শুক্রবার 21 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 22 নভেম্বর 2024
বাংলা

সাধারণ মানুষের উপর আবশ্যক স্থানীয় আলেমদের তাকলীদ করা এবং তাদের মতামতের বাইরে না যাওয়া

প্রশ্ন

সাধারণ মুসলিমের জন্য ফতোয়া জিজ্ঞেস করা এবং যে কোন আলেমের উক্তি গ্রহণ করা কি জায়েয? নাকি তার উপর আবশ্যক হলো সে যে দেশে বাস করে সে দেশের স্থানীয় আলেমদের কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত:

প্রথম ভাগ: মুজতাহিদ আলেম। তিনি এমন ব্যক্তি যার কাছে কুরআন-হাদিসের ভাষ্য থেকে সরাসরি বিধান নির্ণয় করার যোগ্যতা রয়েছে। এমন ব্যক্তির জন্য অন্য কোন আলেমের তাকলীদ করা জায়েয নয়। বরং তিনি তাঁর ইজতিহাদের অনুসরণ করবেন; সেটি তার যামানার আলেমদের অভিমতের মোতাবেক হোক; কিংবা বিরোধী হোক।

দ্বিতীয় ভাগ: ইলমে দ্বীন চর্চায় অভিজ্ঞ তালিবুল ইলম। যার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, তিনি আলেমদের মতভেদপূর্ণ উক্তিগুলোর মাঝে প্রাধান্য দেয়ার যোগ্যতা রাখেন; যদিও তিনি ইজতিহাদের স্তরে না পৌঁছে থাকেন। এমন ব্যক্তির জন্যেও কোন আলেমের তাকলীদ করা আবশ্যকীয় নয়। বরং তিনি আলেমদের মতামতগুলোর মধ্যে তুলনা করে নিজের কাছে যেটাকে অগ্রগণ্য মনে হয় সেটার অনুসরণ করবেন।

তৃতীয় ভাগ: সাধারণ মানুষ। যাদের কাছে যথেষ্ট শরয়ি ইলম নাই; যার মাধ্যমে তারা আলেমদের মতভেদগুলোর মাঝে প্রাধান্য দেয়ার যোগ্য হবেন। এ শ্রেণীর লোকদের পক্ষে কুরআন-হাদিসের ভাষ্য থেকে বিধান নির্ণয় করা সম্ভবপর নয়, আলেমদের মতভেদগুলোর মধ্যে প্রাধান্য দেয়াও সম্ভবপর নয়। তাই তাদের উপর আবশ্যক হলো আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করা এবং তাদের মতামতের অনুসরণ করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: তোমরা আলেমগণকে জিজ্ঞেস কর; যদি তোমরা না জান।[সূরা নাহল, ১৬: ৪৩]

তাদের উপর আবশ্যক তাদের সমকালীন আলেমদের তাকলীদ করা; বরং তাদের স্থানীয় আলেমদের তাকলীদ করা। যাতে করে তাদের জন্য এমন কোন পথ না খোলা হয় যে, তারা আলেমদের অভিমতগুলোর মধ্য থেকে যেটা খুশি সেটার অনুসরণ করবেন; অথচ অভিমতগুলোর মধ্যে প্রাধান্য দেয়ার যোগ্যতা তাদের নেই। তারা সবসময় সহজ ও তাদের প্রবৃত্তির মোতাবেক অভিমতটি বাছাই করে নিবে। এর পরিণতিতে ব্যাপক মতভেদ ও মতপার্থক্য সংঘটিত হবে এবং মানুষ একটু একটু করে দ্বীনি বিধি-বিধান থেকে মুক্ত হতে থাকবে।

আলেমগণ এই তিন প্রকার মানুষের কথা সুস্পষ্টভাবে ঊদ্ধৃত করেছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকার মানুষের কথা ‘আল-তুফী’ তাঁর ‘মুখতাছারুর রাওযা’ গ্রন্থে (৩/৬২৯) বলেন:

“যদি কোন মুজতাহিদ আলেম ইজতিহাদ করেন এবং তার প্রবল ধারণা হয় যে, এটাই বিধান তার জন্য অন্য কারো তাকলীদ করা সর্বসম্মতিক্রমে নাজায়েয। অর্থাৎ এতে কোন দ্বিমত নেই।

আর যে ব্যক্তি কোন বিধান নিয়ে এখনও ইজতিহাদ করেননি; তবে ইজতিহাদ করার যোগ্যতা থাকার কারণে নিকটবর্তী শক্তি প্রয়োগ করে তিনি নিজে বিধানটি জানতে সক্ষম তার জন্যেও অন্যের তাকলীদ করা নাজায়েয। সেই অন্য তার চেয়ে বেশি জ্ঞানী হোক কিংবা কম জ্ঞানী হোক; সাহাবীদের কেউ হোক কিংবা অন্য কেউ হোক।[সমাপ্ত]

আর তৃতীয় শ্রেণী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ‘তানক্বীহুল ফাতাওয়াল হামিদিয়্যা’-তে (৭/৪৩১) এসেছে: “টীকা: সাধারণ মানুষের কাজ হলো ফিকাহবিদদের অভিমতকে আঁকড়ে ধরা এবং তাদের কথ ও কাজের অনুসরণ করা...। সাধারণ ব্যক্তির পূর্ববর্তীদের অভিমতগুলো থেকে নির্বাচন করার অধিকার নেই। তবে সমকালীন আলেমদের অভিমতগুলো থেকে সে নির্বাচন করতে পারেন যদি সমকালীন আলেমরা সবাই ইলম, সত্যবাদিতা ও আমানতদারিতাতে সমমানের হয়। যে ব্যক্তি নতুন কোন মাসয়ালার মুখোমুখি হয়েছেন এবং তার যামানার আলেমগণ তাকে সাহাবীদের অভিমতগুলো জানাল সেই অজ্ঞ ব্যক্তির তাদের অভিমতগুলো থেকে কোন একটিকে নির্বাচন করার অধিকার থাকবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন আলেম দলিলের ভিত্তিতে তার জন্য নির্বাচন করে দেন।”[সমাপ্ত]

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন: “মানুষের স্তরভেদ রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ ইজতিহাদের স্তরে। কেউ এর নীচে। তাদের মধ্যে কেউ কোন এক মাসয়ালার ক্ষেত্রে মুজতাহিদ, এই মাসয়ালার খুঁটিনাটি জানে, গবেষণা করতে পারে, সত্য উদঘাটন করতে পারে; কিন্তু অন্য মাসয়ালায় পারে না। তাদের মধ্যে কেউ আছে কিছুই জানে না। তাই সাধারণ মানুষের মাযহাব হচ্ছে তাদের আলেমদের মাযহাব। এ কারণে কোন ব্যক্তি যদি আমাদেরকে বলে যে, অবশ্যই আমি সিগারেট খাব। যেহেতু অন্য মুসলিম দেশে এমন ব্যক্তি আছেন যিনি বলেন: সিগারেট খাওয়া জায়েয। আমার তাকলীদ করার অধিকার আছে। আমরা তাকে বলব: আপনি এটি করতে পারেন না। কারণ আপনার উপর আবশ্যক তাকলীদ করা। আপনার দেশের আলেমগণের তাকলীদ করার অধিকার অগ্রগণ্য। যদি আপনি অন্য দেশের কারো তাকলীদ করেন তাহলে এমন বিষয়ের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা হবে যাতে কোন শরয়ি দলিল নেই। যদি কেউ বলে যে, সে দাঁড়ি ফেলে দিবে। কেননা কোন কোন দেশের আলেমগণ বলেন: এতে কোন অসুবিধা নেই। আমরা বলব: এটা হতে পারে না। আপনার কর্তব্য তাকলীদ করা। আপনি আপনার দেশের আলেমদের সাথে মতভেদ করতে পারেন না। কেউ যদি বলে আমি নেককারদের কবরের চতুর্দিকে তাওয়াফ করতে চাই। কেননা কোন কোন দেশের আলেম বলেন: এতে অসুবিধা নেই। কিংবা বলে: আমি তাদের ওসিলা দিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করতে চাই। কিংবা এ জাতীয় কোন কথা। আমরা বলব: এটি হতে পারে না। সাধারণ মানুষের দায়িত্ব তার দেশের নির্ভরযোগ্য আলেমদের তাকলীদ করা; যাদের প্রতি তার আস্থা হয়। এটি আমাদের শাইখ আব্দুর রহমান আস-সা’দী (রহঃ) উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন: সাধারণ মানুষ তাদের দেশের বাইরের আলেমদের তাকলীদ করবে না। কেননা এর ফলে বিশৃঙ্খলা ও বিভেদ ঘটবে। যদি কেউ বলে: আমি উটের গোশত খেয়ে ওযু করব না। কেননা কোন কোন দেশের আলেমগণ বলেন: উটের গোশত খেয়ে ওযু করা ওয়াজিব নয়। আমরা বলব: এটি হতে পারে না। ওযু করা আপনার উপর আবশ্যক। কেননা এটি আপনার মাযহাবের আলেমদের মাযহাব। আপনি যাদের মুকাল্লিদ (তাকলীদ করেন)।”[লিকাআতুল বাব আল-মাফতুহ (১৯/৩২)]

তিনি আরও বলেন: “আর সাধারণ মানুষকে স্থানীয় আলেমগণের অভিমত মানতে বাধ্য করা হবে; যাতে করে সাধারণ মানুষ বিশৃঙ্খল না হয়। কেননা আমরা যদি সাধারণ মানুষকে বলি: আপনি যে কোন অভিমত পান না কেন সেটা গ্রহণ করতে পারেন তাহলে এই উম্মত এক উম্মত থাকবে না। এ কারণে আমাদের শাইখ আব্দুর রহমান সা’দী বলেন: ‘সাধারণ মানুষের মাযহাব তাদের আলেমগণের মাযহাব। উদাহরণতঃ আমাদের এখানে সৌদি আরবে নারীর ওপর মুখ ঢাকা ওয়াজিব। আমরা আমাদের নারীদেরকে তা করতে বাধ্য করব। যদি আমাদেরকে কোন নারী বলে যে, আমি অমুক মাযহাবের অনুসরণ করব। সে মাযহাবে মুখ খোলা জায়েয। আমরা বলব: আপনার সেটা করার অধিকার নেই। কেননা আপনি সাধারণ মানুষ। আপনি ইজতিহাদের স্তরে পৌঁছেননি। আপনি সেই মাযহাব অনুসরণ করতে ইচ্ছুক যেহেতু সেটি ছাড়। এভাবে ছাড় খুঁজে খুঁজে আমল করা হারাম। তবে কোন আলেমের ইজতিহাদ (ফিকহী গবেষণা)-এর ফলাফল যদি এটা হয় যে, নারীর চেহারা খোলা রাখা; তাহলে এতে কোন অসুবিধা নেই। তিনি যদি বলেন: আমি আমার নারীর চেহারা খোলা রাখব। সেক্ষেত্রে আমরা বলব: এতে অসুবিধা নাই। তবে তিনি এমন দেশে তার স্ত্রীর চেহারা খোলা রাখতে দিবেন না যেই দেশের নারীরা মুখ ঢেকে চলে। এটি তাকে করতে দেয়া হবে না। কারণ তিনি অন্যকে নষ্ট করবেন। কারণ এই মাসয়ালায় মুখ ঢাকা যে উত্তম এতে সবাই একমত। মুখ ঢাকা যদি উত্তম হয় আর আমরা যদি তাকে উত্তমটি করতে বাধ্য করি তাহলে আমরা তাকে তার মাযহাব অনুযায়ী হারাম কিছু করতে বাধ্য করলাম না। বরং আমরা তাকে তার মাযহাব অনুযায়ী উত্তমটি করতে বাধ্য করলাম। এবং অন্য আরেকটি কারণে বাধ্য করলাম সেটা হলো যাতে করে এই রক্ষণশীল দেশের অন্য কেউ তার তাকলীদ না করে। অন্যথায় বিভেদ হবে এবং ঐক্য নষ্ট হবে। পক্ষান্তরে তিনি যদি তার দেশে ফিরে যান আমরা তাকে আমাদের অভিমত মানতে বাধ্য করব না; যেহেতু মাসয়ালাটি ইজতিহাদযোগ্য, এই মাসয়ালার দলিলগুলো পর্যালোচনা করা ও প্রাধান্য দেয়ার অবকাশ রয়েছে।”[লিক্বাআতুল বাব আল-মাফতুহ (১৯/৩২)]

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব