সোমবার 22 জুমাদাল ছানী 1446 - 23 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

উমরার মধ্যে পঠিতব্য দুআ ও দুআ করার স্থানসমূহ

প্রশ্ন

আমি উমরা করতে মক্কায় যাব। কিন্তু আমি দুআ জানি না। আপনারা কি আমাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারেন?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

সহিহ হাদিসে উমরার মধ্যে পঠিতব্য অনেক দুআ বর্ণিত হয়েছে। যে কোন মুসলিম এ দুআগুলো মুখস্ত করে, এ গুলোর অর্থ বুঝে ও অর্থের দাবী মোতাবেক আমল করে উপকৃত হতে পারেন। এ দুআগুলোর মধ্যে রয়েছে-

ক. মীকাতে তালবিয়া উচ্চারণের সময়:

হজ্ব বা উমরার ইহরামের পূর্বে তাসবিহ পড়া, তালবিয়া বলাও তাকবীর দেওয়া সুন্নত। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনাতে যোহরের নামায পড়লেনচার রাকাত; যুল হুলাইফাতে আসরের নামায পড়লেন ২ রাকাত সে সময় আমরা তাঁর সাথেই ছিলাম। এরপর তিনি সেখানেই রাত্রি যাপন করলেন। ভোরে উঠে বাহনে আরোহন করলেন। যখন বাইদাতে পৌঁছলেন তখন তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন, তাকবীর দিলেন এবং হজ্ব ও উমরার তালবিয়া পড়লেন। লোকেরাও তাঁর সাথে হজ্ব ও উমরার তালবিয়া পড়ল।[সহিহ বুখারী (১৪৭৬)]

হাফেয ইবনে হাজার বলেন: এই হুকুম অর্থাৎ তাসবিহ পড়া ও তালবিয়ার পূর্বে উল্লেখিত অন্যান্য যিকির মুস্তাহাব হিসেবে সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও অনেক মানুষ-ই এই যিকিরগুলো পড়ে না।[ফাতহুল বারী (৩/৪১২)] খ. মক্কার পথে (মীকাত ও কাবার মাঝখানে)

পুরুষের জন্য অধিক হারে ও উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়া সুন্নত। আর নারীরা নীচুস্বরে তালবিয়া পড়বে যাতে করে পার্শ্ববর্তী বেগানা পুরুষ শুনতে না পায়। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যখন সওয়ারী পশু তাঁকে পিঠেনিয়ে যুল হুলাইফা মসজিদের নিকট সোজা হয়ে দাঁড়াল তখন তিনি এই বলে তাহলীল করলেন:

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ ، لَبَّيْكَ لا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لا شَرِيكَ لَكَ

লাব্বাইকাল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক।

(অর্থ- হে আল্লাহ! আমি আপনার দরবারে হাজির। আমি আপনার দরবারে হাজির। আমি আপনার দরবারে হাজির। আপনি নিরঙ্কুশ। আমি আপনার দরবারে হাজির। নিশ্চয় যাবতীয় প্রশংসা, যাবতীয় নেয়ামত আপনার-ই জন্য এবং রাজত্ব আপনার-ই জন্য। আপনি নিরঙ্কুশ।)[সহিহ বুখারি (৫৫৭১) ও সহিহ মুসলিম (১১৮৪)]

গ. তাওয়াফের মধ্যে:

তাওয়াফের প্রতি চক্করে হাজারে আসওয়াদ বরাবর এলে আল্লাহু আকবার বলবে। ইমাম বুখারি (১৬১৩) ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়তুল্লাহ তওয়াফ করেছেন। যখনি তিনি রুকনে তথা হাজারে আসওয়াদে আসতেন তাঁর কাছে থাকা কিছু একটা দিয়ে তিনি সেদিকে ইশারা করতেন এবং তাকবীর বলতেন। আর রুকনে ইয়ামেনী ও হাজারে আসওয়াদের মাঝখানেপড়তেন যা আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুই রুকনের মাঝে (দুই কর্ণারের মাঝে) বলতে শুনেছি-

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

(অর্থ- হে আমাদের রব্ব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন, আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচান।) [সুনানে আবু দাউদ (১৮৯২), সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থে আলবানী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন]

ঘ. সাফা পাহাড়ে উঠার আগে ও সাফা পাহাড়ের উপর:

জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে তিনি বলেন: ... এরপর তিনি দরজা দিয়ে সাফা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে বের হলেন (অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। যখন সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হলেন তখন তেলাওয়াত করলেন:

(إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ)

(অর্থ-“নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন গুলোর অন্যতম”)[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৫৮] এবং বললেন: (أبدأ بما بدأ الله به)(আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন আমিও তা দিয়ে শুরু করছি)। এই বলে তিনি সাফা পাহাড় থেকে সায়ীর কাজ শুরু করলেন। সাফা পাহাড়ের উপরে উঠলেন; যাতে করে বায়তুল্লাহকে দেখতে পান। এরপর কিবলামুখি হয়েআল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিলেন, তাকবীর দিলেন এবং বললেন:

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ أَنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الأَحْزَابَ وَحْدَهُ.

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। লাহুল মুলকু, ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহ, আনজাযা ওয়াদাহ, ওয়া নাসারা আবদাহ, ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহদা।

(অর্থ- নেই কোন উপাস্য এক আল্লাহ ব্যতীত। তিনি নিরঙ্কুশ। রাজত্ব তাঁর-ই জন্য। প্রশংসা তাঁর-ই জন্য। তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। নেই কোন উপাস্য এক আল্লাহ ছাড়া। তিনি প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন। তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন। এবং তিনি একাই সর্ব দলকে পরাজিত করেছেন।) এরপর তিনি দুআ করেছেন। এইভাবে তিনবার করেছেন। [সহিহ মুসলিম (১২১৮)]

ঙ. মারওয়া পাহাড়ের উপর:

সাফা পাহাড়ের উপর যা যা করেছেন মারওয়া পাহাড়ের উপরও তা তা করবেন; শুধু সাফাতে উঠারে আগে পঠিতব্য আয়াতে কারীমাটা ছাড়া। জাবের (রাঃ) বলেন: এরপর তিনি মারওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। যখন তিনি উপত্যকার নিম্নাঞ্চলে পৌঁছেন সেখান থেকে পাড়ে উঠা পর্যন্ত স্থানটুকু দৌঁড়িয়ে পার হন। এরপর স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে মারওয়াতে পৌঁছেন। সাফার উপরে যা যা করেছেন মারওয়ার উপরেও তা তা করেন।[সহিহ মুসলিম (১২১৮)]

যমযমের পানি পানকালে দুনিয়াবী ও আখেরী কল্যাণের যা খুশি তা প্রার্থনা করবেন। দলিল হচ্ছে- “যমযমের পানি যে উদ্দেশ্যে পান করা হবে তা ফলবে।”[সুনানে ইবনে মাজাহ (৩০৬২), আলবানী হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন (৫৫০২)] অনুরূপভাবে অধিক যিকির করার বিধান রয়েছে। এই যিকিরের মধ্যে রয়েছে- তওয়াফ ও সায়ীকালীন দুআ। সুতরাং তওয়াফ ও সায়ীকালে একজন মুসলিমের সাধ্যানুযায়ী দুআ করা উচিত।তওয়াফ ও সায়ীর মধ্যে কুরআন তেলাওয়াত করতে কোন আপত্তি নেই। কিছু কিছু লোক উল্লেখ করে থাকেন যে, তওয়াফ ও সায়ীর প্রত্যেক চক্করের জন্য বিশেষ বিশেষ দুআ রয়েছে। এ কথার কোন ভিত্তি নেই। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন:

আল্লাহ যে সব দুআর বিধান দিয়েছেন তওয়াফ ও সায়ীর মধ্যে সেসব দুআর মাধ্যমে আল্লাহর যিকির (স্মরণ) করা ও দুআ করা মুস্তাহাব। যদি মনে মনে কুরআন পড়ে তাতেও কোন আপত্তি নেই। তবে এক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত সুনির্দিষ্ট কোন যিকির নেই। না আছে তাঁর নির্দেশের মধ্যে, না আছে তাঁর কথা বা শিক্ষার মধ্যে। বরং শরিয়ত সম্মত যে কোন দুআ দিয়ে দুআ করতে পারবে। অনেক মানুষ বলে থাকে মিযাবের নীচে বিশেষ দুআ আছে। এসব কথার কোন ভিত্তি নেই।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই রুকনের মধ্যে

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

(অর্থ- হে আমাদের রব্ব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন, আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচান।)এই দুআ দিয়ে তওয়াফ শেষ করতেন। যেমনিভাবে তিনি তাঁর যে কোন দুআর আনুষ্ঠানিকতা এ দুআটি দিয়ে সমাপ্ত করতেন। ইমামগণের সর্বসম্মতিক্রমে এ স্থলে কোন ওয়াজিব যিকির নেই।[মাজমুউল ফাতাওয়া (২৬/১২২, ১২৩)]

আল্লাহই ভাল জানেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব