আলহামদু লিল্লাহ।.
এক: আলী (রাঃ) এর দিকে সম্বন্ধিত উক্তির সত্যতা সম্পর্কে মন্তব্য
ইবনুল জাওযি (রহঃ) দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এ মাসয়ালাটি আলী (রাঃ) এর সাথে সম্বন্ধিত হওয়া মিথ্যা। তিনি তাঁর সনদ উল্লেখ করে বলেন:
মুহাম্মদ বিন আশরাস আস্-সুলামি থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমাদেরকে মুহাম্মদ বিন সাঈদ আল-হারাবী সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি বলেন: আমাদেরকে ইসমাঈল বিন ইয়াহইয়া বিন উবাইদুল্লাহ্ আত্-তাইমি ও আলী বিন ইব্রাহিম আল-হাশিমি সংবাদ দিয়েছেন ইয়াহইয়া বিন আকীল আল-খুযাঈ থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি আলী বিন আবু তালেব (রাঃ) থেকে: এক লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করল যে, আপনি মুহাম্মাদের মাধ্যমে আল্লাহ্কে চিনেছেন? নাকি আল্লাহ্র মাধ্যমে মুহাম্মদকে চিনেছেন? তিনি বলেন: যদি আমি মুহাম্মাদের মাধ্যমে আল্লাহ্কে চিনতাম তাহলে মুহাম্মাদ আল্লাহ্র চেয়ে অধিকতর আস্থাভাজন হত। আর যদি আল্লাহ্র মাধ্যমে মুহাম্মদকে চিনতাম তাহলে আমার আল্লাহ্র রাসূলের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু, আল্লাহ্ নিজেই আমাকে চিনিয়েছেন; কোন আকৃতি নির্ধারণ ব্যতিরেকে, যেইভাবে তিনি চেয়েছেন সেইভাবে। তিনি মুহাম্মদকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন কুরআন ও ঈমান পৌঁছে দেয়ার জন্য, হুজ্জত প্রতিষ্ঠা করার জন্য, মানুষকে ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তিনি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যা নিয়ে এসেছেন তাতে আমি বিশ্বাস করেছি। কেননা তিনি তাঁর প্রভুর নির্দেশের বিপরীত কিছু নিয়ে আসেননি এবং পূর্ববর্তী রাসূলদের বিরোধিতা করেন না। তিনি সঠিক পথনির্দেশনা, প্রতিশ্রুতি নিয়ে এবং পূর্ববর্তীদের সত্যায়ন নিয়ে এসেছেন।”
ইবনুল জাওযি বলেন: “এটি আলী আলাইহিস সালামের নামে একটি বানোয়াট হাদিস। তাঁর মর্যাদা এমন কথা বলা থেকে ঊর্ধ্বে। এ হাদিসটি রচনার জন্য অভিযুক্ত রাবী হচ্ছে মুহাম্মদ বিন সাঈদ। তিনি ইসমাঈল থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে আদী বলেন: ইসমাঈল নির্ভরযোগ্য রাবীদের থেকে বাতিল কথাবার্তা বর্ণনা করেন। আর বর্ণনাকারী হাশেমীর পরিচয় অজ্ঞাত।”[আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়া ফিল আহাদিছিল ওয়াহিয়া (২/৯৪২) থেকে সমাপ্ত]
যাহাবী (রহঃ) বলেন: “এ কথা যে ব্যক্তি রচনা করেছে আল্লাহ্ তাকে লাঞ্ছিত করুন। এর সনদে রয়েছে: মুহাম্মদ বিন আশরাস আস্-সুলামী, সে একজন মিথ্যাবাদী। সে বর্ণনা করেছে মুহাম্মদ বিন সাঈদ থেকে, সে ইসমাঈল বিন ইয়াহইয়া থেকে; সেই-ই হচ্ছে অভিযুক্ত।”[তালখিসু কিতাবিল ইলাল আল-মুতানাহিয়া (পৃষ্ঠা-৩৭০) থেকে সমাপ্ত]
শাওকানী (রহঃ) বলেন:
আলী (রাঃ) এর উক্তি যখন তাকে বলা হল: “আপনি মুহাম্মদের মাধ্যমে আল্লাহ্কে চিনেছেন? নাকি আল্লাহ্র মাধ্যমে মুহাম্মদকে চিনেছেন?” তিনি বললেন: আমার আল্লাহ্র রাসূলের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু, আল্লাহ্ নিজেই আমাকে চিনিয়েছেন; কোন আকৃতি নির্ধারণ ব্যতিরেকে, যেইভাবে তিনি চেয়েছেন সেইভাবে। তিনি মুহাম্মদকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন কুরআন ও ঈমান পৌঁছে দেয়ার জন্য....”
এটি আল-জুযক্বানী তাঁর ‘আল-ওয়াহিআত’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। ইবনুল জাওযি বলেছেন: “এটি আলী (রাঃ) এর নামে বানোয়াট একটি হাদিস...”[আল-ফাওয়ায়েদ আল-মাজমুআ (পৃষ্ঠা-৪৫৫) থেকে সমাপ্ত]
এ উক্তিটি শিয়াদের কিতাবগুলোতে বড় একটি ঘটনার অংশ হিসেবে পাওয়া যায়। এ ঘটনাটি মিথ্যা হওয়ার আলামত সুস্পষ্ট। এর মাধ্যমে তারা আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ) এর মর্যাদা হানি করে ও তাঁদের জ্ঞানকে খাটো করে। তারা এ ঘটনাটিকে এমন এক সনদ দিয়ে উল্লেখ করে যা মিথ্যাবাদী ও অজ্ঞাত পরিচয়ের রাবী থেকে মুক্ত নয়। যেমনটি উদ্ধৃত হয়েছে শিয়া ইবনে বাবাওয়াইহ আল-ক্বুম্মির লিখিত ‘আত্-তাওহীদ’ নামক কিতাবে (পৃষ্ঠা-২১০) ও অন্যান্য কিতাবে।
দুই: এই কথাটির অর্থ সম্পর্কে মন্তব্য
সম ধরণের বক্তব্য কিছু আলেমের গ্রন্থে পূর্ববর্তী ব্যক্তিদের দিকে সম্বন্ধিত করে উল্লেখ করা হয়েছে; তবে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি উক্তিটি কার।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন:
তিনি (আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন আবুল ফারাজ আল-মাকদিসি) বলেন: “একদল সলফে সালেহীন থেকে তা বর্ণিত আছে। তাদের কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: আপনি কি মুহাম্মাদের মাধ্যমে আল্লাহ্কে চিনেছেন? নাকি আল্লাহ্কে তাঁর মাধ্যমে চিনেছেন? তিনি বলেন: আমি আল্লাহ্কে তাঁর মাধ্যমে চিনেছি এবং মুহাম্মাদকে আল্লাহ্র মাধ্যমে চিনেছি। যদি আমি মুহাম্মাদের মাধ্যমে আল্লাহ্কে চিনতাম; তাহলে অনুগ্রহ আল্লাহ্র বদলে মুহাম্মদের জন্য হত।”[দারউ তাআরুযুল আকল ওয়াল নাকল (৯/২৫)]
তাদের এ কথার উদ্দেশ্য হল: একজন মুমিন আল্লাহ্কে ও তাঁর রাসূলকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তাওফিক ও হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়ে চিনতে পেরেছে। নিজের বুদ্ধি দিয়ে কিংবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন সেটা অনুধাবন করার মাধ্যমে নয়। যেমনটি আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন: “আর তোমরা জেনে রাখ যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন। তিনি যদি অধিকাংশ বিষয়ে তোমাদের কথা মেনে নিতেন, তাহলে তোমরা অবশ্যই কষ্টে পতিত হতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করে দিয়েছেন এবং তা তোমাদের অন্তরে সুশোভিত করেছেন। আর তোমাদের কাছে কুফরী, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে অপছন্দনীয় করে দিয়েছেন। তারাই তো সত্য পথপ্রাপ্ত। আল্লাহর পক্ষ থেকে করুণা ও নেয়ামত স্বরূপ। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”[সূরা হুজুরাত, আয়াত: ৭-৮]
তিনি আরও বলেন: “আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার হেদায়াত দিতাম; কিন্তু আমার এ কথা অবশ্যই সত্য ‘নিশ্চয়ই আমি জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নামকে পূর্ণ করব’।”[সূরা আস্-সাজদা, আয়াত: ১৩]
কিন্তু একই সময়ে তারা এটাও অস্বীকার করেন না যে, আল্লাহ্ তাআলা এ হিদায়াত লাভের জন্য কিছু উপকরণ নির্ধারণ করে রেখেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে রাসূলগণের দাওয়াত ও তাদের শিক্ষাদান।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন:
“আহলুস সুন্নাহ্র আলেমদের মধ্যে যারা দলিল পেশ করেছেন যে, বান্দা আল্লাহ্কে চেনা ও আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনা আল্লাহ্র অনুগ্রহ, রহমতে ও তাঁর পরিচয় করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে হাছিল হয় কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন ভাষায়— তাদের বক্তব্যের মধ্যে এ সকল তাকদীর অস্বীকারকারীদের বক্তব্যকে বাতিল সাব্যস্তকরণ অন্তর্ভুক্ত এটা সঠিক। তবে এ বাতিল সাব্যস্তকরণ এমন কিছু দাবী করছে না যে, বিবেক ব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জিত হয় না এবং এমন কিছুও দাবী করছে না যে, রাসূলের শিক্ষাদান, আলেমদের শিক্ষাদান, ঈমানদারদের শিক্ষাদান, তাদের দাওয়াত, আলোচনা ও দলিল প্রদানের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জিত হয় না।
বরং এটি সুবিদিত যে, বান্দার অন্তরে জ্ঞান হাছিল হয় কখনও মানুষের কাছ থেকে যে আলোচনা ও শিক্ষাদান শুনে থাকে এর মাধ্যমে; সেটা কোন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের নির্দেশনা হোক কিংবা সংঘটিত কোন বাস্তবতার সংবাদ হোক।
আবার কখনও অন্তরে চিন্তা-ভাবনা, তুলনা ও প্রমাণ উপস্থাপন সংঘটনের মাধ্যমে হাছিল হয়।
আবার কখনও অর্জন ও প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে হাছিল হয়। আবার কখনও অন্তরের অর্জন করা ছাড়া আল্লাহ্ অর্জন করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে হাছিল হয়। আর সেটা হচ্ছে আল্লাহ্ মুমিনদের অন্তরে যে ঈমান লিখে দেন— সেটা বান্দার পক্ষ থেকে কোন হেতুর মাধ্যমে হাছিল হোক, যেমন- চিন্তা-ভাবনা, দলিল উপস্থাপন কিংবা অপরের পক্ষ থেকে কোন হেতুর মাধ্যমে হোক কিংবা কোন হেতু ছাড়া হাছিল হোক। এই হেতু কিংবা পূর্বোক্ত হেতু যেটাই হোক না কেন সেটা আল্লাহ্র কাযা (নিয়তি) ও তাকদীর (নির্ধারণ)-এর মাধ্যমে অর্জিত হয়। আর এটাই হচ্ছে বান্দার উপরে আল্লাহ্র নেয়ামত। কেননা আল্লাহ্ বান্দার প্রতি হেতু ও ফলাফলের নেয়ামত দান করেছেন। এ কারণে যে ব্যক্তি ধারণা করেছে যে, জ্ঞান ও ঈমান নিছক তার বুদ্ধি, চিন্তাভাবনা ও দলিল উপস্থাপনের মাধ্যমে হাছিল হয়েছে; যেমনটি বলে থাকে তাকদীর অস্বীকারকারীগণ; সে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট। আহলে সুন্নাহ্র এ সকল আলেম এটাকেই বাতিল বলেছেন।”[দারউ তাআরুযুল আকল ওয়াল নাকল (৯/২৮) থেকে সমাপ্ত]
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।