শুক্রবার 21 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 22 নভেম্বর 2024
বাংলা

ঘুমের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ

প্রশ্ন

আমি জানতে চাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে ঘুমাতেন? তিনি কি খাটে ঘুমাতেন; নাকি মাটিতে? ঘুমাতে চাইলে তিনি কি নির্দিষ্ট কোনো দোয়া পড়তেন?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো বিছানায়, কখনো চামড়ার বিছানায়, কখনো চাটাইতে, কখনো মাটিতে, কখনো চকিতে, কখনো বালুর মধ্যে, আবার কখনো কালো চাদরে ঘুমাতেন।

আব্বাদ ইবনে তামীম বর্ণনা করেন, তিনি তার চাচা থেকে বর্ণনা করেন: আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মসজিদে এক পা অন্য পায়ের উপর রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছি।[হাদীসটি বর্ণনা করেন বুখারী (৪৭৫) ও মুসলিম (২১০০)]।

তাঁর বিছানা ছিল চামড়ার তৈরি, যার ভেতরে ছিল খেজুর গাছের আঁশ। তাঁর ছিল পশমের এক মোটা চাদর। সেটাকে দুই ভাঁজ করে তিনি এর উপর ঘুমাতেন।

সারকথা তিনি বিছানায় ঘুমাতেন এবং গায়ের উপর লেপ দিয়ে ঢেকে নিতেন। তিনি তাঁর স্ত্রীদেরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন: “তোমাদের মধ্যে আয়িশা ছাড়া অন্য কোন স্ত্রীর লেপের ভেতরে থাকা অবস্থায় আমার কাছে জিব্রীল আসেনি।”[বুখারী: (৩৭৭৫)]

তাঁর বালিশ ছিল চামড়ার, যার ভেতরটা খেজুর গাছের আঁশে পূর্ণ ছিল। তিনি ঘুমানোর জন্য বিছানায় শুয়ে বলতেন:

‌بِاسْمِكَ اللَّهُمَّ أمُوتُ وَأحْيَا (উচ্চারণ: বিস্‌মিকাল্লা-হুম্মা আমূতু ওয়া আহ্ইয়া।) (অর্থ: হে আল্লাহ্‌! আপনার নাম স্মরণ করেই আমি মৃত্যুবরণ করি এবং আপনার নাম স্মরণ করেই আমি বেঁচে আছি।)[বুখারী: (৭৩৯৪)]।

তিনি নিজের দুই হাতের তালু একত্র করে তাতে ফুঁ দিতেন। হাতদ্বয়ের মধ্যে ‘কুলহুয়াল্লাহু আহাদ’, ‘কুল আউযু বি-রাব্বিল ফালাক্ব’ এবং ‘কুল আউযু বি-রাব্বিন্নাস’ পড়তেন। এরপর হাতদ্বয় দিয়ে শরীরের যতটুকু সম্ভব হত মুছতেন। মাথা ও চেহারা থেকে শুরু করতেন এবং শরীরের সামনের অংশ মুছতেন। এভাবে তিনবার করতেন।

তিনি ডান কাতে ঘুমাতেন। ডান হাত ডান গালের নিচে রাখতেন। তারপর বলতেন: اللَّهُمَّ ‌قِنِي ‌عَذَابَكَ، يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ (হে আল্লাহ! আপনি যেদিন আপনার বান্দাদেরকে পুনরায় জীবিত করবেন, সেদিন আমাকে আযাব থেকে রক্ষা করুন।)

তিনি বিছানায় যাওয়ার পর পড়তেন: الحَمْدُ للَّهِ الَّذِي أطْعَمَنَا وسَقَانَا، وكَفَانَا، وآوَانا؛ فَكَمْ مِمَّنْ لا كَافِيَ لَهُ وَلا مُؤْوِيَ (সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য, যিনি আমাদেরকে আহার করিয়েছেন, পান করিয়েছেন, আমাদের প্রয়োজন পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন। কারণ এমন বহু লোক আছে, যাদের কোনো প্রয়োজন পূর্ণকারী এবং আশ্রয়দাতা কেউ নেই।) ইমাম মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও বর্ণনা করেন যে, তিনি যখন বিছানায় যেতেন তখন পড়তেন:

اللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَوَاتِ والأرْضِ، ورَبَّ العَرْشِ العَظِيمِ، رَبَّنَا ورَبَّ كُلِّ شَيءٍ، فالِقَ الحَبِّ ‌والنَّوَى، َمُنْزِلَ التَّوْرَاةِ والإنْجِيلِ والفُرْقَانِ، أعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ ذِيْ شَرٍّ أنْتَ آخِذٌ بِنَاصِيتهِ، أنْتَ الأوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيءٌ، وأنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيءٌ، وأنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيءٌ، وأنْتَ البَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيءٌ، اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ، وَأَغْنِنَا مِنَ الفَقْرِ.

(হে আল্লাহ! হে আকাশমণ্ডলি ও যমীনের রব, মহান আরশের রব, আমাদের রব ও প্রত্যেক বস্তুর রব! হে শস্য-বীজ ও আঁটিকে বিদীর্ণকারী! হে তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআন অবতীর্ণকারী! আমি এমন অনিষ্টকারীর অনিষ্ট থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাইছি, যার (মাথার) অগ্রভাগ আপনি ধরে রেখেছেন (নিয়ন্ত্রণ করছেন)। হে আল্লাহ! আপনিই প্রথম, আপনার আগে কিছুই নেই। আপনি সর্বশেষ, আপনার পরে কোনো কিছু নেই। আপনি আয-যাহির (সব কিছুর উপরে) আপনার উপরে কিছুই নেই। আপনি আল-বাতিন (সূক্ষদর্শী) আপনার চেয়ে নিকটবর্তী কেউ নেই। আপনি আমাদের সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে দিন এবং আমাদেরকে অভাবগ্রস্ততা থেকে মুক্ত করুন।)[মুসলিম: (২৭১৩)]

তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর বলতেন:

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا ‌أمَاتَنَا وإِلَيْهِ النُّشُورُ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি (নিদ্রারূপ) মৃত্যুর পর আমাদেরকে জীবিত করেছেন। আর তাঁর নিকটই সবার পুনরুত্থান।”[বুখারী (৬৩১২) বর্ণনা করেছেন]

এরপর তিনি মিসওয়াক করতেন। কখনও কখনও সূরা আলে-ইমরানের শেষ থেকে দশ আয়াত পড়তেন। আল্লাহর বাণী: ‌إِنَّ ‌فِي ‌خَلۡقِ ‌ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ... থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত।[আলে-ইমরান: ১৯০-২০০]

তিনি আরো বলতেন:

اللَّهُمَّ لَكَ الحَمْدُ أنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ والأرْضِ ومَنْ فِيهنَّ، ولَكَ الحَمْدُ أنْتَ قَيِّمُ السَّمَوَاتِ والأرْضِ ومَنْ فيهنَّ، وَلَكَ الحَمْدُ أنْتَ الحَقُّ، وَوَعْدُكَ الحَقُّ، ولِقَاؤُكَ حَقُّ، والجَنَّةُ حَقٌّ، والنَّارُ حَقٌّ، والنَّبِيُّونَ حَقٌّ، وَمُحَمَّدٌ حَقٌّ، والسَّاعَةُ حَقٌّ. اللَّهُمَّ لَكَ أسْلَمْتُ، وبِكَ آَمَنْتُ، وعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ، وإلَيْكَ أنَبْتُ، وَبِكَ خَاصَمْتُ، وإليْكَ حَاكَمْتُ. فاغْفِرْ لِي مَا قَدَّمْتُ، ومَا أخَّرْتُ، ومَا أسْرَرْتُ، ومَا أعْلَنْتُ أنْتَ إلَهِي لَا إِلَهَ إلَاّ أنْتَ 

(হে আল্লাহ! সকল প্রশংসা আপনারই জন্য। আসমানসমূহ, যমীন এবং এ দুটোর মাঝে যা কিছু আছে আপনিই এগুলোর নূর (আলো)। সকল প্রশংসা আপনারই জন্য; আসমানসমূহ, যমীন ও এ দুটির মাঝে যা আছে আপনিই এসবের রক্ষণাবেক্ষণকারী পরিচালক। সকল প্রশংসা আপনারই জন্য। আপনিই সত্য, আপনার ওয়াদা সত্য, আপনার সাক্ষাৎ লাভ সত্য, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, নবীরা সত্য, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য ও কিয়ামত সত্য। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করেছি, আপনার উপরই ঈমান এনেছি, আপনার উপরই ভরসা করেছি, আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন করেছি, আপনার সাহায্যে বা আপনার জন্যই শত্রুর সাথে বিবাদে লিপ্ত হই, আর আপনার কাছেই বিচার পেশ করি। অতএব আমার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিন; যে গুনাহ আগে করেছি, পরে করেছি, গোপনে করেছি বা প্রকাশ্যে করেছি। আপনি আমার উপাস্য। আপনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য সত্য নয়।”[বুখারী: (১১২০)]।

তিনি রাতের প্রথমভাগে ঘুমাতেন; আর শেষভাগে নামায আদায় করতেন। কখনও কখনও মুসলিমদের কল্যাণে রাতের প্রথমভাগে জেগে থাকতেন। তাঁর দু’চোখ ঘুমাত; কিন্তু অন্তর ঘুমাত না। তিনি ঘুমিয়ে পড়লে অন্যরা তাকে জাগিয়ে তুলত না যতক্ষণ না তিনি নিজে থেকে জেগে উঠতেন।

তিনি সফরের মধ্যে রাতের বেলায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামলে ডান কাতে শয়ন করতেন। আর ফজরের আগ মুহূর্তে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামলে হাতের বাহু দাঁড় করিয়ে হাতের তালুর উপর মাথা রেখে শুয়ে থাকতেন। তিরমিযী এমনটা বলেছেন।

তাঁর ঘুম ছিল সর্বাধিক পরিমিত। এই ঘুম সবচেয়ে উপকারী ঘুম। চিকিৎসকরা বলেন: এই ঘুম হলো দিবানিশার এক তৃতীয়াংশ ঘুমানো; আর তা হলো আট ঘণ্টা।

সূত্র: যাদুল মা‘আদ (১/১৫৫)