রবিবার 21 জুমাদাল ছানী 1446 - 22 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

ভালোবাসার প্রকারভেদ ও বিধি-বিধান

প্রশ্ন

আমরা একদল মুসলিম। ইসলামে ভালোবাসার সংজ্ঞা কী তা নিয়ে আমাদের মাঝে কথোপকথন হয়। যদিও আমরা সবাই পুরোপুরি জানি যে মহান আল্লাহকে ভালোবাসা জরুরী এবং তাঁর সাথে তাঁর নবী-রাসূলদেরকেও ভালোবাসা আবশ্যক। কিন্তু আমরা এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করছিলাম যে, মানুষের মধ্যকার ভালোবাসার কি কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা আছে কিনা (যেমন: খ্রিষ্টধর্মে ভ্রাতৃসুলভ ভালোবাসা, রোমান্টিক ভালোবাসা নয়)। কেউ কেউ বলল: ভালোবাসা শুধু পরিবারের পরিসরেই পাওয়া যেতে পারে। এর বাইরে কেবল সম্মান ও বন্ধুত্ব ইত্যাদি আছে। কারো কারো প্রশ্ন ছিল যে ভালোবাসা কি শুধু স্বামী ও সন্তানদের মাঝেই সীমিত? আবার কারো প্রশ্ন ছিল ভালোবাসা কি শর্তযুক্ত হতে পারে? কারো মত ছিল ‘ভালোবাসা’ (প্রচলিত ব্যবহার অনুযায়ী) একটি বিদাত; যা কল্পকাহিনী ও খ্রিষ্টীয় দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমরা অনেকে নানান উৎস থেকে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অকাট্য উত্তর পাইনি। আপনি কি আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবেন?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

প্রশ্নকর্ত্রী বোন,

আসসালামু আলাইকুম ওয়া-রাহমাতুল্লাহি ওয়া-বারাকাতুহু। অতঃপর,

আপনি আপনার বোনদের সাথে ঈমান ও ইসলামের বিষয়গুলো নিয়ে পরস্পর যে আলোচনা করেন সেটি আমাদের হৃদয়কে প্রশান্ত করছে। তারই ধারাবাহিকতায় আপনারা ভালোবাসা নিয়ে আলোচনা করেছেন। নিঃসন্দেহে আপনি ও আপনার বোনেরা জানেন যে মতানৈক্য দূর করার ক্ষেত্রে আলেমদের কথা কতটা গুরুত্ববহ এবং শরয়ী বিষয়গুলো বুঝতে হলে তাদের কথায় ফিরে যাওয়া কতটুকু জরুরী। আমরা এখানে ভালোবাসার প্রকারভেদ ও বিধি-বিধান প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করব যাতে ইন শা আল্লাহ আপনাদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।

ভালোবাসার প্রকারভেদ ও বিধি-বিধান:

ভালোবাসাকে বিশেষ ভালোবাসা ও যৌথ ভালোবাসায় বিভক্ত করা যায়। বিশেষ ভালোবাসাকে আবার শরয়ী ভালোবাসা ও হারাম ভালোবাসা এ দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

শরয়ী ভালোবাসা কয়েক প্রকার:

১- আল্লাহর ভালোবাসা। এর বিধান হলো এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব কাজগুলোর একটি। কারণ আল্লাহকে ভালোবাসা হলো দ্বীন ইসলামের মূল। এটির পূর্ণতায় ঈমান পূর্ণতা পায়। আর এটি কমে গেলে তাওহীদ হ্রাস পায়। এর প্রমাণ হলো আল্লাহর বাণী:

وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ

“যারা ঈমানদার, আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা আরো বেশি।”[সূরা বাকারা: ১৬৫] তিনি আরো বলেন:

قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنْ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ

“বলো, যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে এবং আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়ে তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতারা, তোমাদের সন্তানেরা, তোমাদের ভাইয়েরা, তোমাদের স্ত্রীরা, তোমাদের গোত্রীয় লোকেরা, ধন-সম্পদ যা তোমরা উপার্জন করেছো, ব্যবসা-বাণিজ্য যা তোমরা মন্দা হওয়ার আশঙ্কা করো এবং ঘরবাড়ি যা তোমরা পছন্দ করো, তাহলে অপেক্ষা করতে থাকো, যতক্ষণ না আল্লাহ তার বিধান (শাস্তি) নিয়ে আসেন। আল্লাহ ফাসেকদেরকে সঠিক পথ দেখান না।”[সূরা তাওবাহ: ২৪] এছাড়া রয়েছে কুরআন-সুন্নাহর আরো নানান দলীল।

এ ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে বান্দার নিজের ভালোবাসা ও চাওয়ার উপর আল্লাহর ভালোবাসা ও চাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে। তখন আল্লাহ যা ভালোবাসে, তা-ই সে ভালোবাসে। আর আল্লাহ যা ঘৃণা করেন, তা-ই সে ঘৃণা করে। আল্লাহর জন্যই সে মিত্রতা ও শত্রুতা করে। আল্লাহর শরীয়ত মেনে চলে। এই ভালোবাসা গড়ে তোলার নানা উপায় রয়েছে।

২- রাসূলের ভালোবাসা। এটিও দ্বীনের অন্যতম ওয়াজিব। বরং ঈমানের পূর্ণতা ততক্ষণ আসবে না যতক্ষণ না ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলকে তার জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসবে। হাদীসে এসেছে: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “তোমাদের কেউ ততক্ষণ ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তার কাছে আমি তার সন্তান, পিতা এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে প্রিয় না হবো।”[হাদীসটি মুসলিম (৪৪) বর্ণনা করেন] এছাড়া আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে: আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। তিনি উমরের হাত ধরে ছিলেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বললেন, ‘হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমার জান ছাড়া আপনি আমার কাছে সব কিছু চেয়ে অধিক প্রিয়।’ তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “না, যাঁর হাতে আমার প্রাণ ঐ সত্তার কসম! তোমার কাছে আমি যেন তোমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় হই।” তখন উমর তাকে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়।’ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “হে উমর! এখন (তুমি সত্যিকার ঈমানদার হলে)।”[হাদীসটি বুখারী (৬৬৩২) বর্ণনা করেন] এই ভালোবাসা আল্লাহর ভালোবাসার অনুগামী। এটি প্রকাশ পায় তার অনুসরণ করা ও তার কথাকে অন্যের কথার উপর প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে।

৩- নবীগণ ও ঈমানদারদেরকে ভালোবাসা। এটি ওয়াজিব। কারণ আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসলে আল্লাহর অনুগত বান্দাদের ভালোবাসা আবশ্যক হয়ে পড়ে। আর তারা হলেন নবীরা ও নেককার বান্দারা। এর প্রমাণ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ভালোবাসে” অর্থাৎ ঈমানদার ও আল্লাহর অনুগত বান্দাদেরকে ঈমান ও আনুগত্যের জন্য ভালোবাসে। ব্যক্তির নামায-রোযা অনেক বেশি হলেও কেবল এর মাধ্যমেই ঈমান পূর্ণতা পাবে । উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: ‘আল্লাহর রাসূলের যমানায় আমরা এমন অবস্থায় ছিলাম যে আমাদের কেউ অপর মুসলিম ভাইয়ের চেয়ে নিজেকে নিজের দীনার-দিরহামের অগ্রাধিকারী মনে করত না।’

হারাম ভালোবাসা:

এর মাঝে কোনো কোনো ভালোবাসা শির্ক। যেমন: আপনি যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুকে আল্লাহ তাআলার মতো করে ভালোবাসেন। তাহলে আপনি তাঁর সমকক্ষ গ্রহণ করলেন। এটি ভালোবাসার শির্ক। পৃথিবীবাসীর অধিকাংশই ভালোবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে আল্লাহর সমকক্ষ গ্রহণ করেছে।

এর মাঝে কোনো ভালোবাসা শির্কের নিচে; তবে হারাম। আর তা হলো ব্যক্তি তার পরিবার, সম্পদ, গোত্র, ব্যবসা ও ঘরবাড়ি এই সব কিছুকে বা এর কিছু বিষয়কে আল্লাহর আবশ্যক করা কাজের উপর প্রাধান্য দেওয়া; যেমন: হিজরত, জিহাদ ইত্যাদির ওপর। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী: “বলো, যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে এবং আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়ে তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতারা, তোমাদের সন্তানেরা, তোমাদের ভাইয়েরা, তোমাদের স্ত্রীরা, তোমাদের গোত্রীয় লোকেরা, ধন-সম্পদ যা তোমরা উপার্জন করেছো, ব্যবসা-বাণিজ্য যা তোমরা মন্দা হওয়ার আশঙ্কা করো এবং ঘরবাড়ি যা তোমরা পছন্দ করো, তাহলে অপেক্ষা করতে থাকো, যতক্ষণ না আল্লাহ তার বিধান (শাস্তি) নিয়ে আসেন।”[সূরা তাওবা, আয়াত: ২৪]

উপরে বিশেষ ভালোবাসার নানা প্রকার উল্লেখ করা হলো।

আর যৌথ ভালোবাসা তিন প্রকার:

এক: প্রাকৃতিক। যেমন: ক্ষুধার্ত ব্যক্তির খাবারের প্রতি এবং পিপাসার্তের পানির প্রতি ভালোবাসা। এটি সম্মান করাকে আবশ্যক করে না। এ ধরনের ভালোবাসা মুবাহ তথা বৈধ।

দুই: অনুগ্রহ ও মমতার ভালোবাসা। যেমন: শিশু সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা। এটিও সম্মান করাকে অবধারিত করে না। এ ধরনের ভালোবাসায় সমস্যা নেই।

তিন: ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্বের ভালোবাসা। যেমন: একই পেশা, জ্ঞান, সঙ্গ, ব্যবসা বা সফরের সাথী হওয়ার কারণে পারস্পরিক ভালোবাসা। এই ভালোবাসাগুলো, যা মানুষের জন্য প্রযোজ্য, অনুরূপভাবে ভাইদের পারস্পরিক ভালোবাসা এবং তাদের মধ্যকার বিদ্যমান এই ভালোবাসা আল্লাহর ভালোবাসায় শির্ক নয়।

এই বিষয়টির অন্যতম উৎস হলো: তাইসীরুল আযীযিল হামীদ গ্রন্থের ‘ومن الناس من يتخذ من دون الله أنداداً  ’ পরিচ্ছেদ।

আশা করি আমাদের প্রদত্ত এই প্রকরণ ও ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে বিষয়টি আপনাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে এবং আপনাদেরকে সমস্ত কল্যাণের তৌফিক দান করেন। আল্লাহ দরূদ বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদের উপর।

সূত্র: শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ