বৃহস্পতিবার 6 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 7 নভেম্বর 2024
বাংলা

কোন প্রকার গান-বাজনা বা হারাম কাজে লিপ্ত না হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মবার্ষিকী পালন করার হুকুম কি?

প্রশ্ন

আমার প্রশ্ন হচ্ছে- স্পেনে মিলাদুন্নবী বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মবার্ষিকী পালন করা প্রসঙ্গে। আমরা নিম্নোক্ত উদ্দেশ্য এ উপলক্ষকে কাজে লাগই— একতাবদ্ধ থাকা, ভ্রাতৃত্ববোধ মজবুত করা, বাচ্চাদের একে অপরের সাথে পরিচিত হওয়া, তাদের মাঝে পারস্পারিক সম্পর্ক তৈরী হওয়া, বাচ্চাদেরকে নিজ ধর্ম নিয়ে গৌরববোধের উপদেশ দেওয়া এবং কারনিভাল ও ভ্যালেনটাইন ডে এর মত যেসব বিধর্মীয় উৎসব বাচ্চাদের মনমগজকে বিকৃত করে দেয় সেগুলো থেকে তাদেরকে হেফাযত করা।

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

সিরাতগ্রন্থ লেখকগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মতারিখ নিয়ে মতভেদ করেছেন। তবে তারা একমত যে, হিজরী ১১ সালের ১২ই রবিউল আউয়াল নবী সাল্লাল্লাহু এর মৃত্যু দিবস। অথচ সাধারণ মুসলমানেরা এ দিনটিকে “ঈদে মিলাদুন্নবী” আখ্যায়িত করে এ দিনটি উদযাপন করে থাকে।

বিস্তারিত জানতে 125690 নং প্রশ্নোত্তরটি দেখুন।

দুই:

ইসলামী শরিয়তে “ঈদে মিলাদুন্নবী” বলে কোন কিছু নেই। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন কিংবা মুসলিম উম্মাহর ইমামগণ এ ধরণের কোন দিবস জানতেন না; থাকতো তাঁরা এমন কোন দিবস উদযাপন করবেন। বরঞ্চ বাতেনীপন্থী কিছু মূর্খ বিদাতি এটি উদ্ভাবন করেছে। পরবর্তীতে বিশ্বের আনাচে-কানাচের সাধারণ মুসলমানেরা এ বিদআতটি পালন করে আসছে।

এ দিনটি উদযাপন করা যে বিদআত এ সম্পর্কে 10070 নং প্রশ্নোত্তরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

তিন:

সুন্নাহপ্রেমী কিছু কিছু ভাই আছেন যারা তাদের দেশে উদযাপিত এ অনুষ্ঠানাদির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন; তারা এ বিদআত থেকে বাঁচার জন্য নিজের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে একত্রিত হন এবং এ উপলক্ষে বিশেষ খাবার রান্না করে সবাই মিলে একত্রে খান। এদের মধ্যে কেউ কেউ এ উদ্দেশ্যে নিজের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদেরকেও একত্রিত করেন। আবার কেউ কেউ অন্য লোকদেরকে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিরাত (জীবনী) পড়া ও দ্বীনি আলোচনা পেশ করার ব্যবস্থা করেন। বিদেশে ও বিধর্মীদের দেশে আপনারা একতাবদ্ধ থাকা ও দ্বীনি চেতনাকে উজ্জীবিত করার মত ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে যা করতে চাচ্ছেন সেটা এ প্রকারের পর্যায়ভুক্ত।

বাস্তবতা হচ্ছে- এ ভাল নিয়তগুলো এমন সমাবেশগুলোকে শরয়ি বৈধতা দিবে না। বরং এগুলো গর্হিত বিদআত; সেটাই বলবৎ থাকবে। বরং আপনারা যদি উৎসব করতে চান তবে মুসলমানদের উৎসব হচ্ছে- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা এ দুইটি। যদি এর চেয়ে বেশি উৎসব চান তবে জুমার দিন আমাদের সাপ্তাহিক ঈদ বা উৎসব। জুমার দিন আপনারা জুমার নামাযে একত্রিত হতে পারেন এবং দ্বীনি চেতনা উজ্জীবিত করতে পারেন।

যদি আপনাদের পক্ষে সেটি সম্ভবপর না হয় তাহলে বছরে দিনের সংখ্যা অনেক; যে কোন সময় আপনারা সমবেত হতে পারেন; তবে বিদাতী ঈদকে উপলক্ষ করে নয়। বরং যে কোন বৈধ উপলক্ষে হতে পারে যেমন- বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা কোন ভোজ অনুষ্ঠান কিংবা কোন আকিকার অনুষ্ঠান কিংবা কোন ভাল কাজের অভিনন্দন জ্ঞাপনের অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষগুলোর যে কোনটি আপনারা যে উদ্দেশ্যগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন- পারস্পারিক যোগাযোগ রাখা, একতাবদ্ধ থাকা, দ্বীনি মেজাজ ধরে রাখা সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য হতে পারে।

মিলাদুন্নবী উপলক্ষে এ জাতীয় নিয়ত নিয়ে সমবেত হওয়ার হুকুম সম্পর্কে আলেমগণের কিছু ফতোয়া নিম্নরূপ:

১। ইমাম আবু হাফস তাজুদ্দিন আল-ফাকিহানি (রহঃ) নানা প্রকার মিলাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: ক. ব্যক্তি তার নিজের অর্থ খরচ করে তার পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে মিলাদ পালন করা, এ সমাবেশকে শুধু খাবার গ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, এছাড়া অন্য কোন গুনাহতে লিপ্ত না হওয়া। ইতিপূর্বে আমরা যে বিদআতের কথা উল্লেখ করেছি এটাই হচ্ছে সে গর্হিত ও ঘৃণিত বিদআত। কারণ পূর্ববর্তী কোন সলফে সালেহীন, ইসলামের ফকীহগণ, যামানার সূর্য আলেমগণ এসব পালন করেননি।[আল-মাওরেদ ফি আমালিল মাওলিদ, পৃষ্ঠা-৫]

২। ইবনুল হাজ্জ আল-মালেকী (রহঃ) গান-বাজনা ও নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা এ জাতীয় শরিয়ত গর্হিত কার্যাবলী মুক্ত মিলাদুন্নবী পালনের হুকুম সম্পর্কে বলেন: যদি এ থেকে মুক্ত হয়, শুধুমাত্র খাবারের আয়োজন করা হয়, এর দ্বারা মিলাদ বা রাসূলের জন্মদিন পালনের নিয়ত করা হয়, এ উদ্দেশ্যে বন্ধুমহলকে দাওয়াত করা হয় এবং ইতিপূর্বে উল্লেখিত বিষয়াবলী থেকে মুক্ত হয় তদুপরি শুধু এ নিয়তের কারণে এটি পালন করা বিদআত। কেননা এটা পালন করা ইসলামী শরিয়তে একটি নতুন সংযোজন; যা পূর্ববর্তী সলফে সালেহীন পালন করেননি। সলফে সালেহীন যে অবস্থায় ছিলেন সেটা থেকে কোন কিছু না বাড়িয়ে তাদের অনুসরণ করাই উত্তম; বরং অপরিহার্য। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ অনুসরণ ও সুন্নাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে তাঁরা ছিলেন সর্বাধিক আগ্রহী। এক্ষেত্রে তাঁদের অগ্রবর্তিতা সাব্যস্ত। তাঁদের কেউ মিলাদ পালন করেছেন মর্মে জানা যায় না। আমরা হচ্ছি তাঁদের অনুগামী। যা কিছু তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল সেটা পালন করা আমাদের জন্যেও যথেষ্ট। জ্ঞানগত ক্ষেত্রে ও আমলী ক্ষেত্রে তাঁদেরকেই অনুসরণ করতে হবে এটা জ্ঞাত বিষয়; যেমনটি শাইখ ইমাম আবু তালেব আল-মাক্কী (রহঃ) তাঁর লিখিত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।[আল-মাদখাল, ২/১০]

৩। তিনি আরও বলেন: কেউ কেউ এটি থেকে –অর্থাৎ হারাম কিছু শ্রবণ থেকে- বিরত থাকেন। এর বদলে সহিহ বুখারী কিংবা অন্য কিছু পড়ার মাধ্যমে মিলাদ পালন করেন। হাদিস পড়া বড় নেকীর কাজ ও ইবাদত, হাদিস পড়ার মধ্যে রয়েছে প্রভূত কল্যাণ ও অঢেল বরকত; তবে এ পড়া যদি হয় শরিয়তসম্মত পদ্ধতি ও শর্ত মোতাবেক; মিলাদ পালনের নিয়তে নয়। আপনি দেখছেন না— নামায সবচেয়ে বড় নেকীর কাজ; তা সত্ত্বেও কেউ যদি শরিয়তের অনুমোদনহীন সময়ে নামায আদায় করে সেটি নিন্দনীয় ও গর্হিত। যদি নামাযের ক্ষেত্রে এমন বিধান হয় তাহলে অন্য বিষয়ের ক্ষেত্রে কেমন হবে?![আল-মাদখাল ২/২৫]

সারাংশ:

আপনারা যেসব উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করলেন- একতাবদ্ধ থাকা, উপদেশ ও দিকনির্দেশনা দেয়া ইত্যাদি উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতেও এ ধরণের সমাবেশ করা আপনাদের জন্য জায়েয হবে না। এ উদ্দেশ্যগুলো আপনারা অন্য কোন সময় বাস্তবায়ন করতে পারেন। আপনারা বছরের যে কোন সময় সমাবেশ করতে পারেন। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আপনাদেরকে ভাল কাজ করার তাওফিক দেন এবং আপনাদের জন্য হেদায়েত ও তাওফিকের পরিধি বাড়িয়ে দেন।

আল্লাহই ভাল জানেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব