Table Of Contents
জান্নাত ও জাহান্নামের সংখ্যা কত?
সংখ্যার দিক থেকে জাহান্নাম একটি। জান্নাতও একটি। কিন্তু প্রত্যেকটির স্তরভেদ ও শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। সুন্নাহতে ‘জান্নাত’ শব্দটি বহুবচন হিসেবে উদ্ধৃত হয়েছে। সেখানে জান্নাতের বহুত্ব উদ্দেশ্য নয়; বরং জান্নাতের মাহাত্ম্য, স্তরসমূহ ও প্রকারভেদ কিংবা জান্নাতে প্রবেশকারী ব্যক্তির নেকীর বিপুলতার দিকে ইঙ্গিত করা; যেমনটি আনাস ইবনে মালেক থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে: উম্মে রবী বিনতে বারা তথা উম্মে হারেসা ইবনে সুরাকা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন: ‘আল্লাহর নবী! আমাকে কি হারেসা সম্পর্কে বলবেন না?’ হারেসা বদরের যুদ্ধে অজ্ঞাত তীরের আঘাতে শহীদ হয়েছিল। ‘সে যদি জান্নাতবাসী হয় তাহলে আমি ধৈর্য ধরব। আর যদি অন্য কিছু হয় তাহলে তার জন্য বেশি করে কাঁদব।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন: “হারেসার মা! জান্নাতে নানান প্রকারের জান্নাত আছে। অন্য বর্ণনায়: জান্নাতে বহু জান্নাত আছে। তোমার ছেলে সর্বোচ্চ ফেরদাউস পেয়ে গেছে।”[হাদীসটি বুখারী (২৮০৯) বর্ণনা করেন।
জাহান্নামের নিম্নস্তরসমূহ
দুনিয়াতে কুফরের স্তরভেদ অনুসারে জাহান্নামীদের নিম্নস্তরের তারমত্য হবে। মুনাফিকরা জাহান্নামের সবচেয়ে নিচের স্তরে থাকবে; যেমনটি আমাদের রব বলেছেন:
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرا
“মুনাফিকদের জায়গা হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তুমি তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী পাবে না।”[সূরা নিসা: ১৪৫]
জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে (এর থেকে আমরা আল্লাহর কাছে পানাহ চাই) যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাণীতে ইঙ্গিত করেছেন যা নু’মান ইবনে বশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “জাহান্নামের সবচেয়ে হালকা শাস্তি ভোগকারীর আযাব হবে তার জুতাদ্বয় ও ফিতাদ্বয় আগুনের। অন্য বর্ণনায় রয়েছে: যার দুই পায়ের তলায় জ্বলন্ত দু’টি অঙ্গার রাখা হবে। এতে করে তার মাথার মগজ ফুটতে থাকবে যেভাবে পাতিল ফুটে। সে মনে করবে যে, তার চেয়ে কঠিন আযাব ভোগকারী কে্উ নেই। অথচ তার আযাব সবার চেয়ে হালকা!”[হাদীসটি বুখারী (৬৫৬২) ও মুসলিম (২১২) বর্ণনা করেন] সহিহ মুসলিমের এক বর্ণনায় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে যে এই ব্যক্তি হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আবু তালেব। যেহেতু ইসলামের সূচনালগ্নে ইসলাম রক্ষায় তার ভূমিকা ছিল।
জান্নাতের স্তরসমূহ
জান্নাতের স্তরসমূহের সংখ্যা নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। বলা হয়: এর সংখ্যা কুরআনের আয়াতের সমান। এই মতটি গৃহীত হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত হাদীসে, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “পবিত্র কুরআনের বাহককে (কিয়ামতের দিন) বলা হবে, ‘তুমি কুরআন পড়তে থাক ও উপরে উঠতে থাকো এবং দুনিয়াতে যেইভাবে স্পষ্ট ও ধীরে ধীরে পড়তে সেভাবে পড়তে থাক। কেননা (জান্নাতের ভিতর) তোমার স্থান ঠিক সেখানে হবে যেখানে তোমার শেষ আয়াতটি খতম হবে।”[হাদীসটি আবু দাউদ (১৪৬৪) ও তিরমিযী (২৯১৪) বর্ণনা করেন আর শাইখ আলবানী সহীহু আবি দাউদে এটিকে সহিহ বলে গণ্য করেন]
মুনযিরী আত-তারগীব গ্রন্থে বলেন: খাত্তাবী বলেছেন: “আছারে বর্ণিত হয়েছে: কুরআনের আয়াতের সংখ্যা আখিরাতে জান্নাতের সিঁড়ির সংখ্যা পরিমাণ। কুরআন পাঠকারীকে বলা হবে: তুমি কুরআনের যত আয়াত পড়তে তত সিঁড়িতে উঠতে থাক। যে ব্যক্তি পুরো কুরআন পড়বে সে জান্নাতের সর্বোচ্চ সিঁড়িতে উঠে যাবে। যে ব্যক্তি কিছু অংশ পড়বে সে তত সিঁড়ি পর্যন্ত উঠতে পারবে। তাই পড়া যেখানে সমাপ্ত হবে সেখানে নেকী সমাপ্ত হবে।”[আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব: (২/২২৮)]
কিন্তু তার এই কথায় আপত্তি আছে। কারণ হাদীসটি কুরআনের হাফেযদের মর্যাদার ব্যাপারে উদ্ধৃত হয়েছে; তাদের স্তর নিয়ে নয়। দুনিয়াতে আমলকারীদের ভিন্নতা অনুসারে তাদের মর্যাদা ভিন্ন ভিন্ন হবে। অনুরূপভাবে বহু আমল আছে যেগুলোর মাধ্যমে মানুষের স্তরভেদ হবে। যেমন: সিদ্দীক হওয়া, মুজাহিদ হওয়া প্রভৃতি। সুতরাং সমগ্র কুরআনের হাফেয মাত্রই জান্নাতের চূড়ান্ত স্তরে যাবে এমন আবশ্যকতা নেই।
আর জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর হলো ফেরদাউস যেমনটি আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে: তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা যখন আল্লাহর কাছে চাইবে তখন ফেরদাউস চাইবে। কারণ এটি জান্নাতের মধ্যম এবং জান্নাতের সবচেয়ে উপরে। এর উপরে আছে রহমানের আরশ। এখান থেকে জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত হয়।”[হাদীসটি বুখারী (২৬৩৭) ও মুসলিম (২৮৩১) বর্ণনা করেন]
জান্নাতের মধ্যম অর্থাৎ জান্নাতের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে ন্যায্য স্থান। এরূপ অর্থেই আল্লাহর বাণী:
وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَٰكُمۡ أُمَّةٗ وَسَطٗا
البقرة: 143
“আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী জাতি বানিয়েছি।”
জান্নাতের আমল ও জান্নাতবাসীদের স্তরসমূহ
জান্নাতবাসীদের কিছু আমল এবং জান্নাতবাসীদের স্তরসমূহের কতিপয় বিবরণ সুন্নাহতে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে:
আল্লাহর উপর ঈমান ও রাসূলদেরকে বিশ্বাস করা
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “অবশ্যই জান্নাতবাসীরা তাদের উপরের বালাখানার বাসিন্দাদের এমনভাবে দেখতে পাবে, যেমন তোমরা আকাশের পূর্ব অথবা পশ্চিম দিকে উজ্জ্বল দীপ্তিমান নক্ষত্র দেখতে পাও। এটা হবে তাদের মধ্যে মর্যাদার পার্থক্যের কারণে।” সাহাবীগণ বললেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! সেগুলো তো নবীদের জায়গা। তারা ছাড়া অন্যরা সেখানে পৌঁছতে পারবে না।’ তিনি বললেন: “অবশ্যই, সে সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! সে সকল লোকেরাও পৌঁছতে পারবে, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং রাসূলদেরকে সত্য বলে স্বীকার করবে।[হাদীসটি বুখারী (৩০৮৩) ও মুসলিম (২৮৩১) বর্ণনা করেন]
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “জান্নাতের মধ্যে একশটি স্তর আছে, যা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীদের জন্য মহান আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন। দুই স্তরের ব্যবধান আসমান-যমীনের মধ্যবর্তীর দূরত্বসম।”[হাদীসটি বুখারী (২৬৩৭) বর্ণনা করেন]
একনিষ্ঠভাবে শাহাদাতকামী ব্যক্তিও এটি অর্জন করতে পারবে
সাহল ইবনে হানীফ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর নিকট শাহাদাত প্রার্থনা করবে আল্লাহ তাআলা তাকে শহীদদের মর্যাদায় পৌঁছাবেন; যদিও তার মৃত্যু নিজ বিছানায় হয়।”[হাদীসটি বুখারী (১৯০৯) বর্ণনা করেন]
আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়কারী
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: দরিদ্র লোকেরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল: ‘সম্পদশালী ও ধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের দ্বারা উচ্চমর্যাদা ও স্থায়ী আবাস লাভ করছেন। আমরা যে যে নামায পড়ি তারাও সে সে নামায পড়ে, আমরা যে যে রোযা রাখি তারাও সে সে রোযা রাখে। আর তাদের আছে অতিরিক্ত অর্থ যা দিয়ে তারা হজ্জ করে, উমরা করে, জিহাদ করে এবং দান-সদকা করে।।...’ [হাদীসটি বুখারী (৮০৭) ও মুসলিম (৫৯৫) বর্ণনা করেছেন]
তীব্র কষ্ট সত্ত্বেও অযু পূর্ণকারী, মসজিদের দিকে বেশি বেশি গমনকারী এবং এক নামাযের পর অন্য নামাযের জন্য অপেক্ষাকারী
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আমি কি তোমাদেরকে এমন কিছুর দিক নির্দেশনা দিব না যার মাধ্যমে আল্লাহ গুনাহ মুছে দেন এবং মর্যাদার স্তর উন্নীত করেন?’ সাহাবীরা বললেন: অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন: “কষ্ট হলেও ভালোভাবে অযু করা, মসজিদের দিকে বেশি বেশি কদম ফেলা এবং এক নামায শেষ করে পরবর্তী নামাযের জন্য অপেক্ষায় থাকা। আর এটাই হল ‘রিবাত’ (প্রস্তুতি)। এটাই হলো ‘রিবাত’ (প্রস্তুতি)”[হাদীসটি মুসলিম (২৫১) বর্ণনা করেন]
কুরআনের হাফেয
এর প্রমাণ হলো উপরে বর্ণিত আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের হাদীস, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “পবিত্র কুরআনের পাঠককে (কিয়ামতের দিন) বলা হবে, ‘তুমি কুরআন করীম পড়তে থাক ও উপরে উঠতে থাকো। আর ঠিক সেইভাবে স্পষ্ট ও ধীরে ধীরে পড়তে থাক, যেভাবে দুনিয়াতে পড়তে। কেননা (জান্নাতের ভিতর) তোমার স্থান ঠিক সেখানে হবে, যেখানে তোমার শেষ আয়াতটি খতম হবে।”[হাদীসটি আবু দাউদ (১৪৬৪) ও তিরমিযী (২৯১৪) বর্ণনা করেন আর শাইখ আলবানী সহীহু আবি দাউদে এটিকে সহিহ বলে গণ্য করেন]
সুতরাং যে ব্যক্তি সুউচ্চ হিম্মতের অধিকারী, তার উচিত সর্বোত্তম বিষয়ের প্রতি উদগ্রীব হওয়া, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করা এবং জান্নাতুল ফেরদাউসে প্রবেশ করা। এই আমলগুলো যারা করবে তাদেরকে আল্লাহ এই স্তরগুলো প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যে মানুষগুলো এই স্তরগুলোর প্রতি আগ্রহী, আর যারা এগুলোর প্রতি বেখবর তাদের মাঝে দূরত্ব যে কত বেশি!
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।