আলহামদু লিল্লাহ।.
মৈত্রী ও শত্রুতা তাওহীদের অন্যতম একটি মূলনীতি:
মৈত্রী ও শত্রুতা তাওহীদের অন্যতম একটি মূলনীতি; যার শব্দ ও মর্ম দলিল দ্বারা সাব্যস্ত। আল্লাহ্তাআলা বলেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের মিত্র। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে মৈত্রী করবে সে তাদেরই দলভুক্ত। আল্লাহ্কখনো জালেমদেরকে হেদায়েত করেন না। এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে আপনি তাদেরকে ওদের মাঝে ছুটে যেতে দেখবেন। তারা বলে, ‘আমাদের ভয় হয়, না জানি আমাদের ওপর কোন বিপদ এসে পড়ে’। তবে শীঘ্রই আল্লাহ্বিজয় অথবা তাঁর পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ দেবেন; তখন তারা তাদের মনে যা লুকিয়ে রাখত সেজন্য অনুতপ্ত হবে। আর ঈমানদাররা বলবে, ‘এরাই কি তারা যারা আল্লাহ্র নামে জোরালো শপথ করে বলেছিল যে, তারা তোমাদের সাথেই আছে?’ তাদের কর্মসমূহ নিষ্ফল হয়ে গিয়েছে; যার ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্যে যারা স্বীয় ধর্ম ত্যাগ করবে তাদের স্থলে আল্লাহ্এমন একদল লোক নিয়ে আসবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালবাসবে; তারা মুমিনদের প্রতি নরম আর কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে এবং তারা আল্লাহ্র পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দায় ভীত হবে না। এটা আল্লাহ্র অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। আল্লাহ্বড় দানশীল, মহাজ্ঞানী। বস্তুত তোমাদের মিত্র হল আল্লাহ্, তাঁর রাসূল আর ঈমানদারগণ; যারা বিনয়াবনত হয়ে নামায সুসম্পন্ন করে ও যাকাত দেয়। আর যারা আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করে (তারাই আল্লাহ্র দল), আল্লাহ্র দলই বিজয়ী।”[সূরা মায়িদা, ৫: ৫১-৫৬]
আল্লাহ্তাআলা আরও বলেন: “(স্মরণ করুন) যখন ইবরাহীম তার পিতা ও নিজ সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমরা যাদের উপাসনা কর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তবে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি এর ব্যতিক্রম। (অর্থাৎ তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক।) নিশ্চয়ই তিনি আমাকে সুপথে পরিচালিত করবেন।”[সূরা আয-যুখরুফ, ৪৩: ২৬-২৭]
আল্লাহ্তাআলা আরও বলেন: “তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সঙ্গীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলাম এবং আমাদের ও তোমাদের মাঝে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হল; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আন।”[সূরা আল-মম্তাহিনাহ, ৬০:৪]
এগুলো ছাড়াও ঈমানদারদের সাথে মিত্রতা রাখা ওয়াজিব হওয়া এবং কাফেরদের সাথে মৈত্রী করা হারাম হওয়া এবং তাদের সাথে ও তারা যা কিছুর উপাসনা করে সেগুলো থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করার পক্ষে আরও আয়াত রয়েছে।
ইমাম আহমাদ (২২১৩২) মুয়ায (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ্সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বোত্তম ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: “সর্বোত্তম ঈমান হচ্ছে— আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা, আল্লাহ্র কারণে অপছন্দ করা এবং তোমার জিহ্বাকে আল্লাহ্র যিকিরে ব্যস্ত রাখা।”[শুয়াইব আল-আরনাউত বলেন: হাদিসটি সহিহ লি-গাইরিহি]
তাবারানী ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “ঈমানের সর্বাধিক মজবুত রজ্জু হচ্ছে— আল্লাহ্র জন্য মৈত্রী এবং আল্লাহ্র জন্য শত্রুতা; আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহ্র জন্য ঘৃণা।”[আলবানী ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে (২৫৩৯) হাদিসটিকে ‘সহিহ’ বলেছেন]
মৈত্রী ও শত্রুতার তাৎপর্য:
শাইখ বিন বায (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: “ফযিলাতুশ শাইখ! দয়া করে মৈত্রী ও শত্রুতার বিষয়টা পরিস্কার করবেন কী? কাদের সাথে মৈত্রী করতে হবে? কাফেরদের সাথে মৈত্রী করা কি জায়েয আছে?
তিনি জবাবে বলেন:
মৈত্রী ও শত্রুতা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে মুমিনদেরকে ভালোবাসা, তাদের সাথে মিত্রতা রাখা এবং কাফেরদেরকে ঘৃণা করা, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা এবং তাদের থেকে ও তাদের ধর্ম থেকে নিজের সম্পর্কচ্ছেদ করা। এটাই হচ্ছে মৈত্রী ও শত্রুতা। যেমনটি আল্লাহ্তাআলা সূরা আল-মুমতাহিনাহতে বলেছেন: “তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সঙ্গীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যার পূঁজা কর তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলাম এবং আমাদের ও তোমাদের মাঝে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হল; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আন।”[সূরা আল-মম্তাহিনাহ, ৬০: ৪]
কাফেরদেরকে ঘৃণা করা ও তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করার অর্থ এ নয় যে, আপনি তাদের উপর যুলুম করবেন কিংবা তাদের উপর সীমালঙ্ঘন করবেন; যদি না তারা হারবী (যুদ্ধরত শ্রেণীর) না হয়। বরং এর মর্ম হচ্ছে আপনি মনে মনে তাদেরকে ঘৃণা করবেন, মনে মনে তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবেন এবং তারা আপনার বন্ধু হবে না। কিন্তু আপনি তাদেরকে কষ্ট দিবেন না, তাদের ক্ষতি করবেন না, তাদের উপর যুলুম করবেন না। যদি তারা সালাম দেয় সালামের উত্তর দিবেন। তাদেরকে উপদেশ দিবেন। ভাল কাজের দিক নির্দেশনা দিবেন। যেমনটি আল্লাহ্তাআলা বলেছেন: “কিতাবধারীদের সাথে কেবল উত্তম পন্থায় বিতর্ক করবে; তবে তাদের মধ্যে যারা জালেম তাদের সাথে নয়।”[সূরা আল-আনকাবুত, ২৯:৪৬]
কিতাবধারী হচ্ছে— ইহুদী ও খ্রিস্টানরা। অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য অন্যান্য কাফেরদের ক্ষেত্রেও— যাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে কিংবা অঙ্গীকার দেয়া হয়েছে কিংবা জিম্মা দেয়া হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে যারা জুলুম করেছে তাদেরকে তাদের জুলুম অনুপাতে শাস্তি দেয়া যাবে। অন্যথায় মুমিনদের জন্য শরয়ি বিধান হলো পূর্বোক্ত আয়াতে কারীমার ভিত্তিতে মুসলিম ও কাফেরদের সাথে উত্তম পন্থায় বিতর্ক করা...।[মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বায (৫/২৪৬) থেকে সমাপ্ত]
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: মৈত্রী ও শত্রুতা কী?
জবাব: আল্লাহ্র জন্য শত্রুতা ও মৈত্রী হচ্ছে আল্লাহ্তাআলা যা কিছু থেকে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা করেছেন সেগুলো থেকে ব্যক্তি নিজের সম্পর্কচ্ছেদ করা; যেমনটি আল্লাহ্তাআলা বলেছেন: “তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সঙ্গীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলাম এবং আমাদের ও তোমাদের মাঝে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হল।”[সূরা আল-মম্তাহিনাহ, ৬০:৪] এই বিধান মুশরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেমনটি আল্লাহ্তাআলা বলেছেন: “আর মহান হজ্জের দিনে আল্লাহ্ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি একটি ঘোষণা এই যে, আল্লাহ্মুশরিকদের ব্যাপারে সবরকমের দায় থেকে মুক্ত এবং তার রাসূলও।”[সূরা তাওবা, ৯: ৩] তাই প্রত্যেক মুমিনের উপর ওয়াজিব হল প্রত্যেক মুশরিক ও কাফের থেকে নিজেকে অবমুক্ত রাখা। এ বিধান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।
অনুরূপভাবে মুসলিমের উপর ওয়াজিব হল এমন প্রত্যেক কর্ম থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করা যে কর্মের প্রতি আল্লাহ্ও তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট নন; এমনকি যদি সেটা কুফর না হয়ে পাপাচার ও অবাধ্যতা হয় তবুও। যেমনটি আল্লাহ্তাআলা বলেছেন: “কিন্তু আল্লাহ্ঈমানকে তোমাদের নিকট পছন্দনীয় করেছেন, তোমাদের অন্তরে শোভনীয় করেছেন এবং কুফরি, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে তোমাদের নিকট অপছন্দনীয় করেছেন। এরাই হেদায়েতপ্রাপ্ত।”[সূরা হুজুরাত, ৪৯: ৭][ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম (পৃষ্ঠা-১৮৩) থেকে সমাপ্ত]
শাইখ সালেহ আল-ফাওযান (হাফিঃ) ‘নাওয়াকিযুল ঈমান’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-১৫৮) বলেন: শাইখ (রহঃ) কাফেরের সাথে মিত্রতার একটি প্রকার উল্লেখ করেছেন। সেটি হচ্ছে— যুদ্ধে সহযোগিতা। যদিও মৈত্রী অন্তরের ভালোবাসা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করা, তাদের স্তুতি ও প্রশংসা করা ইত্যাদিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। কেননা আল্লাহ্তাআলা কাফেরদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা, ঘৃণা করা ও তাদের সাথে সম্পর্কছিন্ন করা মুসলমানদের উপর ওয়াজিব করেছেন। ইসলামে এ অধ্যায়কে বলা হয়: মৈত্রী ও শত্রুতা।[সমাপ্ত]
মিত্রতা ও শত্রুতা পরিভাষাটির সাথে খারেজিদের সম্পর্ক:
‘মৈত্রী ও শত্রুতা’ এ কথার সাথে খারেজিদের বিশেষ কোন সম্পর্ক আছে মর্মে আমাদের জানা নেই। তবে বর্তমান যামানায় তাকফির (কাফের বলা)-এর ক্ষেত্রে যারা বাড়াবাড়ি করছে হতে পারে তাদের সাথে এ বিষয়টির সম্পৃক্ততা রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে এ মাসয়ালাটি ও এর অধিভুক্ত বিষয় বুঝার ক্ষেত্রে তাদের ত্রুটি; নিছক শিরোনামটি নয়।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।