বৃহস্পতিবার 6 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 7 নভেম্বর 2024
বাংলা

যে ব্যক্তি পশ্চিম দিকে সফর শুরু করেছে তার নামায ও ইফতারের সময় সে যে দেশ থেকে বেরিয়েছে সে দেশ থেকে বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে

প্রশ্ন

জনৈক ব্যক্তি নাইজেরিয়া থেকে কুরিয়ার উদ্দেশ্যে সফর করেছে। নাইজরিয়াতে সে রোযা ছিল এই আশায় যে, সে কুরিয়াতে গিয়ে ইফতার করবে। পথিমধ্যে সে যোহর ও আসরের নামায বিমানের ভেতরে মুসলিম যাত্রীদের সাথে আদায় করেছে। সে আশা করেছিল মাগরিবের নামায কুরিয়াতে পড়বে এবং সেখানেই ইফতার করবে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো সে যে লোকদের সাথে সাক্ষাত করল তারা যোহরের নামাযের জন্য আযান দিচ্ছিল। সে মসজিদের দেয়াল ঘড়িতে দেখল তখন বেলা ১টা বেজে ৩০ মিনিট। সূর্য তখনও মাথার উপরে। সে পেরেশান হয়ে নাইজেরিয়াতে তার স্ত্রীকে ফোন করল। তার স্ত্রী জানাল যে নাইজেরিয়াতে তারা ইফতার খেয়ে, তারাবীর নামায পড়ে ঘুমাতে যাচ্ছে। নাইজেরিয়াতে তখন রাত নয়টা বাজে। এমতাবস্থায় সে কি কুরিয়ার স্থানীয় সময়ের সাথে মিলিয়ে রোযা চালিয়ে যাবে? অনুরূপভাবে তাদের সাথে যোহরের নামায পড়বে? নাকি মাগরিবের নামায পড়বে? নাকি নাইজেরিয়া থেকে তার স্ত্রীর সংবাদবাদের ভিত্তিতে ইফতার করবে?

উত্তরের সংক্ষিপ্তসার

যে ব্যক্তি ওয়াক্ত প্রবেশ করার পর নামায আদায় করে নিয়েছে। এরপর তার গন্তব্যে পৌঁছার পর সেখানে ঐ ওয়াক্ত প্রবেশ করুক বা না করুক; যে নামাযটি সে একবার পড়েছে সে নামায পুনরায় পড়া তার উপর আবশ্যক নয়। কেননা একদিনে এক নামায দুইবার পড়তে হয় না। তাই যখন সহিহভাবে নামাযটি আদায় হয়েছে তখন পুনরায় পড়া আবশ্যক নয়। তবে রোযাদার সূর্য ডোবার আগে রোযা ভাঙ্গবে না; পশ্চিম দিকে গমন করার কারণে সূর্য ডোবা যত বিলম্ব হোক না কেন। সে ব্যক্তি যে দেশ থেকে সফর শুরু করেছেন সেই দেশে সূর্য ডুবাটা ধর্তব্য নয়; যদি সেই দেশ থেকে বের হওয়ার আগে সেখানে সে সূর্যাস্ত না পেয়ে থাকে।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

যে ব্যক্তি পশ্চিম দিকে সফর করেছে এবং তার গন্তব্যে যোহরের ওয়াক্তে পৌঁছেছে, কিন্তু পথিমধ্যে সে যোহরের নামায পড়ে ফেলে তাহলে যোহরের নামায পুনরায় পড়া তার উপর আবশ্যকীয় নয়। কেননা এক নামায দুইবার পড়া যায় না। উল্লেখ্য, পশ্চিম দিকে গমন করার মাধ্যমে নামাযের ওয়াক্ত প্রবেশের সময় বিলম্বিত হবে।

অনুরূপভাবে সে ব্যক্তি যদি আসরের নামাযও পড়ে থাকেন তাহলে পুনরায় পড়া তার উপর আবশ্যকীয় নয়; চাই সে ব্যক্তি যোহরের সময় পৌঁছাক কিংবা আসরের সময় পৌঁছাক।

আরও জানতে দেখুন: 22387 নং প্রশ্নোত্তর।

কিন্তু কেউ যদি মসজিদে উপস্থিত থাকেন এবং নামাযের ইকামত দেয়া হয় তাহলে তিনি জামাআতের সাথে পুনরায় নামায পড়বেন। এই নামায তার জন্য নফল হিসেবে গণ্য হবে। যেহেতু ইমাম তিরমিযি (২১৯) ও ইমাম নাসাঈ (৮৫৮) ইয়াজিদ ইবনুল আসওয়াদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হজ্জ করেছি। আমি মাসজিদুল খাইফে তাঁর সাথে ফজরের নামায আদায় করলাম। নামায শেষে তিনি একটু কোনাকুনি হয়ে বসলেন। এর মধ্যে তিনি লোকদের পেছনে দুইজন লোককে দেখতে পেলেন যে দুইজন তাঁর সাথে নামায পড়েনি। তখন তিনি বললেন: এই দুইজনকে নিয়ে আস। তাদের দুইজনকে আনা হল। তাদের বুক ধুরুধুরু কাঁপছিল। তিনি বললেন: আমাদের সাথে নামায পড়তে তোমাদেরকে কিসে বাধা দিল? তারা দুইজন বলল: ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌! আমরা আমাদের আস্তানাতে নামায পড়েছি। তিনি বললেন: এমন কাজ আর করো না। যদি তোমরা তোমাদের আস্তানাতে নামায পড়েও থাক এরপর কোন জামে মসজিদে আস তখন তোমরা তাদের সাথে নামায পড়বে। এই নামায তোমাদের জন্য নফল হিসেবে গণ্য হবে।”[আলবানী হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]

দুই:

কিন্তু রোযার ক্ষেত্রে সে যে স্থানে রয়েছে সে স্থানের সূর্য ডোবা ছাড়া রোযা ভাঙ্গা বৈধ নয়। যদি কেউ তার গন্তব্যে পৌঁছে দেখে যে, তখনও সূর্য ডুবেনি তাহলে তার জন্য সূর্য ডোবার পূর্বে ইফতার করা বৈধ হবে না; এমনকি যদি সময় দীর্ঘ হয়ে যায় তবুও। যেহেতু আল্লাহ্‌ তাআলা বলেছেন: তোমরা রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর।[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৭] এবং যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যখন এ দিক থেকে রাত আগমন করবে এবং এ দিক থেকে দিন প্রস্থান করবে এবং সূর্য ডুবে যাবে তখন রোযাদার ইফতার করবে[সহিহ বুখারী (১৯৫৪) ও সহিহ মুসলিম (১১০০)]

এই আলোচনার ভিত্তিতে: এই মুসাফির যখন কুরিয়া পৌঁছেছেন তখন সেখানের মানুষ যোহরের ওয়াক্তে ছিল। এই ব্যক্তি যদি তার রোযাটি পূর্ণ করতে চান তাহলে তাকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নাইজেরিয়াতে সূর্য ডোবাটা ধর্তব্য নয়।

আর যদি তিনি মুসাফির হওয়ার কারণে ছাড় গ্রহণ করে রোযা ভেঙ্গে ফেলেন তাহলে তিনি তা করতে পারেন। বিশেষতঃ হঠাৎ করে দিনটি যদি এত বেশী দীর্ঘ হয়ে যায় এবং তার জন্য নতুন স্থানে রাত পর্যন্ত রোযাটি পূর্ণ করা কষ্টকর হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি রমযানের পর এ দিনটির রোযা কাযা পালন করবেন।

শাইখ উছাইমীনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:

“এক ছাত্র আমেরিকার কোন এক শহরে অধ্যয়নরত। সে তার ঘটনা বলল যে, একবার সে যে শহরে থেকে পড়ে সে শহর থেকে ভ্রমণ করতে বাধ্য হল। সে ফজরের সময় রোযা ধরেছে। যে শহরের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেছে ঐ শহরে পৌঁছেছে সেখানের সময় অনুযায়ী মাগরিবের পর। কিন্তু সে দেখতে পেল এর মধ্যে ১৮ ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে কিন্তু তার রোযা শেষ হয়নি। অথচ সাধারণত সে ১৪ ঘন্টা রোযা রাখত। এমতাবস্থায় সে কি অতিরিক্ত ৪ ঘন্টা রোযা চালিয়ে যাবে? নাকি সে যে শহরে থাকে সে শহরের সময় অনুযায়ী ইফতার করে ফেলবে? সেই শহর থেকে ফেরার সময় বিপরীতটা ঘটল। তখন দিনের সময় ১৪ ঘন্টা কমে ৩ ঘন্টা হয়ে গেল।

এর জবাবে শাই্খ বলেন: সে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত রোযা চালিয়ে যাবে। কেননা রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যখন এ দিক থেকে রাত আগমন করবে; তিনি পূর্বদিকে ইশারা করেন এবং এ দিক থেকে দিন প্রস্থান করবে; তিনি পশ্চিম দিকে ইশারা করেন এবং সূর্য ডুবে যাবে তখন রোযাদার ইফতার করবে।

অতএব সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সে ছাত্রকে তার রোযার উপর থাকতে হবে; এমনকি যদি চার ঘন্টা বেড়ে যায় তবুও।

সৌদি আরবে এর সম ধরণের উদাহরণ হচ্ছে: কেউ যদি পূর্ব প্রদেশে সেহেরী খাওয়ার পর পশ্চিম প্রদেশের উদ্দেশে সফর করে তখন দূরত্ব অনুপাতে তার সময় বেড়ে যাবে।”[মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে উছাইমীন (১৯/৩২২)]

ড. আব্দুল্লাহ্‌ আস্‌-সাকাকির ‘নাওয়াযিলুস সিয়াম’ গ্রন্থে বলেন: “দ্বিতীয় মাসয়ালা: কোন মুসাফির তার দেশে সূর্য ডুবার কিছুক্ষণ পূর্বে যদি পশ্চিম দিকে সফর করে তাহলে তার সূর্য ডোবা বিলম্বিত হবে। উদাহরণতঃ তার দেশে যদি সন্ধ্যা ৬টায় সূর্য অস্ত যায় আর সে ৬টা বাজার ১০ মিনিট আগে মরক্কোর উদ্দেশ্যে বিমানে চড়ে সে এই পথে যত অগ্রসর হতে থাকবে তার দিন তত বড় হতে থাকবে। কেননা মরক্কোতে সূর্য ৮টার আগে অস্ত যাবে না। এভাবে এক ঘন্টা বা দুই ঘন্টা সূর্যকে উদীয়মান অবস্থায় সে পাবে। এমন ব্যক্তিকে আমরা কী বলব?

আমরা বলব: সূর্য না ডুবা পর্যন্ত ইফতার করবে না। এমনকি এতে করে যদি সময় দুই ঘন্টা, চার ঘন্টা, পাঁচ ঘন্টা বা তার চেয়ে বেশি বেড়ে যায় তবুও। তবে তার এই এখতিয়ার থাকবে যে, সে মুসাফিরের বিধিবিধান গ্রহণ করে এবং ছাড় নিয়ে রোযা ভেঙ্গে ফেলবে। আর রোযা পূর্ণ করতে চাইলে তাকে অতিরিক্ত সময়টুকুও (রোযা ভঙ্গকারী বিষয় থেকে) বিরত থাকতে হবে। কেননা কুরআনে কারীম রোযা ভাঙ্গার জন্য একটি সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। অতপর তোমরা রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর।[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৭] এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যদি রাত এ দিক থেকে আগমন করে এবং এ দিক থেকে প্রস্থান করে এবং সূর্য অস্ত যায় তখন রোযাদার ইফতার করবে।

আর যতক্ষণ পর্যন্ত সূর্য অস্ত যাবে না ততক্ষণ পর্যন্ত এই লোকের দিন শেষ হবে না। অতএব, সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত রোযা ভঙ্গকারী বিষয় থেকে বিরত থাকা তার উপর ওয়াজিব কিংবা সে সফরের ছাড় গ্রহণ করে রোযা ভেঙ্গে ফেলতে পারে এবং এই দিনের বদলে অন্য একদিন রোযাটি রাখতে পারে”।[https://bit.ly/2Zq4574 থেকে সমাপ্ত]

সারকথা:

১। যে ব্যক্তি ওয়াক্ত প্রবেশ করার পর নামায আদায় করে নিয়েছে। পরবর্তীতে তার গন্তব্যে পৌঁছার পর সেখানে এই ওয়াক্ত প্রবেশ করুক বা না করুক; যে নামাযটি সে একবার পড়েছে সে নামায পুনরায় পড়া তার উপর আবশ্যক নয়। কেননা একদিনে এক নামায দুইবার পড়তে হয় না। তাই যখন সহিহভাবে নামাযটি আদায় হয়েছে তখন পুনরায় পড়া আবশ্যক নয়।

২। রোযাদার সূর্য ডোবার আগে রোযা ভাঙ্গবে না; পশ্চিম দিকে গমন করার কারণে সূর্য ডোবা যত বিলম্ব হোক না কেন। সে ব্যক্তি যে দেশ থেকে সফর শুরু করেছেন সেই দেশে সূর্য ডোবাটা ধর্তব্য নয়; যদি সেই দেশ থেকে বের হওয়ার আগে সেখানে সূর্যাস্ত না ঘটে।

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব