রবিবার 23 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 24 নভেম্বর 2024
বাংলা

Payoneer কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করার হুকুম

প্রশ্ন

Payoneer কার্ডের ব্যাপারে কোন ইসলামী ফতোয়ার ওয়েবসাইটে আমি কিছু শুনেনি যে, এই কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনকে হারাম বলা হয়েছে। কিন্তু আমি কোন এক ব্লগে এক ভাইয়ের একটা কথা পড়েছি। সম্মানিত সেই ভাইয়ের কথার সারাংশ হচ্ছে: Payoneer কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করা থেকে সাবধান করা। কেননা Payoneer ব্যাংকের মালিক তার বাৎসরিক লাভের বড় একটা অংশ দিয়ে যায়োনিষ্ট সেনাবাহিনীকে অর্থায়ন করে। প্রকৃতপক্ষে আমি নিজের ব্যাপারে আশংকিত হয়ে পড়েছি যে, কেবল এই কার্ডটি ব্যবহার করার মাধ্যমে আমি যায়োনিস্টদের সাথে গুনাহর ভাগীদার হয়ে যাচ্ছি এবং আমার মুসলিম ভাইদের উপর তারা যে সীমালঙ্ঘন করছে এর সহযোগী হয়ে যাচ্ছি। তাই আমি তাৎক্ষণিকভাবে কার্ডটি ছিড়ে ফেলেছি। এরপর আমি ওয়েবসাইট কর্তৃপক্ষকে মেইল করেছি যাতে করে তারা আমার একাউন্টটি বন্ধ করে দেয়। তারা কিছুদিন পর তা অনুমোদন করেছে। বর্তমানে আমি নতুন একটি সমস্যা মোকাবিলা করছি যার সমাধান পাইনি। সেটা হলো: আমি একটি কোম্পানির পণ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাজারজাত করি এবং প্রত্যেক বিক্রির লেনদেনের বিপরীতে কমিশন পাই। এই কোম্পানী থেকে আমার প্রাপ্য লাভ উত্তোলনের পদ্ধতি হয়তো ব্যাংকিং চেকের মাধ্যমে। এটি কঠিন। কারণ একাউন্ট খোলার জন্য আমার আইডি কার্ডে আমার চাকুরী আছে উল্লেখ থাকতে হবে। আমার কোন চাকুরী নেই। আর সেই কোম্পানি থেকে আমার লাভ প্রাপ্তির দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো: কোন আমেরিকান ব্যাংকে আমার একাউন্ট থাকা। সেটাও আমার নেই। কিন্তু Payoneer কার্ড আমাকে বিনামূল্যে আমেরিকান ব্যাংকে একাউন্ট করে দেয়। এর মাধ্যমে আমি আমার প্রাপ্য লাভ কার্ডে ঢুকাতে পারি। এরপর যে কোন এটিএম মেশিন থেকে উত্তোলন করতে পারি। আমার প্রশ্ন হলো: যদি সেই ভাইয়ের কথা সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আমি নিরুপায় হিসেবে আমার জন্য Payoneer কার্ড ব্যবহার করা কি জায়েয হবে?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

কাফেরদের সাথে বেচাকেনার লেনদেন করা জায়েয; এমনকি তারা হারবী (যুদ্ধরত) কাফের হলেও। কেবল যুদ্ধে সহযোগিতা করা হয় এমন কিছু ছাড়া; যেমন তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা। সেটি জায়েয নয়।

নববী (রহঃ) বলেন: “পক্ষান্তরে হারবীদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা এটি ইজমার ভিত্তিতে হারাম।”[আল-মাজমু (৯/৪৩২)]

আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা গ্রন্থে (৭/১১২) এসেছে:

“ফিকাহবিদদের বক্তব্যগুলো হারবীদের সাথে ব্যবসা করা জায়েয হওয়ার প্রমাণ নির্দেশ করে। তাই মুসলিম ব্যক্তি ও যিম্মি ব্যক্তি ব্যবসায়িক নিরাপত্তা নিয়ে দারুল হারবে (যুদ্ধরত দেশে) প্রবেশ করতে পারেন এবং হারবী ব্যক্তি ব্যবসায়িক নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের দেশে প্রবেশ করতে পারেন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রমকালে তার ব্যবসা থেকে ওশর (এক দশমাংশ) হারে (ট্যাক্স) আদায় করা হবে।

কিন্তু হারাবীদেরকে অস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও অস্ত্র তৈরীতে লাগে এমন মালামাল সরবরাহ করা জায়েয নয়। অনুরূপভাবে তাদেরকে শরিয়তে নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসার অনুমতি দেয়া যাবে না; যেমন মদ, শূকর ও অন্যান্য নিষিদ্ধ জিনিসপত্র। কেননা শরিয়তে সেগুলো নিষিদ্ধ ও অনিষ্টকর; সেগুলোকে দমন করা আবশ্যকীয়।

অনুমতি নিয়ে মুসলিম দেশে প্রবেশকারী হারবী ব্যক্তির ইসলামী রাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনার অধিকার নেই। পূর্বোক্ত বিষয়গুলো বাদ দিয়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে দেয়া জায়েয।

তবে মালেকি মাযহাবের আলেমগণের একক অভিমত হচ্ছে আমাদের দেশ থেকে হারবী দেশে (যুদ্ধরত দেশে) পণ্য রপ্তানী করা ও সেখানে মুসলমানদের ব্যবসা করা নিষিদ্ধ; যদি ব্যবসায়ীদের উপর তাদের (যুদ্ধরতদের) বিধানাবলী প্রযোজ্য হয়। কেননা তাদের দেশে কোন কিছু রপ্তানী করা হলে মুসলমানদের বিপক্ষে তাদেরকে শক্তিশালী করা হয়। এবং যেহেতু মুসলিমের জন্য শিরকের দেশে অবস্থান করা নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘আমি প্রত্যেক এমন মুসলিম থেকে মুক্ত যে মুশরিকদের মাঝে অবস্থান করে’।

অনুরূপভাবে খাদ্যদ্রব্য ও অনুরূপ জিনিস রপ্তানী করাও জায়েয নয়। তবে শত্রুর সাথে যদি চুক্তি থাকে সেটা ভিন্ন কথা। চুক্তি না থাকলে জায়েয নয়।

আমাদের দেশসমূহ থেকে রপ্তানী করা জায়েয হওয়ার পক্ষে দলিলগুলোর মধ্যে রয়েছে:

ছুমামা বিন উছাল আল-হানাফীর হাদিস: তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর মক্কাবাসীকে বললেন যখন তারা তাকে বলল যে, তুমি ধর্ম ত্যাগ করেছ? তিনি বললেন: আল্লাহ্‌র শপথ! আমি ধর্ম ত্যাগ করিনি। কিন্তু আল্লাহ্‌র শপথ! আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি ও তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি। সেই আল্লাহ্‌র শপথ যার হাতে রয়েছে ছুমামার প্রাণ! ইয়ামামা (মক্কার গ্রাম্য এলাকা) থেকে তোমাদের কাছে একটি শস্যদানাও পৌঁছবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত না মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি দেন। এই বলে তার এলাকায় চলে যান এবং মক্কার উদ্দেশ্যে কোন কিছু বহন করা থেকে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। যার কারণে কুরাইশরা সংকটে পড়ে যায়। এক পর্যায়ে তারা রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে পত্র লিখে যাতে করে তিনি তাদের কাছে খাদ্য পাঠানোর জন্য ছুমামাকে পত্র লিখেন। তখন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা করলেন।” এ হাদিস প্রমাণ করে যে, শত্রুদের কাছে খাদ্যদ্রব্য ও অনুরূপ জিনিস রপ্তানী করা জায়েয। এমনকি তাদের সাথে যুদ্ধের পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও।

অনুরূপভাবে দলিলগুলোর মধ্যে রয়েছে: ইতিপূর্বে উল্লেখিত হাদিসগুলো; যেগুলো হারবীদের জন্য সদকা করা ও তাদের জন্য ওসিয়ত করা (আবু সুফিয়ানকে খেজুর হাদিয়া দেয়ার ঘটনা, আসমা রাঃ তার মুশরিক মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখার ঘটনা এবং মুসলমানেরা অমুসলিম বন্দিদেরকে খাদ্য খাওয়ানোর ঘটনা) সংক্রান্ত।

আর অস্ত্র ও অস্ত্র শ্রেণীয় জিনিস রপ্তানী করা হারাম হওয়ার পক্ষে দলিল হলো:

ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) এর হাদিস: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিতনার সময় অস্ত্র বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। ফিতনা হচ্ছে: গৃহ যুদ্ধ। আর মুসলমানদের বিরুদ্ধে অমুসলিমদের ফিতনা তো আরও অধিক জঘন্য। তাই তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি না-করা আরও অধিক যুক্তিযুক্ত।

হাসান বসরী বলেন: কোন মুসলিমের জন্য মুসলমানদের শত্রুদের কাছে অস্ত্র ও ঘোড়া সরবরাহ করা কিংবা যা কিছু অস্ত্র ও ঘোড়ার কাজে লাগে সেগুলো সরবরাহ করা বৈধ নয়।

নিশ্চয় শত্রুদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করার মধ্যে তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করা হয়, তাদেরকে যুদ্ধের প্রতি উসকে দেয়া হয় এবং সে অস্ত্রের মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করা হয়। ফলে সেটি নিষিদ্ধ হওয়ার দাবী রাখে।”[সমাপ্ত]

এটাই হচ্ছে মূল বিধান তথা হারবীদের (যুদ্ধরত কাফেরদের) সাথে অস্ত্র ছাড়া অন্য ব্যবসায়িক লেনদেন করা জায়েয। তবে মুসলমানেরা যদি মনে করে তাদের সাথে লেনদেন কর্তন করা কল্যাণকর এবং আলেমগণ এর স্বীকৃতি দেন তাহলে সেটা মানতে হবে।

দুই:

প্রিপেইড Payoneer কার্ডের গ্রাহক নিজের Payoneer একাউন্টের সাথে লাভ প্রদানকারী যে কোম্পানীগুলোর সাথে তিনি লেনদেন করেন সেগুলোকে যুক্ত করার পর এই কার্ডে ইন্টারনেট থেকে অর্থ প্রবেশ করে। এই কার্ডটি গ্রাহককে ইন্টারনেট থেকে আয়কৃত লাভের অর্থ উত্তোলন করার সুযোগ করে দেয়। এটি কোন ক্রেডিট (ঋণপ্রদানকারী) কার্ড নয়।

এই কার্ড দিয়ে লেনদেন করতে কোন অসুবিধা নাই। দলিল হলো: ইতিপূর্বে আমরা যা উল্লেখ করেছি যে, কাফেরদের সাথে লেনদেন করার মূল বিধান বৈধতা; এমনকি তারা যদি হারবী কাফের হয় তবুও।

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব