শুক্রবার 21 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 22 নভেম্বর 2024
বাংলা

ভালোবাসা ও অবৈধ সম্পর্কের মধ্যে পার্থক্য

প্রশ্ন

আমি ২৪ বছর বয়সী একজন অবিবাহিত মেয়ে। খোলাখুলি কথা হল, আমি একজন পবিত্র চরিত্রের দ্বীনদার মানুষকে কোন প্রকার দেখা-সাক্ষাৎ করা ছাড়া পবিত্র ও নিষ্কলুষভাবে ভালবাসি। যিনি আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন; যেহেতু তার বর্তমান পরিস্থিতি কঠিন। আমি অস্বীকার করব না যে, তিনি একাধিকবার আমাকে ফোন করেছেন। কিন্তু, আমি তাকে বলেছি তিনি যেন আমাকে ফোন না করেন। কারণ আমি এতে সন্তুষ্ট নই; যদিও আমি তাকে ভালবাসি। কারণ আমার মনে হচ্ছিল যে, এভাবে ভালোবাসাটা ভুল পথে অগ্রসর হতে যাচ্ছে। তিনিও আমার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হয়েছেন এবং আমার মতামতকে সম্মান জানিয়েছেন। তিনি মাঝে মাঝে ইন্টারনেটে আমাকে কিছু কিছু মেসেজ পাঠান; যাতে করে আমি তার খবরাখবর জানতে পারি। এক বছর ধরে আমার সাথে তার সম্পর্ক। কিন্তু, তিনি খুব কঠিন পরিস্থিতিতে আছেন। এ ব্যক্তিকে আমি পারিবারিকভাবে চিনি। তার পরিবারের সাথে আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি তাকে আল্লাহ্‌র জন্য ভালবাসি এবং আমি নিশ্চিত যে, তিনিও একই অনুভূতি লালন করেন। কিন্তু, সমস্যা হল আমার পিতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয়েছে। বর্তমানে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে চাচ্ছেন এমন ছেলের সংখ্যা আটজন। কিন্তু, প্রত্যেকবার আমি প্রত্যাখ্যান করে আসছি; কারণ আমি তাকে অপেক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। বর্তমানে আমি এই পেরেশানিতে আছি যে, আমি যা করছি সেটা কি হালাল; নাকি হারাম? উল্লেখ্য, আলহামদু লিল্লাহ্‌; আমি ফরয, সুন্নত ও নফল নামায আদায় করি। তাহাজ্জুদের নামায পড়ি। আমার ভয় হচ্ছে, আমি যা করছি সে কারণে আমার নেক আমলগুলো নষ্ট হয়ে যায় কিনা? নিষ্কলুষ পবিত্র ভালোবাসা কি হারাম? আমার ভালোবাসা কি হালাল; না হারাম?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

প্রথমেই আমরা আল্লাহ্‌র কাছে আপনার জন্য তাওফিক ও কল্যাণের প্রার্থনা করছি। আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করছি তিনি যেন আপনার মত মেয়েদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন যারা পুতঃ পবিত্র চরিত্রের ব্যাপারে সচেতন, যারা তাদের সকল কর্মকাণ্ডে আল্লাহ্‌র সীমারেখা মেনে চলেন। এর মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- আবেগতাড়িত সম্পর্কগুলো; যে ক্ষেত্রে অনেক মানুষ শিথিলতা করে। যার ফলে তারা আল্লাহ্‌র সীমারেখাগুলো লঙ্ঘন করে এবং হারাম কাজে লিপ্ত হয়। ফলে আল্লাহ্‌ তাদেরকে এমন সব পরীক্ষার সম্মুখীন করেন যেসব মুসিবতের কথা আমরা পড়ে থাকি, শুনে থাকি; যেগুলোর মধ্যে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বরং প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের জন্য উপদেশ রয়েছে।

পর সমাচার, জেনে রাখুন বিপরীত লিঙ্গের দুইজন মানুষের মাঝে পত্র-যোগাযোগ একটি ফিতনার দরজা। এ পথ দিয়ে শয়তানের পাতানো ফাঁদে পা দেয়া থেকে সাবধানমূলক দলিল-প্রমাণ ইসলামী শরিয়তে ভরপুর। এমনকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এক যুবককে এক যুবতীর দিকে তাকাতে দেখলেন তখন তার গলা ঘুরিয়ে দিলেন যাতে করে যুবতীর উপর থেকে তার দৃষ্টি সরে যায়। এরপরতিনি বললেনঃ “আমি লক্ষ্য করলাম এরা দুইজন যুবক-যুবতী। সুতরাং তাদেরকে আমি শয়তান হতে নিরাপদ মনে করিনি।”।[সুনানে তিরমিযি (৮৮৫), আলবানী ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।]

তাই এ যুবকের সাথে ফোনে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আপনি সঠিক কাজটি করেছেন। আমরা আশা করব, তার সাথে আপনি ইমেইল আদান-প্রদানও বিচ্ছিন্ন করবেন। কেননা ইমেইল আদান-প্রদান বর্তমান যামানার লোকদের জন্য অনিষ্টের সবচেয়ে বড় রাস্তা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ইতিপূর্বে এ বিষয়ে একাধিক প্রশ্নোত্তরে সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। আপনি 34841 নং ও 45668 নং প্রশ্নদ্বয় পড়তে পারেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার জন্য বিশেষ কোন পুরুষ বা নারীর প্রতি কোন ব্যক্তি হৃদয়ে টান অনুভব করা, তার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করা, সম্ভব হলে তার সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়া হারাম। কারণ ভালোবাসা আন্তরিক বিষয়। ভালোবাসাটা কিছু জ্ঞাত কারণে কিংবা কিছু অজ্ঞাত কারণে অন্তরে ঢেলে দেয়া হয়। কিন্তু এ ভালোবাসা যদি অবাধ মেলামেশা, হারাম দৃষ্টি কিংবা হারাম কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে থাকে তাহলে সেটা হারাম। আর যদি এ ভালোবাসা কোন পূর্ব পরিচিতির কারণে, কিংবা আত্মীয়তার কারণে, কিংবা ঐ লোকের ব্যাপারে ভাল কিছু শুনে নিজের মন থেকে সেটা প্রতিহত করতে না পারার কারণে হয় তাহলে এ ভালোবাসাতে কোন গুনাহ নেই। তবে, শর্ত হচ্ছে- আল্লাহ্‌র সীমারেখা লঙ্ঘিত হতে পারবে না।

ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন:

“যদি কোন হারাম কারণ ছাড়া ভালোবাসা তৈরী হয় তাহলে এ ভালোবাসার কারণে ব্যক্তিকে নিন্দা করা হবে না। যেমন- যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে কিংবা তার দাসীকে ভালবাসত, এরপর তাদের মাঝে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে, কিন্তু ভালোবাসাটা মনের মধ্যে রয়ে গেছে– এমন ব্যক্তিকে নিন্দা করা হয় না। অনুরূপভাবে কারো যদি হঠাৎ চোখ পড়ে যায় এবং সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনের মাঝে ভালোবাসা স্থান করে নেয়। যদিও তার কর্তব্য এটাকে প্রতিহত করা ও দূর করা।”[সমাপ্ত][রওযাতুল মুহিব্বীন (পৃষ্ঠা-১৪)]

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন:

হতে পারে কোন ব্যক্তি কোন এক নারী সম্পর্কে শুনল যে, তিনি সচ্চরিত্রবান ও ইলমদার। শুনে তাকে বিয়ে করার আগ্রহী হল। অনুরূপভাবে সে নারী এ পুরুষ সম্পর্কে শুনল যে, তিনি সচ্চরিত্রবান, ইলমদার ও আমলদার। শুনে তার ব্যাপারে আগ্রহী হল। কিন্তু, মুসিবত হল ভালোবাসায় আবদ্ধ দুইজনের মাঝে শরিয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ যোগাযোগ। এ যোগাযোগের পরিণতি হচ্ছে– বিপদজনক। তাই বিয়ের নাম করে নারীর সাথে পুরুষের যোগাযোগ কিংবা পুরুষের সাথে নারীর যোগাযোগ জায়েয নয়। বরং সে পুরুষ মেয়ের অভিভাবককে জানাতে পারে যে, সে মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। কিংবা মেয়েটি তার অভিভাবককে অবহিত করতে পারে যে, সে ছেলেটিকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। যেমনটি উমর (রাঃ) তাঁর মেয়ে হাফসাকে আবু বকর (রাঃ) ও উসমান (রাঃ) এর কাছে পেশ করেছিলেন। পক্ষান্তরে, মেয়ে নিজে পুরুষের সাথে যোগাযোগ করা– এটাই তো ফিতনা।[সমাপ্ত][লিকাআতুল বাব আল-মাফতুহ (২৬/প্রশ্ন নং-১৩)]

আপনার প্রতি উপদেশ হচ্ছে– আপনি জরুরীভিত্তিতে এ যুবকের সাথে পত্র যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবেন এবং তাকে জানিয়ে দিবেন যে, প্রকৃতই যদি সে আপনাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে সে যেন আপনার অভিভাবকের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তার বৈষয়িক অবস্থা কিংবা অন্য কোন বিষয়কে প্রতিবন্ধক হিসেবে গ্রহণ না করে। ইনশাআল্লাহ্‌, বিষয়টি সহজ। যে ব্যক্তি অল্পতে সন্তুষ্ট আল্লাহ্‌ নিজ অনুগ্রহে তাকে সাবলম্বী করে দিবেন। কমপক্ষে সে যেন আপনার সাথে ‘বিয়ের আকদ’ করার জন্য অগ্রসর হয়। যদি বাসর করতে বিলম্বও হয় তাতে অসুবিধা নেই। পক্ষান্তরে, বিয়ের প্রতিশ্রুতির উপর বিষয়টিকে ঝুলিয়ে রাখা এবং এর ভিত্তিতে আপনার দুইজনের মাঝে পত্র যোগাযোগ চলতে থাকা শরয়ি দৃষ্টিতে, বাস্তবতার নিরিখে এবং শত শত অভিজ্ঞতার আলোকে এটি ভুল রাস্তা এবং পাপ ও অনৈতিক পন্থা। আপনি নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুন, আল্লাহ্‌র আনুগত্য ও শরিয়তের গণ্ডির মধ্যে থাকা ছাড়া অন্য কিছুতে আপনি সুখ পাবেন না। হারাম পন্থার বদলে শরিয়ত কর্তৃক বৈধকৃত পন্থা পর্যাপ্ত ও যথেষ্ট। কিন্তু, আমরা নিজেরা নিজেদের জন্য সংকীর্ণ করে ফেলি এরপর শয়তান আমাদের জন্য সংকীর্ণ করে দেয়।

বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বিলম্ব করা আপনার জন্য চরম ক্ষতিকর। হতে পারে আপনার বয়স বেড়ে যাবে, কিন্তু সে ছেলের অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। ফলে আপনি সে ছেলেকেও বিয়ে করতে পারবেন না, অন্য ছেলেদেরকেও বিয়ে করতে পারবেন না। অতএব, বিয়েতে দেরী করা থেকে সাবধান হোন। এতে ক্ষতি ছাড়া কিছু নেই। জেনে রাখুন, আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে যারা এগিয়ে আসতে চায় হতে পারে তাদের মধ্যে এমন কেউও থাকতে পারে যারা দ্বীনদারি ও পরহেযগারির দিক দিয়ে এ যুবকের চেয়েও ভাল। হতে পারে এ যুবকের মাঝে ও আপনার মাঝে যে ভালোবাসা এর চেয়ে বেশি ভালোবাসা আপনাদের দুইজনের মাঝে তৈরী হবে।

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব