আলহামদু লিল্লাহ।.
ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনা ঈমানের অন্যতম রুকন
ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্যতম হচ্ছে ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান; যে রুকনগুলো ছাড়া ঈমান প্রতিষ্ঠিত হয় না। যে ব্যক্তি এ ছয়টির কোনটির প্রতি ঈমান আনবে না সে ব্যক্তি মুমিন নয়। সে ছয়টি বিষয় হচ্ছে: আল্লাহ্র প্রতি ঈমান, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান, তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান, শেষ দিনের প্রতি ঈমান এবং ভালমন্দের তাকদির আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এর প্রতি ঈমান।
ফেরেশতা কারা?
ফেরেশতারা গায়েবী (অদৃশ্য) জগতের অন্তর্ভুক্ত; যে জগতকে আমরা দেখতে পাই না। তবে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর কিতাবের মাধ্যমে এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর মাধ্যমে তাদের সম্পর্কিত অনেক সংবাদ আমাদেরকে জানিয়েছেন। নিম্নে তাদের সম্পর্কে সঠিক কিছু তথ্য ও কিছু সাব্যস্ত হাদিস উদ্ধৃত করা হলো। প্রশ্নকারী বোন, আশা করি আপনি এ বিষয় সম্পর্কে যথাযথ ধারণা নিতে পারবেন, মহান স্রষ্টার বড়ত্বকে জানতে জানতে পারবেন এবং এই মহান ধর্মের মহত্বকে অনুধাবন করতে পারবেন।
ফেরেশতারা কীসের সৃষ্টি?
ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ্ নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন; যেমনটি আয়েশা (রাঃ) এর হাদিসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “ফেরেশতাদেরকে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জ্বিনদেরকে ধোঁয়াহীন আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা থেকে যেটার বর্ণনা তোমাদের কাছে পেশ করা হয়েছে।”[সহিহ মুসলিম (২৯৯৬)]
ফেরেশতাদের কখন সৃষ্টি করা হয়েছে?
তাদেরকে সৃষ্টি করার সুনির্দিষ্ট সময় আমাদের জানা নেই। যেহেতু এ বিষয়ে কোন দলিল উদ্ধৃত হয়নি। তবে এটা সুনিশ্চিত যে, তাদেরকে সৃষ্টি করা মানুষকে সৃষ্টি করার আগেই সম্পন্ন হয়েছে। যেহেতু কুরআনের দলিল হচ্ছে: “যখন আপনার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন: নিশ্চয় আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করব”।[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ৩০] অর্থাৎ তিনি তাদের কাছে মানুষ সৃষ্টি করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। এতে করে প্রমাণিত হয় যে, তারা মানুষের পূর্ব থেকে বিদ্যমান।
ফেরেশতাদের সৃষ্টির বিশালত্ব
আল্লাহ্ তাআলা জাহান্নামের ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে (জাহান্নামের) আগুন থেকে রক্ষা কর যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর, যার দায়িত্বে নিয়োজিত আছে নির্দয় ও কঠোর ফেরেশতারা। তারা আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্য করে না এবং যা করার নির্দেশ পায় তাই করে।”[সূরা তাহরীম, আয়াত: ৬]
সবচেয়ে বড় ফেরেশতা হচ্ছেন জিব্রাইল (আঃ)। তাঁর বর্ণনা সম্পর্কে এসেছে: আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিব্রাইলকে তার সআকৃতিতে দেখেছেন। তার আছে ছয়শটি ডানা। প্রত্যেক ডানা দিগন্ত জুড়ানো। তার ডানা থেকে যে অলংকার, মনি-মুক্ত ঝরে পড়ে এর সংখ্যা সম্পর্কে আল্লাহ্ই সম্যক অবগত।”[মুসনাদে আহমাদ, ইবনে কাছির ‘আল-বিদায়া’-তে বলেন: এর সনদ জায়্যিদ (ভালো)]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিব্রাইল আলাইহিস সালামের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন: “আমি তাকে আসমান থেকে অবতরণ দেখেছি এবং তার বিশাল আকৃতি আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থান পূর্ণ করেছিল।”[সহিহ মুসলিম (১৭৭)]
বিশাকালার ফেরেশতাদের মধ্যে রয়েছে আরশ বহনকারীরা। তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে: জাবির বিন আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “আমাকে আরশ বহনকারী আল্লাহ্র ফেরেশতাগণ সম্পর্কে আলোচনা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তার কানের লতি থেকে কাঁধ পর্যন্ত সাতশত বছরের রাস্তা”।[সুনানে আবু দাউদ, সুন্নাহ অধ্যায়, জাহমিয়্যা পরিচ্ছেদ]
ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্য
তাদের ডানা রয়েছে
আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা; যিনি দুই দুই, তিন তিন ও চার চার ডানাবিশিষ্ট ফেরেশতাদেরকে বার্তাবাহক করেছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যা চান বৃদ্ধি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।”[সূরা ফাতির, আয়াত: ১]
ফেরেশতাদের সৌন্দর্য
আল্লাহ্ তাআলা জিব্রাইল আলাইহিস সালামের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
عَلَّمَهُ شَدِيدُ ٱلْقُوَىٰ ذُو مِرَّةٍ فَٱسْتَوَىٰ
“তাকে (এটা) শিক্ষা দিয়েছেন প্রবল শক্তিমান, সৌন্দর্যপূর্ণ সত্তা (জিব্রাইল)। অতঃপর তিনি স্থির হয়েছিলেন।”[সূরা আন-নাজ্ম, আয়াত: ৫-৬]
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন: ذُو مِرَّةٍ: ذُوْ مَنظَرٍ حَسَنٍ (সুন্দর আকৃতির)। কাতাদা বলেন: লম্বা ও সুন্দর আকৃতির।
সমস্ত মানুষের কাছে এটি বিধিবদ্ধ যে, ফেরেশতারা সুন্দর। তাই তারা সুশ্রী মানুষকে ফেরেশতাদের সাথে উপমা দেয়। যেমনটি সত্যবাদী ইউসুফ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে নারীরা বলেছিল: فَلَمَّا رَأَيْنَهُ أَكْبَرْنَهُ وَقَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ وَقُلْنَ حَاشَ لِلَّهِ مَا هَذَا بَشَرًا إِنْ هَذَا إِلَّا مَلَكٌ كَرِيمٌ (অতঃপর তারা যখন তাকে দেখল তখন তারা তার সৌন্দর্যে অভিভূত হল ও নিজেদের হাত কেটে ফেলল এবং তারা বলল, ‘অদ্ভুত আল্লাহ্র মাহাত্ম্য! এ তো মানুষ নয়, এ তো এক মহিমান্বিত ফেরেশ্তা)।[সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩১]
ফেরেশতাদের আকৃতিগত ও মর্যাদাগত তারতম্য:
গঠন ও আকারে ফেরেশতারা সকলে একই পর্যায়ের নয়। বরঞ্চ তারা আকৃতির দিক থেকে বিভিন্ন; যেমনিভাবে মর্যাদার দিক থেকেও বিভিন্ন। তাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো যারা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন যেমনটি মুআয বিন রিফাআ বিন রাফে’ (রাঃ)-এর হাদিসে এসেছে; যে হাদিসটি তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের একজন। তিনি বলেন: “জিব্রাইল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন: আপনাদের মধ্যে যারা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে তাদেরকে আপনারা কী হিসেবে গণ্য করেন? তিনি বললেন: সর্বোত্তম মুসলিম কিংবা অনুরূপ কোন বাক্য। তখন জিব্রাইল বললেন: অনুরূপভাবে ফেরেশতাদের মধ্যে যারা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে তারাও”।[সহিহ বুখারী (৩৯৯২)]
ফেরেশতারা আহার ও পান করে না:
এটি প্রমাণ করে রহমানের খলিল ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও তার মেহমান ফেরেশতাদের মধ্যে যে সংলাপ হয়েছিল সেটি। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “তারপর ইব্রাহিম তার পরিবারের কাছে গেল এবং একটি (রান্নাকরা) মাংসল বাছুর নিয়ে এল। তারপর সেটি মেহমানদের সামনে পেশ করল, আর বলল: আপনারা খাবেন না? অতঃপর (মেহমানরা খাচ্ছে না দেখে) সে তাদের সম্পর্কে ভয় অনুভব করল। তারা বলল: ভয় করবেন না। এরপর তারা তাকে এক বিজ্ঞ পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দিল।”[সূরা যারিয়াত, আয়াত: ২৮]
অন্য আয়াতে এসেছে: “কিন্তু যখন সে দেখল, তাদের হাত সেদিকে যাচ্ছে না, তখন তাদেরকে খারাপ (উদ্দেশ্যে আগমনকারী) মনে করল এবং তাদের সম্পর্কে তার মনে ভীতির সঞ্চার হল। (এটা বুঝতে পেরে) তারা বলল, ‘ভয় পাবেন না; আমাদেরকে লূতের সম্প্রদায়ের কাছে (তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য) পাঠানো হয়েছে”।[সূরা হুদ, আয়াত: ৭০]
তিনি আরও বলেন: “রাতদিন তারা তাসবিহ পড়ে; বিরতি দেয় না”।[সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ২০]
তিনি আরও বলেন: “তাহলে (জেনে রাখুন) যারা আপনার প্রভুর সান্নিধ্যে রয়েছে তারা (অর্থাৎ ফেরেশতারা) রাতদিন তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে এবং তারা (কখনও) ক্লান্ত হয় না।”[সূরা ফুস্সিলাত, আয়াত: ৩৮]
ফেরেশতাদের সংখ্যা
ফেরেশতারা অনেক। তাদের সংখ্যা আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সপ্তম আকাশে বিদ্যমান বাইতুল মা’মুরের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: “অতঃপর আমাকে বাইতুল মা’মুরের দিকে উত্তোলন করা হয়। তখন আমি জিব্রাইলকে জিজ্ঞেস করলমা। তিনি বললেন: এটি আল-বাইতুল মা’মুর। এখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতারা নামায আদায় করেন। একবার যারা বেরিয়ে যায় তারা আর ফিরে আসে না। অপর দল একই আমল করে।”[সহিহ বুখারী (৩২০৭)]
আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “সেই দিন জাহান্নামকে এমতাবস্থায় আনা হবে যে, তার রয়েছে সত্তর হাজার লাগাম। প্রতিটি লাগামের সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা; যারা জাহান্নামকে টেনে নিয়ে যাবে।”[সহিহ মুসলিম (২৮৪২)]
ফেরেশতাদের নামসমূহ
ফেরেশতাদের নাম রয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের অল্প কিছু নাম জানি। দলিলে যে ফেরেশতার নাম উদ্ধৃত হয়েছে সেটার প্রতি নামসহ ঈমান রাখা ওয়াজিব। অন্যথায় কোন ব্যক্তির ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনার সামগ্রিকতার মধ্যে তার প্রতি এজমালিভাবে ঈমান আনা অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
ফেরেশতাদের নামগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১। জিব্রাইল ও ২। মিকাঈল:
কুরআনে কারীমে এসেছে: “যে কেউ আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর রাসূলগণ এবং জিব্রীল ও মীকালের শত্রু হবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্ কাফিরদের শত্রু”।[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ৯৮]
৩। ইস্রাফিল:
আবু সালামা বিন আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) বলেন: আমি উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী দিয়ে তার নামায পড়া শুরু করতেন; যখন তিনি রাত্রি বেলা নামায পড়তে দাঁড়াতেন। আয়েশা বলেন: যখন তিনি রাতের নামাযে দাঁড়াতেন তখন তিনি তাঁর নামায শুরু করতেন এই বলে:
اللَّهُمَّ رَبَّ جَبْرَائِيلَ وَمِيكَائِيلَ وَإِسْرَافِيلَ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ اهْدِنِي لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ إِنَّكَ تَهْدِي مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ . [رواه مسلم : 270]
“হে আল্লাহ! জিবরীল, মীকাঈল ও ইসরাফীলের রব্ব, আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, গায়েব ও প্রকাশ্য সব কিছুর জ্ঞানী, আপনার বান্দাগণ যেসব বিষয়ে মতভেদে লিপ্ত আপনিই তার মীমাংসা করে দিবেন। যেসব বিষয়ে মতভেদ হয়েছে তন্মধ্যে আপনি আপনার অনুমতিক্রমে আমাকে যা সত্য সেদিকে পরিচালিত করুন। নিশ্চয় আপনি যাকে ইচ্ছা সরল পথ প্রদর্শন করেন।”[সহিহ মুসলিম (২৭০)]
৪। মালিক:
ইনি হচ্ছেন জাহান্নামের রক্ষী। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “তারা চিৎকার করে বলবে, ‘হে মালিক, তোমার রব যেন আমাদেরকে নিঃশেষ করে দেন...”।[সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৭৭]
৫। মুনকার ও ৬। নাকীর:
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “মৃত লোককে বা তোমাদের কাউকে যখন কবরের মধ্যে রাখা হয় তখন তার নিকট কালো বর্ণের ও নীল চোখবিশিষ্ট দুইজন ফেরেশতা আসেন। তাদের মধ্যে একজনকে মুনকার ও অন্যজনকে নাকীর বলা হয়। তারা উভয়ে (মৃত ব্যক্তিকে) প্রশ্ন করেন: তুমি এ ব্যক্তি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে কী বলতে? মৃত ব্যক্তিটি (যদি মুমিন হয় তাহলে) পূর্বে যা বলত তাই বলবে: তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য সত্য নয় এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। তখন তারা উভয়ে বলবেন: আমরা জানতাম তুমি এ কথাই বলবে। তারপর সে ব্যক্তির কবর দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সত্তর হাত করে প্রশস্ত করা দেয়া হবে এবং করবে তার জন্য আলোর ব্যবস্থা করা হবে। তারপর সে লোককে বলা হবে: তুমি ঘুমিয়ে থাক। তখন সে বলবে: আমার পরিবার-পরিজনকে সুসংবাদ দেওয়ার জন্য আমি তাদের নিকট ফিরে যেতে চাই। তারা উভয়ে বলবেন: বাসর ঘরের বরের মত তুমি ঘুমাও, যাকে তার পরিবারের সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ জাগায় না। অবশেষে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তাকে তার বিছানা হতে জাগিয়ে তুলবেন। আর মৃত লোকটি যদি মুনাফিক হয় তাহলে (প্রশ্নের উত্তরে) বলবে: তার সম্পর্কে লোকদেরকে যা বলতে শুনেছি আমিও তাই বলতাম; আমি কিছু জানি না। তখন ফেরেশতাদ্বয় বলবেন: আমরা জানতাম, তুমি এ কথাই বলবে। তারপর জমিনকে বলা হবে, একে চাপ দাও। সে লোককে জমিন এমনভাবে চাপ দিবে যে, তার পাঁজরের হাড়গুলো একটি অপরটির মধ্যে ঢুকে যাবে। (কিয়ামতের দিন) আল্লাহ তাকে তার এ বিছানা হতে উঠানো পর্যন্ত সে লোক এভাবেই আযাব পেতে থাকবে।”[সুনানে তিরমিযি (১০৭১), আবু ঈসা বলেন: হাদিসটি হাসান, গরীব এবং হাদিসটিকে ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে (৭২৪) হাসান বলা হয়েছে]
৭। হারুত ও ৮। মারুত:
আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “এবং ব্যবিলনে দুই ফেরেশতার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছিল।”[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১০২]
এরা ছাড়াও আরও অনেক ফেরেশতারা রয়েছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “আর আপনার প্রভুর বাহিনী সম্পর্কে কেবল তিনিই জানেন। এটা (জাহান্নামের এই বর্ণনা) বস্তুত মানুষের জন্য এক সতর্কবাণী।”[সূরা মুদ্দাছ্ছির, আয়াত: ৩১]
ফেরেশতাদের ক্ষমতা
আল্লাহ্ তাআলা ফেরেশতাদেরকে বিপুল ক্ষমতা দান করেছেন; এর মধ্যে রয়েছে:
ভিন্ন আকৃতি ধারণ করার ক্ষমতা:
আল্লাহ্ ফেরেশতাদেরকে তাদের আকৃতি ছাড়া অন্য আকৃতি ধারণ করার ক্ষমতা দিয়েছেন। আল্লাহ্ তাআলা মারিয়াম আলাইহিস সালামের কাছে জিব্রাইল আলাইহিস সালামকে মানুষের আকৃতিতে পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন: “তখন আমি তার কাছে আমার রূহ (ফেরেশতা জিব্রাইল)-কে প্রেরণ করলাম। সে তার সামনে এক সুঠাম মানুষের আকারে আত্মপ্রকাশ করল।”[সূরা মারিয়াম, আয়াত: ১৭]
ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের কাছেও ফেরেশতারা মানুষের আকৃতিতে এসেছেন। তিনি বুঝতে পারেননি যে, তারা ফেরেশতা। অবশেষে তারাই তাঁকে জানিয়েছেন। অনুরূপভাবে ফেরেশতারা লুত আলাইহিস সালামের কাছে এসেছেন সুদর্শন যুবকদের চেহারায়। জিব্রাইল আলাইহিস সালাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একাধিক আকৃতিতে আসতেন। কখনও আসতেন দিহয়া আল-কালবী নামক সাহাবীর আকৃতিতে। তিনি সুদর্শন ছিলেন। কখনও বেদুঈন (মরুবাসী)-এর আকৃতিতে আসতেন। সাহাবীরা তাকে মানুষের আকৃতিতেই দেখেছেন যেমনটি সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এর হাদিসে এসেছে যে, একদা আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছিলাম। এমন সময় একজন লোক আমাদের কাছে এসে হাযির হলেন যার পরিধানের কাপড় ছিল ধবধবে সাদা এবং মাথার কেশ ছিল কুচকুচে কালো। তাঁর মধ্যে সফরের কোন আলামত ছিল না। কিন্তু আমাদের কেউ তাঁকে চিনে না। তিনি নিজের দুই হাঁটু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই হাঁটুর সাথে লাগিয়ে বসলেন। আর তার দুই হাত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই উরুর উপরে রাখলেন। তারপর তিনি বললেন: হে মুহাম্মদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে অবহিত করুন...। হাদিসটির শেষ পর্যন্ত।[সহিহ মুসলিম (৮)]
এটি ছাড়াও অন্য অনেক হাদিস রয়েছে; যেগুলো প্রমাণ করে যে, ফেরেশতারা মানুষের আকৃতি ধারণ করে। যেমন একশ জন মানুষকে হত্যাকারী ব্যক্তির হাদিসটি। সে হাদিসে রয়েছে: “তাদের কাছে মানুষের আকৃতিতে একজন ফেরেশতা এলেন”। এছাড়া শ্বেতীরোগে আক্রান্ত, টাকমাথা ও অন্ধ লোকের ঘটনা সম্বলিত হাদিসটি।
ফেরেশতাদের দ্রুতগতি
বর্তমানে মানুষ সর্বাধিক যে গতির কথা জানে সেটা হলো আলোর গতি। ফেরেশতাদের গতি আলোর গতির চেয়ে বহুগুণ বেশি। কারণ প্রশ্নকারী প্রশ্ন শেষ করতে না করতেই জিব্রাইল আলাইহিস সালাম পরাক্রম শক্তির মালিক আল্লাহ্র পক্ষ থেকে উত্তর নিয়ে হাযির হতেন।
ফেরেশতাদের দায়িত্বাবলী
- তাদের মধ্যে কারো দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে রাসূলগণের কাছে ওহী পৌঁছানো। তিনি হচ্ছেন: আর-রুহুল আমীন জিব্রাইল আলাইহিস সালাম। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “যে ব্যক্তি জিব্রাঈলের শত্রু—কারণ সে আল্লাহ্র নির্দেশেই তোমার অন্তরে এই কুরআন নাযিল করেছে।”[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ৯৭] তিনি আরও বলেন: “তা নিয়ে অবতরণ করেছে বিশ্বস্ত আত্মা (জিবরাঈল) তোমার অন্তরে; যাতে করে তুমি সতর্ককারী হও।”[সূরা আশ-শুআরা, আয়াত: ১৯৩-১৯৪]
- তাদের মধ্যে কেউ বৃষ্টির দায়িত্বে নিয়োজিত এবং আল্লাহ্ যেখানে চান সেখানে বৃষ্টি দেয়া। তিনি হচ্ছেন মিকাঈল আলাইহিস সালাম। তাঁর রয়েছে কিছু সহকারী; যারা তিনি তার প্রভুর নির্দেশে তাদেরকে যা নির্দেশ দেন তারা সেটা পালন করে এবং বাতাস ও মেঘকে আল্লাহ্ যেভাবে চান সেভাবে পরিচালিত করে।
- তাদের মধ্যে কেউ শিঙ্গার দায়িত্বে নিয়োজিত। তিনি হচ্ছেন ইস্রাফিল। কিয়ামত সংঘটনের সময় তিনি এতে ফুঁক দিবেন।
- তাদের মধ্যে কেউ আত্মাসমূহ কবজ করার দায়িত্বে নিয়োজিত। তিনি হচ্ছেন মালাকুল মউত ও তার সহযোগীরা। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “বলুন, তোমাদের (জান কবজের) জন্য নিয়োজিত মালাকুল মউত (মৃত্যুর ফেরেশতা) তোমাদের জান কবজ করবে। অতঃপর তোমাদেরকে তোমাদের প্রভুর নিকট ফিরিয়ে নেয়া হবে।”[সূরা আস-সাজ্দাহ, আয়াত: ১১]
- তাদের মধ্যে কারো কারো দায়িত্ব হচ্ছে বান্দাকে সফরে ও সস্থানে, শয়নে ও জাগরণে এবং সর্বাবস্থায় সংরক্ষণ করা। এরাই হচ্ছেন- “মুআক্কাবাত”। যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমাদের মধ্যে যে কথা গোপন করে আর যে তা প্রকাশ করে এবং যে রাতে লুকিয়ে থাকে আর যে দিনে অবাধে বিচরণ করে (তাঁর কাছে) সবাই সমান। মানুষের জন্য তার সামনে ও পেছনে রয়েছে ‘মুআক্কাবাত’ (একের পর এক আগমনকারী ফেরেশতাবৃন্দ)। তারা আল্লাহ্র নির্দেশে তাকে পাহারা দিয়ে রাখে। আল্লাহ্ তো কোন জনগোষ্ঠীর অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আর আল্লাহ্ যখন কোন জনগোষ্ঠীতে শাস্তি দিতে চান তখন কেউ তা ফেরাতে পারে না। তিনি ছাড়া তাদের কোন মিত্র নেই।”[সূরা আর-রাদ, আয়াত: ১০-১১]
- তাদের মধ্যে কেউ রয়েছে বান্দার ভাল-মন্দ কর্ম সংরক্ষণকারী। এরাই হচ্ছে ‘কিরামান কাতেবীন’ (সম্মানিত লেখক ফেরেশতারা)। আল্লাহ্ তাআলার নিম্নোক্ত বাণীগুলো তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে। তিনি বলেন: “তিনি তোমাদের জন্য রক্ষকদের পাঠান।”[সূরা আনআম, আয়াত: ৬১] তিনি আরও বলেন: “নাকি তারা মনে করে যে, আমি তাদের গোপন কথা ও গোপন পরামর্শ শুনি না? অবশ্যই শুনি। অধিকন্তু আমার দূতগণ (ফেরেশতারা) তাদের কাছে থেকে সবকিছু লিখে রাখে”।[সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮০] তিনি আরও বলেন: “স্মরণ করুন, দুই গ্রহণকারী (ফেরেশতা) (একজন) ডানে ও (একজন) বামে বসে (তার আমল) গ্রহণ করছে। সে যে কথাই উচ্চারণ করুক (তা গ্রহণ করার জন্য) তার কাছে একজন সদাপ্রস্তুত প্রহরী রয়েছে”।[সূরা ক্বাফ, আয়াত: ১৭-১৮] তিনি আরও বলেন: “তবে তোমাদের ওপর অবশ্যই তত্ত্বাবধায়করা আছে (অর্থাৎ তোমাদের কাজকর্মের ওপর নজর রাখার জন্য ফেরেশতারা নিয়োজিত আছে); সম্মানিত লেখকেরা;”[সূরা আল-ইনফিতার, আয়াত: ১০-১১]
- তাদের মধ্যে কেউ কেউ কবরের পরীক্ষা নেয়ার জন্য নিয়োজিত। এরা হলেন: মুনকার ও নাকীর। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মৃত লোককে বা তোমাদের কাউকে যখন কবরের মধ্যে রাখা হয় তখন তার নিকট কালো বর্ণের ও নীল চোখবিশিষ্ট দুইজন ফেরেশতা আসেন। তাদের মধ্যে একজনকে মুনকার ও অন্যজনকে নাকীর বলা হয়। তারা উভয়ে (মৃত ব্যক্তিকে) প্রশ্ন করেন: তুমি এ ব্যক্তি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে কী বলতে?... হাদিসটি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
- তাদের মধ্যে কেউ রয়েছেন জান্নাতের প্রহরী হিসেবে। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “আর যারা তাদের প্রভুকে ভয় করত, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে তারা জান্নাতের কাছে আসবে এবং জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হবে। আর জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে: ‘তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, তোমরা খুশী হও এবং চিরকাল থাকার জন্য এখানে প্রবেশ কর”।[সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩৭]
- তাদের মধ্যে কেউ রয়েছেন জাহান্নামের প্রহরী। এদেরকে বলা হয় ‘যাবানিয়্যা’। এই যাবানিয়্যাদের প্রধান হচ্ছেন উনিশজন। আর তাদের দলপ্রধান হচ্ছেন: মালিক। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “কাফেরদেরকে দলে দলে জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নেওয়া হবে। অবশেষে যখন তারা তার কাছে আসবে তখন তার দরজাগুলো খুলে দেওয়া হবে এবং তার রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূল আসেননি, যারা তোমাদেরকে তোমাদের প্রভুর আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাত এবং তোমাদেরকে আজকের দিনের সাক্ষাৎ সম্পর্কে সতর্ক করত? তারা বলবে, হ্যাঁ, তবে কাফেরদের বিরুদ্ধে শাস্তির হুকুম চূড়ান্ত হয়ে গেছে”।[সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৭১] তিনি আরও বলেন: “অতএব সে যেন তার সভাসদদেরকে (সাহায্যের জন্য) ডাকে। আমিও শীঘ্রই যাবানিয়্যাদেরকে ডাকব”।[সূরা আলাক্ব, আয়াত: ১৭-১৮] তিনি আরও বলেন: “আপনি কি জানেন, সাক্বার কী? তা বাঁচিয়েও রাখবে না, ছেড়েও দিবে না। মানুষকে দগ্ধকারী। এর প্রহরায় আছে উনিশজন ফেরেশতা। আমি ফেরেশতাদেরকেই জাহান্নামের প্রহরী করেছি। আর তাদের এ সংখ্যা নির্ধারণ করেছি কেবল কাফেরদেরকে পরীক্ষা করার জন্যই; যাতে কিতাবীদের প্রত্যয় জন্মে, মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায়।”[সূরা আল-মুদ্দাছ্ছির, আয়াত: ২৭-৩১] তিনি আরও বলেন: “তারা চিৎকার করে বলবে, ‘হে মালিক (জাহান্নামের রক্ষী)! আপনার প্রভু যেন আমাদের মৃত্যু ঘটান। (জবাবে) তিনি সে বলবে: আসলে তোমরা (এভাবেই এখানে) চিরকাল থাকবে।”[সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৭৭]
- তাদের মধ্যে কেউ জরায়ুতে বিদ্যমান ভ্রুণের দায়িত্বে নিয়োজিত। ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কাছে এই মর্মে হাদিস বর্ণনা করেছেন আর তিনি হচ্ছে সত্যবাদী ও সত্যায়িত: “তোমাদের সৃষ্টির উপাদানকে নিজ মায়ের পেটে একত্রিত করা হয়— চল্লিশ দিন পর্যন্ত বীর্যরূপে, অতঃপর তা জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয় অনুরূপ সময়ে। এরপর তা গোশতপিন্ডে পরিণত হয় অনুরূপ সময়ে। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে প্রেরণ করেন। তখন ফেরেশতা তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেয়। ফেরেশতাকে চারটি বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়। তাঁকে লিপিবদ্ধ করতে বলা হয়: তার আমল, তার রিয্কি, তার আয়ু এবং সে কি পাপী হবে; নাকি নেককার হবে। সেই সত্তার শপথ যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ! তোমাদের মধ্যে কেউ জান্নাতের অধিবাসীর আমল করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তার ও জান্নাতের মাঝে মাত্র এক হাত ব্যবধান থাকে। এরপর তাকদীরের লিখন তার উপর জয়ী হয়ে যায়। তখন সে জাহান্নামবাসীর মত আমল করতে থাকে; অবশেষে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। আর তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি জাহান্নামবাসীর কর্ম করতে থাকে। এক পর্যায়ে তার ও জাহান্নামের মাঝখানে মাত্র একহাত ব্যবধান থাকে। তখনি ভাগ্যলিপি তার উপর জয়ী হয়ে যায়। ফলে সে জান্নাতীদের আমল করতে থাকে। অবশেষে সে জান্নাতে প্রবেশ করে।”[ফাতহসহ সহিহ বুখারী (৩২০৮) ও সহিহ মুসলিম (২৬৪৩)]
- তাদের মধ্যে কেউ রয়েছেন আরশ বহনকারী। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “যারা আল্লাহ্র আরশ বহন করে এবং যারা চারপাশ ঘিরে থাকে তারা (সেই ফেরেশতারা) তাদের প্রভুর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তাঁর প্রতি ঈমান রাখে এবং মুমিনদের জন্য (তাঁর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা করে। (তারা বলে) ‘হে আমাদের প্রভু! অনুগ্রহ ও জ্ঞান দ্বারা আপনি সবকিছু ধারণ করে আছেন। অতএব যারা তওবা করে ও আপনার পথ অনুসরণ করে তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন’।”[সূরা গাফির, আয়াত: ৭]
- তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন পৃথিবীতে বিচরণকারী; যারা যিকিরের মজলিসগুলোকে খুঁজে বেড়ান। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় আল্লাহর একদল ফেরেশতা আছেন, যাঁরা আল্লাহর যিকিরে রত লোকেদের খোঁজে পথে পথে ঘুরে বেড়ান। যখন তাঁরা কোথাও আল্লাহর যিকরে রত লোকেদের দেখতে পান, তখন তারা একে অপরকে ডেকে বলে: তোমরা আপন আপন কাজ করার জন্য এগিয়ে এসো। তখন তাঁরা তাঁদের ডানাগুলো দিয়ে সেই লোকদের ঘিরে ফেলেন নিকটবর্তী আকাশ পর্যন্ত। তখন তাঁদের প্রতিপালক তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন (যদিও ফেরেশতাদের চেয়ে তিনিই অধিক জানেন) আমার বান্দারা কী বলছে? তখন তাঁরা বলে: তারা সুবহানাল্লাহ্, আল্লাহু আকবার, আলহামদু লিল্লাহ্ পড়ছে এবং আপনার স্তুতি করছে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করেন, তারা কি আমাকে দেখেছে? তখন তাঁরা বলেন: হে আমাদের প্রভু, ওয়াল্লাহি! তারা আপনাকে দেখেনি। তিনি বলেন: আচ্ছা, তবে যদি তারা আমাকে দেখত? তাঁরা বলেন: যদি তারা আপনাকে দেখত, তবে তারা আরও অধিক পরিমাণে আপনার ইবাদত করত, আরও অধিক আপনার মাহাত্ম্য ঘোষণা করত, আরও অধিক পরিমাণে আপনার প্রশংসা করত এবং আরও অধিক পরিমাণে আপনারা পবিত্রতা বর্ণনা করত।
বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহ বলবেন: তারা আমার কাছে কী চায়? তাঁরা বলবে: তারা আপনার কাছে জান্নাত চায়। তিনি জিজ্ঞেস করবেন: তারা কি জান্নাত দেখেছে? ফেরেশতারা বলবেন: আল্লাহ্র কসম! না। হে আমাদের প্রভু! তারা তা দেখেনি। তিনি জিজ্ঞেস করবেন: যদি তারা দেখত তবে তারা কী করত? তাঁরা বলবে: যদি তারা তা দেখত তাহলে তারা জান্নাতের আরও বেশি আগ্রহী হত, আরও বেশি সন্ধানী এবং এর জন্য আরও বেশি বেশি আকৃষ্ট হত। আল্লাহ্ তা’আলা জিজ্ঞেস করবেন: তারা কীসের থেকে আশ্রয় চায়? ফেরেশতাগণ বলবেন: জাহান্নাম থেকে। তিনি জিজ্ঞেস করবেন: তারা কি জাহান্নাম দেখেছে? তাঁরা জবাব দেবে: আল্লাহর কসম! হে আমাদের প্রভু! তারা জাহান্নাম দেখেনি।
তিনি জিজ্ঞেস করবেন, যদি তারা তা দেখত তাদের কী অবস্থা হত? তাঁরা বলবে: যদি তারা তা দেখত, তাহলে তারা তা থেকে আরও অধিক পলায়নপর হত এবং একে আরও বেশি ভয় করত। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন: আমি তোমাদের সাক্ষী রাখছি- আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। তখন ফেরেশতাদের একজন বলবে: তাদের মধ্যে অমুক ব্যক্তি আছে, যে তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং সে কোন প্রয়োজনে এসেছে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন: তারা এমন উপবেশনকারী যাদের মজলিসে উপবেশনকারী বিমুখ হয় না।[ফাতহুল বারীসহ সহিহ বুখারী (৬৪০৮)]
- তাদের মধ্যে কেউ আছে পাহাড়পর্বতের দায়িত্বে নিয়োজিত। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, একবার তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন: উহুদের দিনের চাইতে কঠিন কোন দিন কি আপনার উপর এসেছিল? তিনি বললেন: আমি তোমার কওমের লোকদের পক্ষ থেকে যে নির্যাতনের সম্মুখীন হওয়ার তা তো হয়েছি। সবচেয়ে বেশী কঠিন নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছি আকাবা (তায়েফের একটি স্থানের নাম)-এর দিন। যে দিন আমি নিজেকে ইবনে আবদে ইয়ালীল ইবনে আবদে কুলালের নিকট পেশ করেছিলাম। আমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিলাম তাতে তো সে সাড়া দেয়নি। তখন আমি এমন বিমর্ষ চেহারা নিয়ে ফিরে এলাম যে, কারনুস সাআলিব (একটি স্থানের নাম)-এ পৌঁছা পর্যন্ত আমার দুঃচিন্তা কাটেনি। এখানে এসে যখন আমি মাথা উপরের দিকে উঠালাম হঠাৎ দেখতে পেলাম এক টুকরা মেঘ আমাকে ছায়া দিচ্ছে। আমি সে দিকে তাকালে দেখলাম এর মধ্যে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আছেন। তিনি আমাকে ডেকে বললেন: আপনার কওম আপনাকে যা বলেছে এবং যে উত্তর দিয়েছে তা সবই আল্লাহ শুনেছেন। তিনি আপনার কাছে পাহাড়ের (দায়িত্বে নিয়োজিত) ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন যাতের করে আপনি এদের সম্পর্কে আপনার যা ইচ্ছা তাকে তা হুকুম করতে পারেন। তখন পাহাড়ের ফেরেশতা আমাকে ডাক দিয়ে সালাম দিলেন। তারপর বললেন: হে মুহাম্মদ! বিষয়টি আপনার ইচ্ছাধীন; আপনি চাইলে আমি তাদের উপর আখশাবাইন (দুটো পাহাড়)-কে চাপিয়ে দিব। উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: (না, তা নয়) বরং আমি আশা করি মহান আল্লাহ তাদের ঔরশে এমন প্রজন্ম বের করে আনবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে; তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না।”[ফাতহুল বারীসহ সহিহ বুখারী (৩২২১)]
- তাদের মধ্যে কেউ রয়েছেন ‘আল-বাইতুল মা’মুর’ যিয়ারতের দায়িত্বে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যেমনটি ইসরা ও মেরাজের লম্বা হাদিসে এসেছে: তারপর আমাকে আল-বাইতুল মা’মুরে উঠানো হল। তখন আমি জিবরীলকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন: এটি আল-বাইতুল মা’মুর। প্রতিদিন এতে সত্তর হাজার ফেরেশতা নামায আদায় করে। একবার যারা বের হয়ে যায় তারা আর ফিরে আসে না। অপর দল একই আমল করে।
- তাদের মধ্যে এমন কিছু ফেরেশতা আছে যারা কাতারবদ্ধ ক্লান্ত হয় না, দণ্ডায়মান বসে না, রুক ও সেজদারত; এর থেকে উঠে না। যেমনটি আবু যার (রাঃ) এর হাদিসে এসেছে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় আমি যা দেখি তোমরা তা দেখ না এবং আমি যা শুনি তোমরা তা শুন না। আসমান গোঙানির মত শব্দ করছে। তার শব্দ করাটা অযাচিত নয়। আসমানের এমন চার আঙ্গুল জায়গা নেই যেখানে কোন একজন ফেরেশতা আল্লাহ্র জন্য কপাল ঠেকিয়ে সেজদায় পড়ে নেই। আল্লাহ্র শপথ! আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে তাহলে তোমরা কম হাসতে, বেশি কাঁদতে এবং স্ত্রীদের সাথে বিছানায় মজা করতে না। বরং তোমরা আল্লাহ্র কাছে মিনতি করার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে আসতে।”[সুনানে তিরমিযি (২৩১২)]
সম্মানিত ফেরেশতাদের সম্পর্কে এটি একটি সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা।
আমরা আল্লাহ্র কাছে দোয়া করছি তিনি যেন আমাদেরকে ফেরেশতাদের প্রতি ঈমানদার ও তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণকারী বানিয়ে দেন।
আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হোক।
আরও জানতে ওয়েবসাইটের নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তরগুলো পড়ুন: