রবিবার 21 জুমাদাল ছানী 1446 - 22 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

ফার্মেসিতে চাকুরী করা এবং এলকোহল বা হারাম জিলাটিন সমৃদ্ধ ঔষধ প্রস্তুত করা কিংবা বিক্রি করার বিধান কি?

প্রশ্ন

আমি একজন ফার্মাসিস্ট। বর্তমানে জার্মানিতে অবস্থান করছি। আমি জার্মানিতে চাকুরী করার জন্য ও বাকী পড়াশুনা শেষ করার জন্য আমার অনার্সের সার্টিফিকেট সমমান করানোর পর্যায়ে আছি। আমি এই দেশে ফার্মাসিতে চাকুরী করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে চাই। এখানে আমাকে ঔষধ প্রস্তুত করা কিংবা বিক্রি করার কাজ করতে হবে; যে ঔষধগুলোতে শুকর থেকে উৎপাদিত জিলাটিন থাকে কিংবা এলকোহল থাকে? উল্লেখ্য, আমি এ সকল ঔষধ অবশ্যই মুসলমানদের কাছে বিক্রি করব না; যদি এর বদলে অন্য ঔষধ থাকে।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

এলকোহল কিংবা শুকর থেকে উৎপন্ন জিলাটিন সমৃদ্ধ ঔষধ তৈরীর চাকুরী করা জায়েয নয়। কেননা এলকোহল হচ্ছে মদ; যা পান করা, ঔষধ হিসেবে গ্রহণ করা, অন্য খাবার বা পানীয়ের সাথে মেশানো জায়েয নয়। বরং আবশ্যকীয় কর্তব্য হচ্ছে মদ ধ্বংস করে ফেলা।

আর শুকর থেকে যা উৎপাদন করা হয় তা নাপাক; এটা থেকে দূরে থাকা ও পবিত্রতা অর্জন করা ওয়াজিব। তাই কোন ঔষধ কিংবা খাদ্য বা পানীয়তে এটা মেশানো নাজায়েয।

ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন:

হারাম বস্তু দিয়ে চিকিৎসা করা বিবেক ও শরিয়ত অনুযায়ী নিন্দনীয়। শরিয়তের দলিল হচ্ছে ইতোপূর্বে আমরা যে হাদিসগুলো উল্লেখ করেছি সেগুলো এবং অন্যান্য হাদিস। আর বিবেকের দলিল হচ্ছে— সেটি মন্দ হওয়ার কারণে আল্লাহ্‌ তাআলা তা হারাম করেছেন। তিনি এ উম্মতের জন্য শাস্তিস্বরূপ ভাল কিছুকে নিষিদ্ধ করেননি; যেমনটি নিষিদ্ধ করেছিলেন বনী ইসরাইলের জন্য তাঁর এ বাণীর মাধ্যমে: “সুতরাং ভাল ভাল যা ইহুদীদের জন্য হালাল ছিল আমরা তা তাদের জন্য হারাম করেছিলাম তাদের যুলুমের কারণে।”[সূরা নিসা, আয়াত: ১৬০] বরং এ উম্মতের জন্য যা কিছু হারাম করা হয়েছে সেটা মন্দ হওয়ার কারণে হারাম করা হয়েছে।

তিনি হারামকে হারাম করেছেন: তাদেরকে হারাম থেকে সুরক্ষা করার জন্য, হারাম গ্রহণ করা থেকে তাদেরকে দূরে রাখার জন্য। তাই হারামের মাধ্যমে রোগ-বিমার থেকে নিরাময় তালাশ করা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যদি হারাম বস্তু রোগ-ব্যাধি দূরীকরণে কোন ভূমিকা রেখে থাকেও তদুপরি হারাম জিনিস অন্তরের উপর এর চেয়ে বড় ব্যাধি রেখে যাবে। কারণ হারামের মন্দ শক্তিশালী। ফলে হারামের মাধ্যমে চিকিৎসাকারী যেন অন্তরকে রোগাগ্রস্ত করার মাধ্যমে দেহের বিমার দূর করার প্রয়াশ পেল।

তাছাড়া আল্লাহ্‌ কর্তৃক এটাকে হারাম করার দাবী হচ্ছে- এটাকে বর্জন করা এবং সকল উপায়ে এর থেকে দূরে থাকা। যদি হারামকে ঔষধ হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাহলে তো এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়; এটি শরিয়তদাতার উদ্দেশ্যের বিপরীত।

এ ছাড়া শরিয়তের দলিল মোতাবেক হারাম জিনিস নিজেই তো একটা রোগ। তাই হারামকে ঔষধ হিসেবে গ্রহণ করা জায়েয হবে না।

তা ছাড়া হারাম জিনিস স্বভাব-প্রকৃতি ও আত্মার উপর খারাপ গুণ তৈরী করে। কারণ মানব প্রকৃতি নিরাময় প্রক্রিয়ার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হয়। যদি নিরাময় পদ্ধতি মন্দ হয় মানব প্রকৃতি এর থেকে মন্দ গুণ অর্জন করে। আর ঔষধের সত্তাটাই যদি খারাপ হয় তাহলে অবস্থা কেমন হবে?!

এ কারণে আল্লাহ্‌ তাআলা তার বান্দাদের উপর খারাপ খাদ্য, খারাপ পানীয় ও খারাপ পোশাক নিষিদ্ধ করেছেন। কেননা এগুলো আত্মাকে খারাপ গুণে গুণান্বিত করে।[যাদুল মাআদ (৪/১৪১) থেকে সমাপ্ত]

স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্রে (২২/১০৬) এসেছে:

এলকোহল বা মদের সব ধরণের ব্যবহারের হুকুম কি? অর্থাৎ ফার্নিচার বার্নিশের কাজে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে, জ্বালানি হিসেবে, ড্রেসিং করার ক্ষেত্রে, পারফিউম তৈরীতে, শোধন করার ক্ষেত্রে এবং ভিনেগার হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে?

জবাব:

যে জিনিস বেশি পান করলে মাতলামি ধরে সেটাই মদ। এ জিনিসের অল্প বা বেশি বিধান সমান। এটাকে এলকোহল বলা হোক কিংবা অন্য কোন নাম দেয়া হোক। আবশ্যকীয় কর্তব্য হচ্ছে– এটা ঢেলে ফেলে দেয়া। নানাবিধ কাজে যেমন– ড্রেসিং করা, শোধন করা, জ্বালানি পদার্থ, পারফিউম তৈরী কিংবা ভিনগারে রূপান্তরিত করণ ইত্যাদি কাজে লাগানোর জন্য এটি রেখে দেওয়া হারাম।

আর যে পদার্থ বেশি পান করলেও মাতলামি ধরে না– সেটা মদ নয়। সে পদার্থ পারফিউম তৈরীতে, ঔষধ হিসেবে, ক্ষতস্থান ড্রেসিং করা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা জায়েয।

শাইখ আব্দুল্লাহ্‌ বিন কুয়ুদ, শাইখ আব্দুল্লাহ্‌ বিন গাদইয়ান, শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি, শাইখ আব্দুল আযিয বিন আব্দুল্লাহ্‌ বিন বায”।[সমাপ্ত]

দুই:

বিশেষ কোন প্রতিষ্ঠান যদি ঔষধের সাথে এলকোহল কিংবা হারাম জিলাটিন মিশিয়ে থাকে তাহলে সে প্রতিষ্ঠান এর জন্য গুনাহগার হবে; যেমনটি ইতিপূর্বেও আমরা উল্লেখ করেছি। এরপর ঔষধটি পর্যবেক্ষণ করা হবে। যদি এতে মিশ্রিত পদার্থের পরিমাণ এত কম হয় যে, এ ঔষধ বেশি পরিমানে সেবন করলেও মাতলামি ধরবে না কিংবা মিশ্রিত পদার্থটি পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায়; এর স্বাদ, রঙ কিংবা গন্ধ কোনটির চিহ্ণ না পাওয়া যায়– এমন ঔষধ সেবন করা ও এটা দিয়ে চিকিৎসা করা জায়েয আছে।

স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্রে (২২/২৯৭) এসেছে:

বাজারে এমন কিছু ঔষধ বা মিষ্টান্ন বিক্রি করা হয় যাতে অতি সামান্য পরিমাণ এলকোহল রয়েছে। এমন ঔষধ বা মিষ্টান্ন খাওয়া কি জায়েয হবে? উল্লেখ্য, কেউ যদি এমন মিষ্টান্ন বেশি পরিমাণেও খায় তদুপরি কখনও মাতলামির পর্যায়ে পৌঁছবে না।

উত্তর: যদি মিষ্টান্নতে কিংবা ঔষধে এলকোহলের পারসেন্টিজ এত সামান্য পরিমাণ হয় যে, এ মিষ্টান্ন বা ঔষধ বেশি পরিমাণে খেলে কিংবা পান করলেও মাতলামি ধরবে না তাহলে এগুলো গ্রহণ করা কিংবা বিক্রি করা জায়েয হবে। কেননা স্বাদ, রঙ বা গন্ধে এর কোন প্রভাব নেই। যেহেতু এ পদার্থ বৈধ পবিত্র পদার্থে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। তবে কোন মুসলমানের জন্য এমন পণ্য উৎপাদন করা কিংবা মুসলমানদের খাদ্যে তা দেয়া কিংবা এ কাজে সহযোগিতা করা জায়েয হবে না।[সমাপ্ত]

তিন:

যে ঔষধের মধ্যে এলকোহল রয়েছে কিংবা হারাম জিলাটিন রয়েছে এমন ঔষধ বিক্রি করা জায়েয; যদি এর মধ্যে মেশানো পদার্থ একেবারে সামান্য পরিমাণে হয় কিংবা এটি নিঃশেষ হয়ে যায়।

যে সব ঔষধে নেশাগ্রস্তকারী এলকোহলের সামান্য পারসেন্টিজ রয়েছে এমন ঔষধ ব্যবহার করা জায়েয হওয়া মর্মে ‘ইসলামি-ফিকাহ-একাডেমি’ মুসলিম বিশ্বের ফতোয়াইস্যুকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কমিটির সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে সন্দেহজনক বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকার জন্য কোন ঔষধপত্রে এলকোহল ব্যবহার না করাই মুস্তাহাব ও উত্তম।

ওয়াশিংটনস্থ ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক থট’ এর জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে ‘ওআইসি’ এর অধিভুক্ত ‘ইসলামি-ফিকাহ-একাডেমি’ এর সিদ্ধান্ত নং: ২৩(৩/১১) তে এসেছে-

দ্বাদশ প্রশ্ন:

এমন অনেক ঔষধ আছে যেগুলোতে বিভিন্ন মাত্রার এলকোহল রয়েছে। এর পরিমাণ ০.০১% থেকে ২৫%। এ ঔষধগুলোর অধিকাংশ সর্দি, গলা ব্যথা ও কাশি ইত্যাদি সাধারণ রোগের। এ রোগগুলোর ঔষধের মধ্যেপ্রায় ৯৫% ঔষধ এলকোহল সমৃদ্ধ। তাই এলকোহল ফ্রি ঔষধ পাওয়া খুব কঠিন কিংবা অসম্ভব। এমতাবস্থায়, এ সকল ঔষধ সেবন করার হুকুম কী?

জবাব: মুসলিম রোগী যদি এলকোহলমুক্ত ঔষধ না পান তাহলে তিনি নির্ভরযোগ্য ও পেশাদারিত্বে বিশ্বস্ত ডাক্তারের পরামর্শ মাফিক কিছু পরিমাণ এলকোহলযুক্ত ঔষধ সেবন করতে পারেন।[একাডেমির ম্যাগাজিন, সংখ্যা-৩, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১০৮৭)]

ওআইসি এর অধিভুক্ত ‘ফিকাহ একাডেমি’ এর সিদ্ধান্তে আরও এসেছে: “ঔষধ তৈরীতে প্রয়োজন হলে এবং বিকল্প না থাকলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মত সামান্য মাত্রার এলকোহল সমৃদ্ধ ঔষধ ব্যবহার করা জায়েয আছে। তবে শর্ত হচ্ছে একজন সচ্চরিত্র ডাক্তার ঔষধটি সেবনের পরামর্শ দিতে হবে।[মক্কা মুকাররমাস্থ ফিকাহ একাডেমি এর সিদ্ধান্তবলি, পৃষ্ঠা-৩৪১]

হারাম জিলাটিন বা গ্লিসারিন যুক্ত ঔষধ ও ক্যামিকেলের বিধান জানতে 97541 নং প্রশ্নোত্তর দেখুন।

চার:

যদি এমন কোন ঔষধ কিংবা ক্যামিকেল পাওয়া যায় যা বেশি পরিমাণে পান করলে মাতলামি ধরে কিংবা এগুলোতে রূপান্তরিত হয়নি এমন শুকরের চর্বি থাকে— সে ক্ষেত্রে এগুলো সেবন করা ও বিক্রি করা জায়েয হবে না।

যারা ফার্মেসিতে চাকুরী করেন তাদের উপর আবশ্যকীয় এগুলো থেকে বিরত থাকা।

সারকথা:

মূলবিধান হচ্ছে– ফার্মেসিতে চাকুরী করা বৈধ। ঔষধের অধিকাংশ শ্রেণী বৈধ। যদি এমন কোন ঔষধ পাওয়া যায় যা সেবন করা হারাম সে ঔষধ বিক্রি করা জায়েয হবে না। হারাম কিছু বিক্রি না করে এ পেশাতে অটুট থাকতে কোন অসুবিধা নেই।

আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব