আলহামদু লিল্লাহ।.
আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদম সন্তানদের মাঝে পিতা-মাতার দিক থেকে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ও কুলীন ব্যক্তি; যা বিশিষ্ট আলেম ও সাধারণ আলেমদের কাছে সাব্যস্ত বিষয়।
মুসলিম (২২৭৬) বর্ণনা করেন: ওয়াসেলা ইবনুল আসক্বা’ বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তা’আলা ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধর থেকে কিনানাহ গোত্রকে বাছাই করেছেন। কিনানাহ গোত্র থেকে কুরাইশকে বাছাই করেছেন। আবার কুরাইশদের মধ্য থেকে হাশিমকে বাছাই করেছেন এবং বনূ হাশিম থেকে আমাকে বাছাই করেছেন।”
আদনান পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের ব্যাপারে সবাই একমত। কিন্তু আদনান থেকে ইসমাঈল ইবনে ইব্রাহীম পর্যন্ত বংশের বিবরণ নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
“তিনি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। আব্দুল মুত্তালিবের নাম— শাইবা। তিনি হাশিমের ছেলে। হাশিমের নাম— আমর। তিনি আব্দ মানাফের ছেলে। আব্দ মানাফের নাম— মুগীরাহ। মুগীরাহ কুসাইয়ের ছেলে। কুসাইয়ের নাম— যাইদ। কুসাই হলেন কিলাবের ছেলে। কিলাব হলেন ইবনে মুর্রা ইবনে কা’ব ইবনে লুআই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর ইবনে মালিক ইবনুন নদ্বর ইবনে কিনানাহ ইবনে খুযাইমাহ ইবনে মুদরিকা। মুদরিকার নাম— আমের। তিনি হলেন ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুদ্বার ইবনে নিযার ইবনে মা’আদ্দ ইবনে আদনান। আদনান হলেন ইসমাঈল ইবনে ইব্রাহীমের (তাদের দুজনের উপর এবং আমাদের নবীর উপর দরূদ ও সালাম) ছেলে। এই বংশনামার ব্যাপারে সব মানুষ একমত।
কিন্তু আদনান থেকে ইসমাঈল পর্যন্ত পিতৃপুরুষের ব্যাপারে আলেমরা মতভেদ করেছেন। কেউ বলেছেন: এদের মাঝে আছেন নয়জন। কেউ বলেছেন: এদের মাঝে আছেন সাতজন। কিছু পিতার নাম নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন: তাদের মাঝে পনেরজন। কেউ বলেন: তাদের মাঝে চল্লিশ জন। তবে শেষোক্ত মতটি দুর্বল। আরবদের একটা দল থেকে এমন বক্তব্য পাওয়া যায়।
উরওয়া ইবনুয যুবাইর বলেন: ‘আদনান ও ক্বাহত্বানের পরে কারা আছে তাদের ব্যাপারে জানে এমন দাবি করা প্রত্যেককে আমরা অনুমানের উপর নির্ভর করতে দেখেছি।’
উরওয়ার পালিত এতীম আবুল আসওয়াদ বলেন: আবু বকর ইবনে সুলাইমান ইবনে আবী হাসমা ছিলেন কুরাইশের মাঝে বংশনামা ও কবিতার ব্যাপারে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের একজন। তাকে বলতে শুনেছি: ‘মা’আদ্দ ইবনে আদনানের উপরে কে আছে তা আমরা কাউকে জানতে দেখিনি; হোক সেটা কোন কবির কবিতায় কিংবা কোন জ্ঞানীর জ্ঞানে।’
আবু উমর ইবনে আব্দিল বার বলেন: ‘এই শাস্ত্রে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতে তিনি হলেন আদনান ইবনে উদাদ ইবনে মুকাওয়িম ইবনে নাহূর ইবনে তাইরাহ ইবনে ইয়া’রাব ইবনে ইয়াশজাব ইবনে নাবিত ইবনে ইসমাইল ইবনে ইব্রাহীম আল-খলীল ইবনে আযার (তার নাম তারেহ) ইবনে নাহূর ইবনে সারূহ ইবনে রাউ ইবনে ফালেখ ইবনে আইবার ইবনে শালেখ ইবনে আরফাখশায ইবনে সাম ইবনে নূহ আলাইহিস সালাম ইবনে লামেক ইবনে মাত্তুশালাখ ইবনে খানুখ ইবনে ইয়ারদ ইবনে মাহলীল ইবনে ক্বাইনান ইবনে ইয়ানিশ ইবনে শীস ইবনে আদম, যিনি মানবজাতির পিতা, আলাইহিস সালাম।
মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক তার সীরাত গ্রন্থে এই বংশনামার উপর নির্ভর করেছেন। ইবনে ইসহাকের কিছু সহচর (ছাত্র) কিছু নামের ব্যাপারে মতভেদ করেছেন।’
ইবনে সা’দ বলেন: আমাদের মতে আদনান থেকে ইসমাঈল পর্যন্ত নীরবতা অবলম্বন করা উচিত।” [আস-সিয়ার: (১/১৪৩-১৪৫)]
হাফেয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
‘ত্বাবারানী উত্তম সনদে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেন: মা’আদ্দ ইবনে আদনান পর্যন্ত মানুষের বর্ণিত বংশনামা সঠিক।’[সমাপ্ত][ফাতহুল বারী (৬/৫২৯)]
ইমাম ইবনে হিব্বান রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশ আদনান পর্যন্ত সঠিক। আদনানের পরে আমার দৃষ্টিতে নির্ভর করার মত সঠিক কিছু নেই। সুতরাং তিনি হলেন:
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (আব্দুল মুত্তালিবের নাম শাইবা) ইবনে হাশিম (হাশিমের নাম আমর) ইবনে আব্দ মানাফ (আব্দ মানাফের নাম মুগীরাহ) ইবনে কুসাই (কুসাইয়ের নাম যাইদ) ইবনে কিলাব (আল-মুহায্যাব) ইবনে মুর্রা ইবনে কা’ব ইবনে লুআই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর ইবনে মালিক ইবনুন নদ্বর (তিনি হলেন কুরাইশ) ইবনে কিনানা ইবনে খুযাইমা ইবনে মুদরিকা ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুদ্বার ইবনে নিযার ইবনে মা’আদ্দ ইবনে আদনান।
এই পর্যন্ত বংশবিশারদদের মাঝে কোনো মতভেদ নেই। আদনান থেকে শুরু করে ইব্রাহীম পর্যন্ত বংশনামার ক্ষেত্রে তারা মতভেদ করেছে।’[সমাপ্ত][আস-সীরাতুন নাবাউইয়্যাহ ওয়া-আখবারুল খুলাফা (১/৩৯)]
ইবনে হাযম রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
‘তিনি হলেন আবুল কাসেম (কাসেমের পিতা) মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (তার নাম শাইবাতুল হামদ) ইবনে হাশিম (তার নাম আমর) ইবনে আব্দ মানাফ (তার নাম মুগীরাহ) ইবনে কুসাই (তার নাম যাইদ) ইবনে কিলাব ইবনে মুর্রা ইবনে কা’ব ইবনে লুআই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর ইবনে মালিক ইবনুন নাদ্বর ইবনে কিনানা ইবনে খুযাইমা ইবনে মুদরিকা ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুদ্বার ইবনে নিযার ইবনে মা’আদ্দ ইবনে আদনান।
যে বিশুদ্ধ বংশনামার ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই, সেটির সমাপ্তি এখানে।’[সমাপ্ত][সীরাত (পৃ. ৪)]
আরো দেখুন: বাইহাকীর ‘দালাইলুন নুবুওয়াত’ (১/১৭৭), আবু সাদ আন-নাইসাপুরীর ‘শারাফুল মুস্তফা’ (২/১২), মাওয়ার্দীর ‘আ’লামুন নুবুওয়াহ’ (পৃ. ২০২), কিলাঈর ‘আল-ইকতিফা’ (১/৮), ইবনু সাইয়্যিদিন নাসের ‘উয়ুনুল আসার’ (১/২৬) এবং ইবনে কাসীরের ‘আস-সীরাহ আন-নাবাউইয়্যাহ’ (১/২০)।
সুহাইলী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “ইলিয়াস নামটির ব্যাপারে ইবনুল আন্বারী বলেন: إلياس শব্দের হামযা বর্ণে কাসরাহ তথা যের হবে। নবী ইলিয়াস আলাইহিস সালামের নামের সদৃশ হবে এই নাম। তিনি এই নামটির উৎস প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি মত উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে রয়েছে: فِعْيَال ওযনে الأَلْس (আল-আলস) থেকে গঠিত। আল-আলস অর্থ ধোঁকা। কারো মতে: ‘আল-আলস’ অর্থ আকলের বিকৃতি। তন্মধ্যে আরো রয়েছে: এটি إفعال ওযনে رَجُلٌ ألْيَسُ থেকে গঠিত। যার অর্থ এমন সাহসী ব্যক্তি পলায়ন করে না।
ইবনুল আন্বারী ছাড়া অন্যরা যা বলেছেন সেটি অধিকতর বিশুদ্ধ মত। সেটি হলো: আল-ইয়াস শব্দটি الرجاء (আশা) অর্থের বিপরীতে নামকরণ করা হয়েছে। এখানে أل (আলিফ-লাম) معرفة বা নির্দিষ্ট করার জন্য। এখানে থাকা হামযাটি همزة الوصل। কাসেম ইবনে সাবিত দালাইল গ্রন্থে এমনটি বলেছেন।”[আর-রাওদুল উনুফ (১/৫৭) গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপে সমাপ্ত]
ক্বাসত্বাল্লানী ‘আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ’ গ্রন্থে (১/৬১) বলেন:
‘ইবনুল আনবারীর মতে: إلياس শব্দটি হামযায় কাসরা তথা যের দিয়ে। আর কাসেম ইবনে সাবিতের মতে الياس শব্দের হামযায় ফাতহা তথা যবর দিয়ে الرجاء (আশা) শব্দের বিপরীত শব্দ। এখানে লামটি لام التعريف তথা নির্দিষ্ট করার জন্য ব্যবহৃত। আর হামযাটি همزة الوصل।[সমাপ্ত]
যারক্বানী শারহুল মাওয়াহিব গ্রন্থে (১/১৪৭) বলেন: ‘ইলিয়াস শব্দটির শুরুতে যের। প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী ‘ইলিয়াস’ তার নাম। সীরাতে মুগলত্বাঈ গ্রন্থে আছে: তার নাম হাবীব। খামীস গ্রন্থে আছে: তার নাম ইলিয়াস রাখার কারণ হলো তার বাবা বৃদ্ধ হলেও সন্তান হয়নি। তিনি যখন বয়োবৃদ্ধ এবং হতাশ তখন এই সন্তান জন্ম নেয়। তাই তার নাম রাখা হয় ইলিয়াস। তার উপনাম আবু আমর।’[সমাপ্ত]
সারকথা হলো:
‘ইলিয়াস’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঐ বংশনামার অন্তর্ভুক্ত, যা প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি প্রসিদ্ধ ও ঐকমত্যপূর্ণ। এ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। বরং মতভেদ রয়েছে ‘ইলিয়াস’ শব্দের হরকত নিয়ে। এটি কি همزة القطع যোগে إلياس নাকি همزة الوصل যোগে الياس। এ নিয়ে আলেমদের মাঝে দুটি মত রয়েছে। এ পার্থক্যটি একটি গৌণ বিষয় যেমনটি স্পষ্ট হলো। আর একদম হামযা ছাড়া لياس (লিয়াস) যেমনটি প্রশ্নে উল্লিখিত হয়েছে, সেটি আমাদের জানামতে কেউ উল্লেখ করেননি কিংবা কোনো আলেম এমনটি বলেননি।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।