আলহামদু লিল্লাহ।.
ফিকাহবিদ আলেমগণ একমত যে, তাওয়াফে ইফাযা হজ্জের একটি রুকন; যা ব্যতীত হজ্জ সম্পন্ন হবে না। তবে তারা তাওয়াফে ইফাযার প্রথম সময় কখন সে ব্যাপারে মতভেদ করেছেন:
হানাফী ও মালেকী মাযহাবের আলেমদের মতে: (তাওয়াফে ইফাযার সময়) কোরবানীর দিন ফজরের সময় থেকে শুরু হয়; এর আগে করলে সহিহ হবে না।
'বাদায়িউস সানায়ি' (হানাফী) গ্রন্থে (২/১৩২) বলেন: "আর এই তাওয়াফের সময়কাল: এর প্রথম সময় হল: কুরবানীর দিনের দ্বিতীয় ফজর (সুবহে সাদিক) উদিত হওয়া। এ ব্যাপারে আমাদের মাযহাবের আলেমদের মাঝে কোন মতভেদ নাই। এর আগে করলে সহিহ হবে না। শাফেয়ি রহঃ বলেন: এর প্রথম সময় হল: কুরবানীর রাতের মধ্যবর্তী সময়।"[সমাপ্ত]
আল-সাওয়ি (মালেকী) রহঃ 'বুলগাতুস সালিক' গ্রন্থে বলেন: "এর সময় হল অর্থাৎ তাওয়াফে ইফাযার সময় হল: কুরবানীর দিনের ফজর উদিত হওয়া থেকে। এর আগে করলে সহিহ হবে না। যেমনটি আকাবাতে কংকর মারাও এর আগে করলে সহিহ হবে না।"[সমাপ্ত]
আর শাফেয়ি ও হাম্বলি মাযহাবের আলেমদের অভিমত হচ্ছে: কুরবানীর রাতের অর্ধাংশ (মধ্যরাত) থেকে সহিহ হবে।
ইমাম নববী (শাফেয়ি) রহঃ বলেন: "জমরায়ে আকাবায় কংকর নিক্ষেপ করা ও তাওয়াফে ইফাযার সময় শুরু হবে: কুরবানীর রাতের অর্ধাংশ থেকে। তবে শর্ত হল এর আগে আরাফাতে অবস্থান করতে হবে।
মাথা মুণ্ডন: যদি আমরা বলি এটি নুসুক (ইবাদত); তাহলে এর বিধান কংকর নিক্ষেপ ও তাওয়াফের মত। নচেৎ এর সময় কংকর নিক্ষেপ করা কিংবা তাওয়াফ করা ব্যতীত শুরু হবে না। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।"[আল-মাজমু (৮/১৯১) থেকে সমাপ্ত]
ইবনে কুদামা (হাম্বলী) রহঃ বলেন: "এ কারণে তাওয়াফের সময় দুইটি। একটি হল উত্তম সময়। অন্যটি বৈধ সময়। উত্তম সময় হল: কুরবানীর দিন কংকর নিক্ষেপ, কুরবানী করা ও মাথা মুণ্ডন করার পর...।
আর বৈধ সময় হল: কুরবানীর রাতের অর্ধাংশ (মধ্যরাত) থেকে। ইমাম শাফেয়িও এটাই বলেছেন।
ইমাম আবু হানিফা বলেছেন: এর প্রথম সময় হল: কুরবানীর দিনের ফজর উদিত হওয়া থেকে। আর সর্বশেষ সময় হল: কুরবানীর সর্বশেষ দিন।"[আল-মুগনী (৩/২২৬) থেকে সমাপ্ত]
পূর্বোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ হাজীসাহেব যদি মধ্যরাতের পর তাওয়াফ করে থাকেন তাহলে শাফেয়ি ও হাম্বলি মাযহাব অনুযায়ী তার তাওয়াফ সহিহ হয়েছে। মধ্যরাত নির্ণয় করা যাবে মাগরিবের ওয়াক্ত থেকে ফজরের ওয়াক্তের মধ্যবর্তী সময়টাকে দুই ভাগে ভাগ করার মাধ্যমে।
যদি তার তাওয়াফটা মধ্যরাতের আগে হয়ে থাকে তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে তার তাওয়াফ সহিহ হয়নি এবং তার হজ্জও সম্পন্ন হয়নি এবং তার দ্বিতীয় হালালও অর্জিত হয়নি। তার উপর ওয়াজিব পুনরায় তাওয়াফে ইফাযা পালন করা।
দুই:
মুযদালিফাতে রাত্রি যাপন করা জমহুর আলেমের নিকট ওয়াজিব। আর কোন কোন আলেমের নিকট এটি হজ্জের রুকন।
কতটুকু রাত্রি যাপন করা যথেষ্ট এ নিয়ে একাধিক অভিমত রয়েছে:
শাফেয়ি ও হাম্বলি মাযহাবের আলেমদের মতে, মুযদালিফাতে রাত্রি যাপন করা ওয়াজিব; এমনকি সেটা এক মূহূর্তের জন্যে হলেও। শর্ত হল সেটা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করার পর রাতের দ্বিতীয় অর্ধাংশ থেকে ফজর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হতে হবে; তবে কিছু সময় সেখানে বিলম্ব করা শর্ত নয়। বরং অতিক্রম করে গেলেও চলবে।
যে ব্যক্তি মধ্যরাতের আগে মুযদালিফা ত্যাগ করেছে; কিন্তু আবার ফজরের আগে মুযদালিফাতে ফিরে এসেছে— তার উপর কোন কিছু বর্তাবে না। কেননা সে তো ওয়াজিব পালন করেছে। যদি সে ফজরের আগে ফেরত না আসে তাহলে অগ্রগণ্য মতানুযায়ী তার উপর দম (একটি পশু জবাই) দেওয়া ওয়াজিব হবে।
আর হানাফি মাযহাবের আলেমদের নিকট মুযদালিফাতে ফজর উদিত হওয়ার পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় অবস্থান করা ওয়াজিব। অতএব, এ সময়সীমার মধ্যে এক মূহূর্তের জন্যে হলেও অবস্থান করা ওয়াজিব। যদি কোন ওজরের কারণে অবস্থান করতে না পারে তাহলে তার উপর কোন কিছু বর্তাবে না। ওজর হচ্ছে শারীরিক দুর্বলতা কিংবা অসুস্থতা কিংবা নারী হলে ভীড়কে ভয় করা। যদি এই সময়ের আগে কেউ ওজর ছাড়া মুযদালিফা ত্যাগ করে তাহলে তার উপর পশু জবাই করা ওয়াজিব হবে।
তবে যদি সূর্যোদয়ের আগে মুযদালিফাতে ফিরে এসে সেখান অবস্থান করে ভুল সংশোধন করে নেয় তাহলে এটা স্পষ্ট যে, তার উপর থেকে দম (পশু জবাই) দেয়ার এর বিধান মওকুফ হয়ে যাবে।
মালেকী মাযহাবের অভিমত হচ্ছে: মুযদালিফাতে এসে সওয়ারীর আসবাবপত্র নামানোর মত সমপরিমাণ সময় অবস্থান করা ওয়াজিব; যদিও বাস্তবে আসবাবপত্র না নামায়। যদি কেউ ফজর উদিত হওয়া অবধি মুযদালিফাতে সওয়ারীর আসবাবপত্র নামানোর সমপরিমাণ সময় অবস্থান না করে তাহলে কোন ওজর না থাকলে তার উপর দম (পশু জবাই) ওয়াজিব। যদি কোন ওজরের কারণে অবস্থান না করে তাহলে তার উপর কোন কিছু বর্তাবে না।[আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা (১১/১০৮) থেকে সমাপ্ত]
এই আলোচনার প্রেক্ষিতে এই হাজীসাহেব যদি প্রথমে মুযদালিফাতে নাও আসেন; বরং মধ্যরাতের পরে তাওয়াফে ইফাযা শেষ করে মুযদালিফাতে ফিরে আসেন এবং মধ্য রাতের পর যে কোন সময় মুযদালিফা অতিক্রম করেন তাহলে তার উপর কোন কিছু বর্তাবে না।
যদি বিশেষ কোন ওজরের কারণে তাওয়াফের পরেও মুযদালিফাতে না আসেন; যে ধরণের ওজর মুযদালিফাতে রাত্রি যাপন ত্যাগ করার বৈধতা দেয়; যেমন এমন কোন অসুস্থতা যার ফলে তিনি মুযদালিফাতে বসে থাকতে সক্ষম নন; তাহলেও তার উপর দম (পশু জবাই) ওয়াজিব হবে না।
আর যদি কোন ওজর ছাড়া মুযদালিফাতে না আসেন তাহলে তার উপর দম ওয়াজিব হবে।
আল-খতীব আল-শারবিনী "মুগনিল মুহতাজ" গ্রন্থে (২/২৬৫) বলেন: ওজরগ্রস্ত (যার আলোচনা অচিরেই মীনায় রাত্রিযাপন পরিচ্ছেদে আসবে: এটা নিশ্চিত যে, তার উপর কোন দম (পশু জবাই) নাই।
ওজরগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছে:
যে ব্যক্তি রাতের বেলায় আরাফায় পৌঁছেছেন এবং আরাফার অবস্থানে ব্যস্ত ছিলেন।
যে ব্যক্তি আরাফা থেকে মক্কায় এসেছেন ফরয তাওয়াফ করতে; এতে করে তার অবস্থান করা ছুটে যায়।
আল-আযরুঈ বলেছেন: এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যে, যে ব্যক্তির পক্ষে কঠিন কষ্ট ছাড়া মুযদালিফায় পৌঁছা সম্ভবপর নয়। যদি সম্ভবপর হয় তাহলে সেটাই ওয়াজিব। যাতে করে দুটো ওয়াজিবই পালন করা যায়। এটা স্পষ্ট।
ওজরগ্রস্তদের মধ্যে আরও রয়েছে: কোন নারী যদি হায়েয বা নিফাস শুরু হয়ে যাওয়ার আশংকা করেন তাহলে তিনি অবিলম্বে তাওয়াফ করার জন্য মক্কায় চলে যেতে পারেন।"[সমাপ্ত]
[দেখুন: আল-মাজমু (৮/১৫৩)]
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়: যে ব্যক্তি মুযদালিফাতে অবস্থান করেনি তার বিধান কী?
জবাবে তিনি বলেন: "যে ব্যক্তি মুযদালিফাতে রাত্রি যাপন করেনি সে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হল। যেহেতু আল্লাহ্ তাআলা বলেন: সুতরাং যখন তোমরা 'আরাফাত' হতে ফিরে আসবে তখন মাশ'আরুল হারামের কাছে পৌঁছে আল্লাহ্কে স্মরণ করবে।[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৯৮] মাশ'আরুল হারাম হচ্ছে- মুযদালিফা।
যদি কেউ মুযদালিফাতে রাত্রি যাপন না করে সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হল এ কারণেও যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে রাত্রি যাপন করেছেন। তিনি বলেছেন: "তোমরা আমার কাছ থেকে হজ্জের কার্যাবলী গ্রহণ কর"। তিনি কারো জন্য রাত্রি যাপন বর্জন করার অবকাশ দেননি; কেবল দুর্বলরা ব্যতীত। দুর্বলদেরকে শেষ রাতে মুযদালিফা ত্যাগ করার অবকাশ দিয়েছেন। অতএব, এই হাজীসাহেবের উপর একটি ফিদিয়া মক্কাতে জবাই করে সেটা মক্কার গরীবদের মাঝে বণ্টন করা ওয়াজিব।[মাজমুউ ফাতাওয়াশ শাইখ বিন উছাইমীন (২৩/৯৭)]
তিন:
যদি এই হাজীসাহেব তাওয়াফে ইফাযা আদায় করার পর হালাল হয়ে যান অর্থাৎ মাথার চুল মুণ্ডন করেন কিংবা চুল কাটেন; এরপর মাখিত তথা সাধারণ কাপড় পরিধান করেন: তাহলে তার উপর কোন কিছু বর্তাবে না। কেননা ছোট হালাল কংকর নিক্ষেপ, মাথা মুণ্ডন বা চুল কাটা ও তাওয়াফ করা এ তিনটি কাজের মধ্যে যে কোন দুইটি করার মাধ্যমে অর্জিত হয়।
আর যদি তাওয়াফ করে মাথা মুণ্ডন বা চুল কাটার আগেই মাখিত তথা সাধারণ কাপড় পরিধান করে ফেলেন তাহলে তিনি নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হলেন। তবে, অজ্ঞতাবশতঃ নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হওয়ায় তার উপর কোন কিছু বর্তাবে না।
অনুরূপভাবে না-জানার কারণে তিনি হালাল হয়ে গেছেন মনে করে যদি সুগন্ধি লাগিয়ে ফেলেন সেক্ষেত্রেও একই বিধান।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।