বৃহস্পতিবার 6 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 7 নভেম্বর 2024
বাংলা

পরীক্ষার কারণে রমজানের রোজা না-রাখা

প্রশ্ন

যখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, রমজানের রোজা রেখে পড়াশুনা করতে পারতাম না। সে জন্য দুই রমজানের কিছু রোজা আমি রাখি নি। এখন আমার উপর কি শুধু কাযা ওয়াজিব; নাকি শুধু কাফফারা ওয়াজিব? নাকি কাযা কাফফারা উভয়টা ওয়াজিব?

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

রমজান মাসে রোজা পালন ইসলামের অন্যতম একটি ভিত্তি। যে ভিত্তিগুলোর উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।ইবনেউমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লামবলেছেন:

( بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ : شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ ، وَإِقَامِ الصَّلاةِ ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ ، وَالْحَجِّ ، وَصَوْمِ رَمَضَان )

“ইসলাম পাঁচটি রোকনের উপর প্রতিষ্ঠিত: এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লালাহুআলাইহিওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল,নামাযকায়েম করা, যাকাত দেওয়া, হজ্জআদায় করা এবং রমজান মাসে রোজা পালন করা।”

সুতরাং যে ব্যক্তি রোজা ত্যাগ করলসে ইসলামের একটি রোকন ত্যাগ করল এবংকবিরা গুনাতেলিপ্ত হল। বরঞ্চসলফে সালেহিনদের কেউ কেউ এ ধরণের ব্যক্তিকে কাফির ও মুরতাদ মনে করতেন। আমরা এ ধরনের গুনাহ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। ইমাম যাহাবীতার‘আল-কাবায়ের’গ্রন্থে(পৃঃ ৬৪)বলেছেন:

“মুমিনদের মাঝে স্বীকৃত যে, যে ব্যক্তি কোন রোগ বা কারণ ছাড়া রমজান মাসে রোজা ত্যাগ করেসে ব্যক্তিযিনাকারী ও মদ্যপ মাতালের চেয়ে নিকৃষ্ট। বরং তাঁরা তারইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন এবং তার মাঝে ইসলামদ্রোহিতা ও বিমুখতারধারণা করেন।”সমাপ্ত

দুই:

পরীক্ষার কারণে রোজা না-রাখার ব্যাপারে শাইখ বিন বাযরাহিমাহুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি বলেন: “একজন মুকাল্লাফ (শরয়ি দায়িত্বপ্রাপ্ত) ব্যক্তির জন্য রমজান মাসে পরীক্ষার কারণে রোজা না-রাখা জায়েয নয়। কারণ এটি শরিয়ত অনুমোদিত ওজর নয়। বরং তার উপর রোজা পালন করা ওয়াজিব। দিনের বেলায় পড়াশোনা করাতার জন্য কষ্টকর হলে সে রাতের বেলায় পড়াশুনা করতে পারে।আর পরীক্ষা-নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উচিত ছাত্রদের প্রতি সহমর্মী হওয়া এবং রমজান মাসেরপরিবর্তে অন্য সময়ে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা। এর ফলে দুইটি সুবিধার মধ্যে সমন্বয় করা যায়। ছাত্রদের সিয়াম পালন ও পরীক্ষায় প্রস্তুতির জন্যঅবসর সময় পাওয়া।রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে সহিহ হাদিসে এসেছে তিনি বলেন:

( اللهممنوليمنأمرأمتيشيئاًفرفقبهمفارفقبه،ومنوليمنأمرأمتيشيئاًفشقّعليهمفاشققعليه )أخرجهمسلمفيصحيحه

“হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি আমার উম্মতের যে কোন পর্যায়েরকর্তৃত্ব লাভ করে তাদের সাথেকোমল হয় আপনিও তার প্রতিকোমল হন। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের কর্তৃত্ব পেয়ে তাদের সাথে কঠোর হয় আপনিও তার সাথেকঠোর হন।”[সহিহ মুসলিম]

তাই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ-কর্তৃপক্ষের প্রতি আমার উপদেশ হল- তাঁরা যেন ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সহমর্মী হন। রমজান মাসে পরীক্ষা না দিয়ে রমজানের আগে বা পরে পরীক্ষার সময়সূচী নির্ধারণ করেন। আমরা আল্লাহর কাছে সবার জন্য তাওফিক প্রার্থনা করি।”সমাপ্ত[ফাতাওয়াআশ-শাইখ ইবনে বায (৪/২২৩)] ‘ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি’কে প্রশ্ন করা হয়েছিল:

আমি রমজান মাসে একটানা সাড়ে ৬ ঘণ্টা পরীক্ষা দিব। মাঝে ৪৫ মিনিটের বিরতি আছে।একই পরীক্ষায় আমি গত বছরও অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু সিয়াম পালনের কারণে ভালোভাবে মনোযোগ দিতে পারিনি। তাই পরীক্ষার দিনে কি আমার রোজা না-রাখা জায়েযহবে?

তাঁরা উত্তরে বলেন:

“উল্লেখিত কারণে রোজা না-রাখা জায়েয নয়; বরং তা হারাম। কারণ রমজানে রোজা না-রাখার বৈধ ওজরের মধ্যে এটি পড়ে না।”সমাপ্ত

[ফাতাওয়াললাজ্‌নাদ্দায়িমা (ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়া সমগ্র (১০/২৪০)]

তিন:

না-রাখা রোজাগুলো কাযা করার ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রয়োজন:

আপনি যদিএই ভেবে রোজা না-রেখে থাকেন যে পরীক্ষার কারণে রোজা না-রাখা জায়েয, তবে আপনার উপর শুধু কাযা করা ওয়াজিব।আপনার যেহেতু ভুল ধারণা ছিল এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আপনি হারামে লিপ্ত হননি তাইআপনারওজুহাত গ্রহণযোগ্য। আর আপনি যদি তা হারাম জেনে রোজা না-রাখেন তবে আপনার উপর অনুতপ্ত হওয়া, তওবা করা এবং পাপ কাজে পুনরায় ফিরে না আসার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা ওয়াজিব।কাযা করার ক্ষেত্রেযদিআপনিরোজা শুরু করে দিনের বেলায় রোজা ভেঙ্গে ফেলেনতাহলে আপনাকে এর কাযা পালন করতে হবে। আর যদি আপনি শুরু থেকেই রোজা না-রেখে থাকেন তাহলে আপনার উপর কোনকাযা নেই। এর জন্য আল্লাহ চাহেত ‘সত্যিকার তওবা’(তওবায়ে নাসুহ)-ই যথেষ্ট। আপনার উচিত বেশি বেশি ভাল কাজ করা, নফল রোজা রাখা; যাতে করে ছুটে যাওয়াফরজ ইবাদতের ঘাটতিপূরণ করে নিতে পারেন।

শাইখ ইবনেউছাইমীনরাহিমাহুল্লাহকে রমজানে দিনের বেলায় বিনা ওজরে পানাহারেরহুকুমসম্পর্কেপ্রশ্ন করা হলে উত্তরে তিনি বলেন:

রমজানে দিনের বেলায় বিনা ওজরে পানাহার করা মারাত্মক কবিরাগুনাহ। এতে করে ব্যক্তি ফাসেকহয়ে যায়। তার উপর ওয়াজিব হচ্ছে- আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং রোজা না-রাখা দিনগুলোর কাযা রোজা পালন করা। অর্থাৎ সে যদি রোজা শুরু করে বিনা ওজরে দিনের বেলায় রোজা ভেঙ্গেফেলে তাহলে তার গুনাহ হবেএবং তাকে সে দিনের রোজা কাযা করতে হবে। কারণ সে রোজাটি শুরু করেছে, সেটি তার উপর অনিবার্য হয়েছে এবং সে ফরজ জেনে সে আমলটিশুরু করেছে। তাই মান্নতের ন্যায় এরকাযা করা তার উপর আবশ্যক। আর যদি শুরু থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিনা ওজরে রোজা ত্যাগ করেতবে অগ্রগণ্য মত হলতার উপর কাযাআবশ্যক নয়। কারণ কাযা করলেও সেটি তার কোন কাজে আসবে না। যেহেতু তাকবুল হবে না।

শরয়ি কায়েদা হল: নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পৃক্ত কোন ইবাদত যখন বিনা ওজরে সে নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা হয় না সেটা আর কবুল করা হয়না।কারণ নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেছেন:

( من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد )
“যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করল যাআমাদের দ্বীনে নেই তা প্রত্যাখ্যাত।”[সহিহ বুখারী (২০৩৫), সহিহ মুসলিম (১৭১৮)]

তাছাড়া এটি আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন। আল্লাহ তাআলারনির্ধারিত সীমানা লঙ্ঘন করা জুলুম বা অন্যায়। জালিমের আমল কবুলহয়না।আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

( وَمَنيَتَعَدَّحُدُودَٱللَّهِفَأُوْلَئِكَهُمُٱلظَّلِمُونَ )

“যারা আল্লাহর (নির্ধারিত) সীমারেখা লঙ্ঘন করেতারা জালিম (অবিচারী)।”[২ আল-বাক্বারাহ:২২৯]

এছাড়া সে ব্যক্তি যদি এইইবাদতটি নির্দিষ্ট সময়েরআগেপালনকরত তবে তা তার কাছ থেকে কবুল করা হতোনা, অনুরূপভাবে কোন ওজর ছাড়া সে যদি নির্দিষ্ট সময়ের পরে তা আদায় করেতবেসেটাও তার কাছ থেকে কবুল করাহবে না। সমাপ্ত

[মাজমূফাতাওয়াশ শাইখ ইবনে উছাইমীন (১৯/প্রশ্ন নং ৪৫)]

চার:

কাযা পালনে এই কয়েক বছর দেরী করার কারণে আপনার উপর তওবা করা আবশ্যক। যে ব্যক্তিরউপর রমজানের কাযা রোজা রয়েছেপরবর্তী রমজান আসার আগে তাপালন করে নেয়া ওয়াজিব। যদি সে এর চেয়ে বেশি দেরী করেতবে সে গুনাহগার হবে। এই বিলম্ব করার কারণে তার উপর কাফ্‌ফারা (প্রতিদিনেরপরিবর্তেএকজনমিসকীনখাওয়ানো) ওয়াজিব হবে কিনা-এ ব্যাপারে আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। নির্বাচিত মত হল-তার উপর কাফ্‌ফারা আদায় ওয়াজিব হবে না। তবে সাবধানতাবশতঃ আপনি যদি কাফফারা আদায় করেন তবে তা ভাল। আরও জানতে দেখুন (26865)নং প্রশ্নের উত্তর।

জবাবের সারাংশ হল:

আপনি যদি পরীক্ষার কারণে রোজা না-রাখা জায়েয মনে করে রোজা না-রেখে থাকেনঅথবা রোজা শুরু করে দিনে ভেঙ্গে ফেলেন তাহলে আপনাকে কাযা পালন করতে হবে; কাফফারা আদায় করতে হবে না। আমরা দোয়া করছি যাতে আল্লাহ আপনার তওবা কবুল করেন।

আল্লাহই ভাল জানেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব