসবে; যার কারণে আপনি পড়াশুনা করতে পারবেন না। তাই কর্তব্য হচ্ছে প্রতিটি উপযুক্ত সুযোগকে কাজে লাগানো।

চার:

যারা বেশি বেশি ঠাট্টা-মশকরা ও খেল-তামাশায় ব্যতিব্যস্ত থাকে তাদের সঙ্গ এড়িয়ে চলুন। পরিশ্রমী ও সিরিয়াস এমন ভাল ছাত্রদের সাথে চলাফেরা করুন। পরিশ্রমী ছাত্রদের সাথে চললে আপনি কয়েক দিক থেকে উপকৃত হবেন। যেমন আপনি তাদের অনুকরণ করে পরিশ্রমী হবেন। তারা কিভাবে পড়াশুনা করে আপনি তাদের থেকে সে সব অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবেন। তাছাড়া তাদের জ্ঞান থেকেও আপনি উপকৃত হতে পারবেন।

পাঁচ:

কখনও কখনও অলসতা ও উদাসীনতা কিছু রোগ-বিমারের আলামত হতে থাকে। তাই আপনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফুল-বডি মেডিকেল চেক-আপ করাতে পারেন।

ছয়:

ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন: ভাল ঘ্রাণ যেহেতু রূহের খাদ্য, আর রূহ হচ্ছে শক্তির বাহন। সুগন্ধির মাধ্যমে শক্তি বাড়ে। এটি মস্তিস্ক, হৃৎপিণ্ড, দেহের অভ্যন্তরীণ অন্যান্য অঙ্গের উপকার করে, অন্তরকে প্রফুল্ল করে, আত্মাকে আনন্দিত করে, রূহকে প্রসন্ন করে। এটি রূহের বিশ্বস্ত বন্ধু, রূহের সাথে তীব্র সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং রূহের সাথে রয়েছে এর ঘনিষ্ট সম্পর্ক। তাই সর্বোত্তম মানুষের কাছে সুগন্ধি ছিল দুনিয়ার প্রিয় জিনিসগুলোর মধ্যে অন্যতম।

সহিহ বুখারীতে এসেছে: “তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনও সুগন্ধি ফিরিয়ে দিতেন না।”

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে সহিহ মুসলিমে এসেছে, “কারো কাছে যদি রাইহান (একপ্রকার সুগন্ধ গুল্ম) পেশ করা হয় সে যেন তা ফিরিয়ে না দেয়। কেননা এর ঘ্রাণ ভাল এবং বহনে হালকা।”[যাদুল মাআদ (৪/২৫৬) থেকে সমাপ্ত]

সাত:

নিয়মিত ব্যায়াম করুন। অলসতা দূরীকরণে ব্যায়ামের উপকার প্রতিষ্ঠিত ও পরীক্ষিত বিষয়।

আট:

যে বইগুলো এ বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে আমরা আপনাকে এমন কিছু বই পড়ার পরামর্শ দিচ্ছি। যেমন- ‘আল-হারবু আলাল কাসাল’, লেখক: খালেদ আবু শাদি, ‘আজযুছ ছিক্বাত’ লেখক: মুহাম্মদ মুসা আশ-শরীফ, ‘আল-হাওরু বা’দাল কাওর’ লেখক: দারওয়িশ, ‘আল-ফুতুর’ লেখক: নাসের আল-উমর।

অনুরূপভাবে নিয়মিত আলেমদের ও সৎ লোকদের জীবনী পড়ুন। তাঁদের জীবনীতে সময়ের মূল্যের উপদেশ রয়েছে এবং এমন গ্রন্থগুলোতে আপনি পরিশ্রমের উত্তম আদর্শ পাবেন। উদাহরণ স্বরূপ শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রচিত ‘ক্বিমাতুয যামান ইনদাল উলামা’। 

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব