মঙ্গলবার 22 যুলক্বদ 1446 - 20 মে 2025
বাংলা

শিশুর প্রতিপালন কখন শেষ হয়, শেষ হওয়ার পর সন্তানদের খরচ কে বহন করবে?

প্রশ্ন

কোন বয়স পর্যন্ত একজন শিশু বা কিশোরের প্রতিপালন প্রয়োজন হয়? মায়ের বিয়ে হওয়ার পরও কি দুগ্ধপোষ্য শিশু তার মায়ের সাথে থাকতে পারবে? সন্তানদের প্রতিপালন শেষ হওয়ার পরও কি মায়ের উপর তাদের ব্যয়ভার বহন করা আবশ্যক? যেমন: তাদের জন্য বাড়ি কিনে দেওয়া ও তাদের জন্য ব্যয় করা? আর যদি মেয়ে হয়, তাহলে তার প্রতিপালন শেষ হওয়ার পর থেকে শুরু করে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত কে তার খরচ বহন করবে?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

বিবাহ বন্ধন টিকে থাকলে সন্তান প্রতিপালন স্বামী-স্ত্রীর যৌথ অধিকার। তালাক হয়ে গেলে সন্তান প্রতিপালনের অধিকার মায়ের।

শারহুল খিরাশী বইয়ের (৪/২০৭) টীকায় মালেকী আলেম আল-আদাওয়ী বলেন: ‘মায়ের যদি তালাক হয়ে যায় কিংবা তার স্বামী মারা যায়, তাহলে মা-ই তার প্রতিপালন করবে। আর যদি সে স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, তাহলে উভয়ের অধিকার।’[সমাপ্ত]

আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা (১৭/৩০১) বইয়ে বর্ণিত হয়েছে: “যদি বিবাহ বলবৎ থাকে তাহলে সন্তান প্রতিপালন বাবা-মা উভয়ের অধিকার। তারা পৃথক হয়ে গেলে সর্বসম্মতিক্রমে এটি সন্তানের মায়ের অধিকার।”[সমাপ্ত]

দুই:

মা যদি অন্য কোথাও বিবাহ না করে তাহলে সাত বছর বয়স পর্যন্ত সন্তানদের প্রতিপালনের অধিকার মায়ের। কারণ আহমদ (৬৭০৭) ও আবু দাউদ (২২৭৬) বর্ণনা করেন: এক মহিলা বললেন: “হে আল্লাহর রাসূল! আমার পেট ছিল আমার এই ছেলের অবস্থানস্থল, আমার স্তনদ্বয় ছিল তার জন্য মশক, আমার কোলই ছিল তার আশ্রয়স্থল। তার বাবা আমাকে তালাক দিয়েছে এবং আমার কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নেয়ার ইচ্ছা করছে।” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ নারীকে বললেন: “তুমিই এ সন্তানের (পালনের) অধিক হকদার; যতক্ষণ না তুমি অন্য স্বামী গ্রহণ করবে।”[শাইখ আলবানী তার সহীহু আবি দাউদে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন]

মা যদি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তাহলে পরবর্তী অভিভাবকের কাছে প্রতিপালনের অধিকার চলে যাবে। এ নিয়ে ফকীহদের মাঝে মতভেদ রয়েছে:

কেউ কেউ মনে করেন: এটি মায়ের মায়ের (নানীর) কাছে চলে যাবে। এটি চার মাযহাবের অধিকাংশ আলেমের মত।

কেউ কেউ মনে করেন: এটি বাবার কাছে চলে যাবে। এটি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা ও ইবনুল কাইয়্যিমের মত।[দেখুন: আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা (১৭/৩০২), আশ-শারহুল মুমতি (১৩/৫৩৫)]

আমরা যদি বলি সন্তান প্রতিপালনের অধিকার শিশুর বাবার কাছে চলে যাবে তাহলে যদি সন্তানের পিতা অন্য পুরুষের সাথে বিবাহিত মায়ের সাথে সন্তানকে থাকার অনুমতি দেয়, শিশুর মা তার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয় এবং দ্বিতীয় স্বামীও এতে রাজী থাকে: তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই।

অনুরূপভাবে মায়ের মা (শিশুর নানী) অন্যত্র বিবাহিত মেয়ের জন্য নিজের অভিভাবকত্বের অধিকার ছেড়ে দিতে পারেন।

শাইখ ইবনে উছাইমীন বলেন: ‘প্রতিপালন করা অভিভাবকের অধিকার; তার দায়িত্ব নয়। সুতরাং সে যদি তার নীচের স্তরের অভিভাবকের জন্য এই অধিকার ছেড়ে দেয় তাহলে সেটি করা জায়েয।’[আশ-শারহুল মুমতি (১৩/৫৩৬) থেকে সমাপ্ত]

তিন:

মহিলা যদি বিয়ে না করে এবং সন্তানের বয়স সাত বছরে পৌঁছে:

১- তাহলে সে ছেলে হলে তাকে বাবা ও মায়ের মাঝে বাছাই করার সুযোগ প্রদান করা হবে। সে যাকে বাছাই করবে তার কাছে থাকবে। এর প্রমাণ হলো: নাসাঈ (৩৪৯৬) ও আবু দাউদ (২২৭৭) বর্ণনা করেন: আবু হুরাইরা বলেন: এক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসল। তখন আমি তাঁর কাছে বসেছিলাম। মহিলা বলল: ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার স্বামী আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে চান। এই ছেলে আবু ইনাবার কুয়া থেকে আমাকে পানি এনে পান করাচ্ছে ও আমার উপকার করছে।’ তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমরা এই ছেলের ব্যাপারে লটারি কর। তখন স্বামী বলল: আমার ছেলের ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি অধিকারী কে? তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ইনি তোমার বাবা, আর ইনি তোমার মা। তুমি তাদের দুইজনের যে কোন একজনের হাত ধরো। ছেলেটি তার মায়ের হাত ধরলো। অবশেষে তার মা তাকে নিয়ে চলে গেল।[হাদীসটিকে শাইখ আলবানী সহীহু আবি দাউদে সহিহ বলে গণ্য করেছেন]

হাম্বলী ও শাফেয়ী মাযহাবের আলেমগণ এই মত পোষণ করেন।

২- আর যদি মেয়ে হয় তাহলে শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহুর মতে তাকেও বাছাই করার সুযোগ প্রদান করা হবে।

আর আবু হানীফা বলেন: মেয়ের বিয়ে হওয়া অথবা ঋতুস্রাব হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মা তার হকদার। মালেক বলেন: বিয়ে করে স্বামী তাকে নিয়ে নির্জনবাস করার আগ পর্যন্ত তার অধিকার মায়ের। আহমদ বলেন: বাবা তার হকদার। কারণ বাবা তাকে রক্ষণাবেক্ষণের অধিক সক্ষমতা রাখেন।[দেখুন: আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা: (১৭/৩১৪-৩১৭)]

চার:

সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া ও বুঝ-বিচার সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে প্রতিপালন সমাপ্ত হবে। তখন সে বাবা-মায়ের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকে বাছাই করে নিবে। সে ছেলে হলে তাদের থেকে আলাদাও হয়ে যেতে পারবে।

ইবনে কুদামা রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “কেবলমাত্র শিশু ও নির্বোধের জন্যই প্রতিপালন সাব্যস্ত হবে। প্রাপ্তবয়স্ক বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্য প্রতিপালন নেই। সে তার বাবা-মায়ের মধ্যে যার কাছে ইচ্ছা থাকতে পারবে। সে যদি পুরুষ হয় তাহলে তাদের উপর নির্ভরশীলতায় না থেকে একা থাকতে পারবে। তবে মুস্তাহাব হলো, তাদের থেকে আলাদা না হওয়া এবং তাদের প্রতি সদাচরণ বন্ধ না করা।

আর যদি মেয়ে হয় তাহলে সে পৃথক হতে পারবে না। তার বাবা তাকে এমনটি করতে বাধা দেয়ার অধিকার রাখেন। কারণ মেয়ের কাছে যে কেউ প্রবেশ করে তাকে নষ্ট করতে পারে এবং সে নিজের জন্য ও তার পরিবারের জন্য কলঙ্ক বয়ে আনতে পারে। আর যদি তার বাবা না থাকে, তাহলে তার অভিভাবক ও পরিবার চাইলে তাকে বাধা দেয়ার অধিকার রাখেন।”[সমাপ্ত][আল-মুগনী (৮/১৯১)]

পাঁচ:

প্রতিপালনকালীন সময়ে সন্তানদের খরচ বহন করা তাদের বাবার উপর আবশ্যক। তারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া ও বুদ্ধি-বিচার সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে প্রতিপালন সমাপ্ত হলে তখন তাদের খরচ বহন করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে ফকীহদের মাঝে মতভেদ আছে।

প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে যদি দরিদ্র হয় তাহলে ধনী বাবার উপর তার খরচ বহন করা ওয়াজিব। যদি সে না পারে তাহলে তার ধনী মাকে খরচ বহন করতে হবে। এটি হাম্বলীদের মত, ছেলে সুস্থ হোক কিংবা অক্ষম হোক।

আর শাফেয়ীদের মতে ছেলে অসুস্থতা অথবা দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে অক্ষম হলে তার খরচ বহন করা ওয়াজিব।

আল-ইনসাফ (৯/২৪৯) বইয়ে আছে: ‘তার সন্তানেরা যত নিচে পর্যন্ত হোক না কেন: এর  অন্তর্ভুক্ত হবে সুস্থ সবল বড় ছেলেরা, যদি তারা দরিদ্র হয়। এটি সঠিক মত। আর এটি (হাম্বলি) মাযহাবের একক মত।’[সমাপ্ত]

ইবনু কুদামা বলেন: ‘শাফেয়ী বলেন: সন্তানের মাঝে ঘাটতি থাকতে হবে, হতে পারে সেটি হুকুমের দিক থেকে কিংবা শারীরিক গঠনে। আবু হানীফা বলেন: বালেগ না হওয়া পর্যন্ত সন্তানের জন্য ব্যয় করতে হবে। সুস্থ অবস্থায় সে যদি বালেগ হয়ে যায়, তাহলে তার ব্যয় বহনের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে। আর মেয়ে সন্তানকে বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তার খরচ বহনের দায়িত্ব বাতিল হবে না।

মালেকও অনুরূপ বলেন। তবে তিনি বলেন: বিয়ে করে স্বামীর সাথে নির্জনবাস করার আগ পর্যন্ত মেয়ের খরচ বহন করতে হবে। তারপর তাদের খরচ বহন করা হবে না; যদিও তাদের তালাক হয়ে যায়। আর যদি নির্জনবাসের আগে তালাক হয়ে যায় তাহলে তাদের খরচ বহন করতে হবে।

আমাদের প্রমাণ হলো: হিন্দকে উদ্দেশ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য: ‘তুমি নিজের জন্য ও তোমার সন্তানের জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে নাও।’ এখানে তিনি সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে আলাদা করেননি। আর যেহেতু সে দরিদ্র ছেলে, সেহেতু সে ধনী পিতার খরচ পাওয়ার অধিকার রাখে। ঠিক যেমনিভাবে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা অন্ধ হলে সে খরচ পাওয়ার অধিকার রাখে।’[সমাপ্ত][আল-মুগনী (৯/২৫৮)]

এর থেকে বোঝা গেল যে, প্রতিপালন সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পর বাবা যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ মাকে তার সন্তানদের জন্য খরচ করতে হবে না। বাড়ি কেনা হোক কিংবা অন্য কিছুর মাধ্যমে হোক। আর মেয়ের বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত খরচের দায়িত্ব তার বাবার।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব