আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
বৈধ কাজের মূলনীতি হলো: এটি বৈধ ক্ষেত্রে হওয়া এবং এর দ্বারা হারাম কাজে সহায়তা না করা।
এতে অন্তর্ভুক্ত হবে সকল বৈধ বিক্রি ও ভাড়া। যেমন: খাদ্য, ঔষধ, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি বিক্রি করা। আরো অন্তর্ভুক্ত হবে শিক্ষকতা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, বিদ্যুৎ বিভাগ, ছুতারগিরি, কারিগরিসহ অগণিত বৈধ চাকুরি।
আর হারাম কাজের উদাহরণ হলো: সুদী ব্যাংকে চাকুরি করা, ব্যবসায়িক বীমা কোম্পানিতে চাকুরি করা, মদ বহন করা, শূকর পালন করা, সুদ লেখা, জুয়ার হল প্রস্তুত করা, অথবা যা হারামে ব্যবহৃত হওয়ার প্রবল ধারণা হয় তা বিক্রি করা; যেমন: ডাকাতের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা, প্রভৃতি যা কিছু হারামে লিপ্ত হওয়া কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হারামে সহায়তা করা।
পক্ষান্তরে পাপে সাহায্য করার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও দূরবর্তী সাহায্য হয় তাহলে হারাম হবে না। যেমন: কাফের, সুদখোর কিংবা জুয়াখোর ব্যক্তির কাছে বৈধ খাবার বিক্রি করা। এক্ষেত্রে বলা যাবে না যে: সে এই খাবার খেয়ে পাপ কাজ করার শক্তি পাচ্ছে। যদি দূরতম সাহায্য হারাম হত তাহলে মানুষের জন্য সামান্য কিছু ছাড়া আর কোনো বৈধ কাজই থাকবে না।
তাই সাহাবীরা ইহুদিদের সাথে কেনাবেচা, ভাড়া প্রদানসহ অন্যান্য লেনদেন করতেন। তারা এই বিষয়টি বিবেচনা করেননি ইহুদীরা এই সমস্ত অর্থ এবং কাজ দ্বারা উপকৃত হচ্ছে।
যেহেতু মৌলিকভাবে কাজটি বৈধ এবং এর মাধ্যমে সরাসরি হারামে সহায়তা করা হয় না: তাই সেটি জায়েয।
চাকুরি বৈধ হওয়া বা হারাম হওয়ার ব্যাপারে এ মূলনীতিটি উল্লেখ করা যেতে পারে।
পূর্বোক্ত আলোচনার আলোকে: যদি কোনো রুটিঘরে হালাল রুটি বিক্রি করার পাশাপাশি মদের সাথে মিশ্রিত হারাম রুটিও বিক্রি করা হয়, কিন্তু কোন কর্মচারীর কাজ কেবল হালাল রুটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং সে যদি কোনোভাবে হারামে সহায়তা না করে; তাহলে সে ব্যক্তির এই চাকুরী করাটা তীব্র প্রয়োজন হলে চাকুরিটি করা তার জন্য জায়েয হবে। তবে তার উচিত অন্য চাকুরি খুঁজতে থাকা। কারণ সে মন্দ কাজের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় এতে বাধা প্রদান করা তার উপর আবশ্যক হয়ে যায়। কিন্তু, সে হয়তো সেটা করতে পারবে না। তখন এই স্থান ত্যাগ করা তার উপর অনিবার্য। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذاً مِثْلُهُمْ إِنَّ اللَّهَ جَامِعُ الْمُنَافِقِينَ وَالْكَافِرِينَ فِي جَهَنَّمَ جَمِيعاً
“তিনি তো কিতাবে ইতিমধ্যেই তোমাদেরকে বলে দিয়েছেন যে, তোমরা যখন আল্লাহর আয়াতসমূহকে অমান্য ও বিদ্রূপ করতে শুনবে তখন তোমরা তাদের সাথে (অমান্যকারী ও বিদ্রূপকারীদের সাথে) বসবে না, যতক্ষণ না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়। তাহলে (তাদের সাথে বসলে) তোমরাও তাদের মতোই হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুনাফিক ও কাফেরদের সকলকে জাহান্নামে একত্র করবেন।”[সূরা নিসা: ১৪০]
জাস্সাস তার ‘আহকামুল কুরআন’ (২/৪০৭) বইয়ে বলেন: “এই আয়াতে প্রমাণ রয়েছে যে মন্দকাজে লিপ্ত ব্যক্তিকে বাধা দেওয়া আবশ্যক। বাধা দেয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে ঘৃণা প্রকাশ করা, মন্দকাজে লিপ্ত ব্যক্তির সাথে উঠাবসা পরিত্যাগ করা এবং মন্দ কাজ থেকে সরে না আসা পর্যন্ত তাকে বর্জন করা; যদি মন্দ কাজকে একেবারে দূর করা নাও যায়।”[সমাপ্ত]
শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: যে সমস্ত স্বর্ণের দোকানের মালিকেরা হারাম লেনদেন করে— সেটা সুদী লেনদেন হোক, হারাম কলা-কৌশল হোক, প্রতারণা হোক অথবা অন্য যে সব লেনদেন শরিয়তে অবৈধ— এমন দোকানে চাকুরি করার বিধান কী?
তিনি উত্তর দেন: ‘সুদ কিংবা প্রতারণা কিংবা এ ধরনের হারামে লিপ্ত ব্যক্তিদের কাছে চাকুরি করা হারাম। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন: “তোমরা পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অপরকে সহযোগিতা করবে না।”[সূরা মায়েদা: ২] তিনি আরো বলেন: “তিনি তো কিতাবে ইতিমধ্যেই তোমাদেরকে বলে দিয়েছেন যে, তোমরা যখন আল্লাহর আয়াতসমূহকে অমান্য ও বিদ্রূপ করতে শুনবে তখন তোমরা তাদের সাথে (অমান্যকারী ও বিদ্রূপকারীদের সাথে) বসবে না যতক্ষণ না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়। তাহলে (তাদের সাথে বসলে) তোমরাও তাদের মতোই হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুনাফিক ও কাফেরদের সকলকে জাহান্নামে একত্র করবেন।”[সূরা নিসা: ১৪০]
আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি কোনো মন্দ দেখতে পায় সে যেন হাত দিয়ে সেটি প্রতিহত করে। যদি সেটি না পারে তাহলে মুখ দিয়ে করবে। যদি সেটি না পারে তাহলে অন্তর দিয়ে করবে।” আর সেখানে থাকা কর্মচারী তার হাত, মুখ বা অন্তর কোনোটি দিয়ে মন্দকে বাধা দিতে পারে না। ফলে সে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য বলে গণ্য হবে।’[সমাপ্ত][ফিকহ ওয়া-ফাতাওয়াল বুয়ূ (পৃ. ৩৯২)]
তাই আপনার বন্ধুকে এমন অন্য চাকুরি খুঁজতে হবে যেখানে সে মন্দ দেখা থেকে বেঁচে থাকে।
যেহেতু সে শূকরের কাছে যায় না, কোনোভাবে হারামে সাহায্য করে না সেহেতু তার বেতন হালাল। কারণ সে বৈধ রুটি বানানোর বিনিময়ে এটি নিচ্ছে। কিন্তু মন্দ কাজে বাধা না দেওয়ার কারণে সে পাপী হবে। আর এ কারণেই তাকে অন্য চাকুরি খুঁজতে হবে।
সুতরাং আপনি জানতে পারলেন যে আপনার জন্য তার খাবার খাওয়া ও তার উপহার গ্রহণ করতে কোনো আপত্তি নেই। কারণ তার বেতন হালাল।
দুই:
ব্যবসা বীমা কোম্পানিগুলোতে চাকুরি করা হারাম। কারণ ব্যবসার বীমা সুদ ও জুয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত; যেমনটি আমরা (130761) ও (205100) নং প্রশ্নের উত্তরে বর্ণনা করেছি।
কিন্তু হারাম উপার্জিত অর্থ কেবল উপার্জনকারীর জন্য হারাম। অন্য কেউ তার কাছ থেকে বৈধ উপায়ে গ্রহণ করলে তাতে আপত্তি নেই। যেমন: উপহার, খরচ প্রভৃতি।
সুতরাং যে ব্যক্তি হারাম বীমায় চাকুরি করে তার থেকে কিছু খেতে কিংবা তার সম্পদ থেকে কিছু গ্রহণ করতে আপত্তি নেই।
তিন:
হালাল রিযিকের দরজা অনেক। কিন্তু এর খোঁজে অনুসন্ধান ও পরিশ্রম প্রয়োজন। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে, আল্লাহ তাকে রিযিক প্রদান করেন ও সাহায্য করেন। যেমনটি আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجاً وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْراً
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য (সংকট থেকে) বের হওয়ার পথ করে দিবেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিযিকের ব্যবস্থা করবেন যা সে ধারণাও করে না।”[সূরা তালাক: ২, ৩]
সুতরাং আপনি এমন হালাল কাজের খোঁজে চেষ্টা অব্যাহত রাখুন, যেখানে নারী-পুরুষের মিশ্রণ নেই এবং যা মন্দ কিছু দেখা থেকে মুক্ত। এক্ষেত্রে পরহেজগারিতা প্রশংসিত। যে ব্যক্তি সংশয়পূর্ণ বিষয়াবলি থেকে বেঁচে থাকে সে নিজের দ্বীন ও ইজ্জতকে রক্ষা করে। আর যে ব্যক্তি সংশয়পূর্ণ বিষয়ে লিপ্ত হয়ে পড়ে সে হারামে জড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি সন্দিহান বিষয় হতে নিজেকে রক্ষা করেছে সে নিজের দ্বীনকে পবিত্র করেছে এবং নিজের ইজ্জতকেও রক্ষা করেছে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে পতিত হয়েছে সে হারামে পতিত হয়েছে। তার অবস্থা সেই রাখালের মত যে নিষিদ্ধ চারণ ভূমির চারপাশে (গবাদি) চরায়, আর সর্বদা এ আশঙ্কায় থাকে যে, যে-কোন সময় কোন পশু নিষিদ্ধ চারণ ভূমিতে প্রবেশ করে চরতে আরম্ভ করবে।”[হাদীসটি বুখারী (৫২) ও মুসলিম (১৫৯৯) বর্ণনা করেন]
তিনি আরো বলেন: “সন্দেহযুক্ত বিষয় বর্জন করে সন্দেহমুক্ত বিষয় গ্রহণ কর।”[হাদীসটি তিরমিযী (২৫১৮) ও নাসাঈ (৫৭১১) বর্ণনা করেন। তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ। শাইখ আলবানী সহীহুত তিরমিযীতে এটিকে সহীহ বলেছেন]
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।