আলহামদু লিল্লাহ।.
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। শুক্রবারে আরাফা হলে সে বছরের হজ্জ সাত হজ্জের সমতুল্য এই মর্মে আমরা কোন হাদিস জানি না। তবে যেটা বর্ণিত আছে সেটা হচ্ছে- ৭০ হজ্জের সমতুল্য বা ৭২ হজ্জের সমতুল্য। কিন্তু কোন অবস্থাতে এ দুটি বর্ণনা সহিহ নয়। প্রথম উক্তিটি এক হাদিসের মতনে এসেছে তবে সে হাদিসটি বাতিল, সহিহ নয়। আর দ্বিতীয় উক্তিটির কোন সনদ বা মতন আমি পাইনি। এর কোন ভিত্তি নেই। উদ্ধৃত হাদিসের বক্তব্য হচ্ছে-
“সর্বোত্তম দিন হচ্ছে- যদি শুক্রবারে আরাফা হয়। সে হজ্জ শুক্রবারে হজ্জ নয় এমন ৭০ টি হজ্জের চেয়ে উত্তম।”
ইমামগণ এ হাদিসকে বাতিল ও গয়রে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন:
১. ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) বলেন:
পক্ষান্তরে মানুষের মুখে যা চালু আছে- এ হজ্জ ৭২টি হজ্জের সমান – এটি বাতিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে কেরাম বা তাবেয়ীগণ হতে এর কোন ভিত্তি নেই। আল্লাহই ভাল জানেন।[যাদুল মাআদ (১/৬৫)]
২. শাইখ আলবানী (রহঃ) ‘সিলসিলা যায়িফা’ গ্রন্থে হাদিসটিকে বাতিল ও গয়রে সহিহ আখ্যায়িত করার পর বলেন: কিন্তু “হাদিসটি রাযিন ইবনে মুয়াবিয়া ‘তাজরিদুস সিহাহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন”‘হাসিয়াতু ইবনে আবেদীন’ গ্রন্থে (২/৩৪৮) যাইলায়ীর এমন বক্তব্যের ব্যাপারেজেনে রাখুন রাযিনের এ গ্রন্থে সিহাহ সিত্তা (বুখারি, মুসলিম, মুয়াত্তা মালেক, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে তিরমিজি) এর হাদিসগুলো সংকলন করা হয়েছে যে পদ্ধতিতে ইবনুল আছির তাঁর ‘জামেউল উসুল মিন আহাদিছির রাসূল’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। তবে ‘তাজরিদুস সিহাহ’ গ্রন্থে এমন অনেক হাদিস আছে মূল গ্রন্থগুলোতে যে হাদিসের অস্তিত্ব নেই। এবং অন্য আলেমগণ তাঁদের গ্রন্থে তাঁর থেকে যে বর্ণনাগুলো সংকলন করেন সেগুলোর ব্যাপারেও একই কথা যেমন- মুনযিরি তাঁর ‘আত-তারগীব ওয়াত তারহীব’ গ্রন্থে। উল্লেখিত হাদিসটি এ ধরনের একটি হাদিস মূল গ্রন্থগুলোতে যে হাদিসটির অস্তিত্ব নেই। এমনকি হাদিসের সুপরিচিত অন্য কোন গ্রন্থেও এ হাদিসেরঅস্তিত্ব নেই। বরঞ্চ আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম তাঁর ‘যাদ’ (১/১৭) নামক গ্রন্থে এটি বাতিল বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি জুমার দিনে আরাফার দিন হওয়ার ১০টি মর্যাদা উল্লেখ করার পর বলেন: পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষের মুখে প্রচলিত আছে যে, এটি ৭২টি হজ্জের সমান- এ কথা বাতিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে কেরাম বা তাবেয়ীগণ হতে এর কোন ভিত্তি নেই।
মুনাবি ‘ফাতহুল কাদির’ (২/২৮) গ্রন্থে অতঃপর ইবনে আবেদনী ‘হাসিয়া’ নামক গ্রন্থে ইবনুল কাইয়্যেম এর মতকে সমর্থন করেছেন।[সমাপ্ত]
‘সিলসিলা যায়িফা’ (১১৯৩) গ্রন্থে বলেন: সাখাবি ‘আল-ফাতাওয়া আল-হাদিসিয়া’ (২/১০৫) গ্রন্থে বলেন: “রাযিন তার সংকলিত গ্রন্থে হাদিসটিকে মারফু হাদিস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বর্ণনাকারী সাহাবী কে? অথবা হাদিসটি কে বর্ণনা করেছেন তা উল্লেখ করেননি। আল্লাহই ভাল জানেন।” সমাপ্ত
তিনি সিলসিলা যায়িফা (৩১৪৪) গ্রন্থে আরও বলেন:
হাফেয ইবনে হাজার ‘ফাতহুল বারী’ (৮/২০৪) গ্রন্থে রাযিনের সংকলনের উদ্ধৃতি দিয়ে হাদিসটি উল্লেখ করার পর বলেন: আমি এ হাদিসের অবস্থা জানি না। কারণ তিনি সাহাবীর নাম উল্লেখ করেননি এবং হাদিসটি কে তাখরিজ (সংকলন) করেছেন সেটাও উল্লেখ করেননি।
হাফেয নাসের উদ্দিন আল-দিমাশকি তার ‘ফাদলু ইয়াওমু আরাফা’ নামক পুস্তিকাতে বলেন: “জুমার দিনে আরাফায় অবস্থান ৭২ টি হজ্জের সমতুল্য” হাদিসটি বাতিল; সহিহ নয়। অনুরূপভাবে যির ইবনে হুবাইশ থেকে বর্ণিত যে, “এই হজ্জ জুমার দিনে হজ্জ নয় এমন ৭০টি হজ্জের চেয়ে উত্তম।” হাদিসটিও সাব্যস্ত নয়। সমাপ্ত
৩. শাইখ উছাইমীন (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:
জুমরা দিন হজ্জ হওয়ার ফজিলতের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কিছু বর্ণিত আছে কিনা?
উত্তরে তিনি বলেন: জুমার দিন হজ্জ হওয়ার ফজিলত সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে কিছু বর্ণিত নেই। তবে আলেমগণ বলেন: জুমার দিনে হজ্জ হওয়াটা উত্তম।
এক: এই হজ্জ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হজ্জের সাথে মিলে যায়। কারণ নবী সাল্লাল্লামের আরাফায় অবস্থান জুমার দিনে ছিল।
দুই: জুমার দিনে এমন একটি সময় থাকে যে সময়ে কোন মুসলিম বান্দা যদি দাঁড়িয়ে নামাযরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে তবে সেটা কবুল হওয়ার অধিক উপযুক্ত।
তিন: আরাফার দিন ঈদ ও জুমার দিনও ঈদ। সুতরাং দুই ঈদের একত্রিত হওয়াটা কল্যাণকর।
পক্ষান্তরে যা মশহুর হয়ে গেছে যে, জুমার দিনে হজ্জ সত্তরটি হজ্জের সমান-গয়রে সহিহ।[আললিকা আশশাহরি (৩৪/১৮)]
৪. স্থায়ী কমিটির আলেমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:
কিছু মানুষ বলে: জুমাবার যদি হজ্জ হয় যেমন এ বছর হচ্ছে সেটা ৭টি হজ্জ আদায় করার সমান- এর পক্ষে কি সুন্নাহর কোন দলিল আছে?
তাঁর উত্তরে বলেন: এ বিষয়ে কোন সহিহ দলিল নেই। বরং কিছু মানুষ দাবী করছে, এটি ৭০টি হজ্জের সমান বা ৭২টি হজ্জের সমান- এটাও সহিহ নয়।[স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র (১১/২১০ ও ২১১)]
আরও দেখুন: ফাতহুল বারী (৮/২৭১) ও তুহফাতুল আহওয়াজি (৪/২৭)।
দুই: এ কথাটি বিস্তার লাভ করার কারণ বোধহয় এই যে, এটি হানাফি মাযহাব ও শাফেয়ি মাযহাবের কিতাবগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে।
হানাফিরা বলেন: জুমার দিনে হজ্জ হওয়া ৭০টি হজ্জের সমতুল্য। এমন জুমার দিনে প্রত্যেক ব্যক্তিকে কোন মাধ্যম ছাড়া ক্ষমা করে দেয়া হয়।
তাঁরা আরও বলেন: জুমার দিনে হজ্জ হলে সেটি সবচেয়ে উত্তম দিন। এটি সাধারণ ৭০ টি হজ্জের চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ।[রাদ্দুল মুহতার আলাদ দুররিল মুখতার (২/৬২১)]
শাফেয়িরা বলেন:
বর্ণিত আছে- জুমার দিন আরাফা হলে আল্লাহ তাআলা সকল আরাফাবাসীকে মাফ করে দেন। অর্থাৎ মাধ্যম ছাড়া মাফ করে দেন। আর জুমা ছাড়া অন্যদিন হজ্জ হলে মাধ্যমে মাফ করেন। অর্থাৎ নেককারদের উসিলায় বদকারদের মাফ করে দেন।[মুগনিল মুহতাজ (১/৪৯৭)]
তিন: হাদিসটি বাতিল হওয়ায় জুমার দিনে আরাফা হওয়ার যে, মর্যাদা নেই এমনটি নয়। বরং ইবনুল কাইয়্যেম ১০টি মর্যাদা উল্লেখ করেছেন। আমরা এখানে সেগুলো উল্লেখ করব:
তিনি বলেন:
সঠিক মতানুযায়ী জুমার দিন সপ্তাহের সবচেয়ে উত্তম দিন। আরাফার দিন ও কুরবানীর দিন বছরের সবচেয়ে উত্তম দিন। অনুরূপভাবে লাইলাতুল কদর ও জুমার রাত বছরের সবচেয়ে উত্তম রাত।এ কারণে জুমার দিন আরাফায় অবস্থানের অনেক মর্যাদা রয়েছে যেমন:
এক. উত্তম দুটি দিন একত্রিত হওয়া
দুই. এটি এমন দিন যে দিনে এমন একটি সময় আছে যে সময়ে দুআ কবুল হওয়া সুনিশ্চিত। অধিকাংশ আলেমের মতে সে সময় আসরের পর। আর এ সময়ে আরাফাবাসী দুআতে ও রোনাজারিতে মশগুল থাকেন।
তিন. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরাফায় অবস্থানের সাথে হুবহু মিলে যাওয়া।
চার. পৃথিবীর সর্ব প্রান্তের মুসলমান খোতবা শুনার জন্য ও জুমার নামায আদায় করার জন্য মসজিদে একত্রিত হওয়া। একই সময়ে আরাফাবাসী আরাফাতে একত্রিত হওয়া। এভাবে সমস্ত মুসলমান নিজ নিজ মসজিদে একত্রিত হওয়া ও আরাফাবাসীর দুআর ও রোনাজারির জন্য একত্রিত হওয়ার মাধ্যমে এমন কিছু অর্জিত হয় যা অন্য মাধ্যমে অর্জিত হয় না।
পাঁচ. জুমার দিন ঈদের দিন। আর আরাফার দিন আরাফাবাসীর জন্য ঈদতুল্য। এজন্য আরাফাবাসীর জন্য সেদিন রোজা রাখা মাকরুহ।...
আমাদের শাইখ (অর্থাৎ ইবনে তাইমিয়া) বলেন: আরাফার দিন আরাফাবাসীর জন্য ঈদ। যেহেতু তারা এ দিনে সবাই একত্রিত হন। পক্ষান্তরে অন্য মুসলমানেরা কুরবানীর দিন মিলিত হন। এ কারণে আরাফার দিন তাদের জন্য ঈদ। মূল কথা হচ্ছে- যদি আরাফার দিন ও জুমার দিনে পড়ে তাহলে দুই ঈদ একত্রিত হয়।
ছয়. এ দিনে মুমিন বান্দাদের জন্য আল্লাহর দেয়া শরিয়ত পরিপূর্ণ করা ও নেয়ামত পূর্ণ করার দিন। সহিহ বুখারিতে তারেক বিন শিহাব হতে বর্ণিত তিনি বলেন: এক ইহুদি উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এর নিকট এসে বলল: হে আমীরুল মুমেনীন, আপনারা আপনাদের ধর্মগ্রন্থে এমন একটি আয়াত পড়েন যদি সে আয়াতটি আমাদের ইহুদিদের উপর নাযিল হত আর আমরা জানতাম কোনদিন এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে তাহলে আমরা সেদিনকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ করতাম। তিনি বললেন: কোন আয়াতটি? ইহুদি বলল:
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
(অর্থ- আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদেরপ্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীনহিসেবে পছন্দ করলাম।)[সূরা মায়েদা, আয়াত:০৩] তখন উমর (রাঃ) বলেন: নিশ্চয় আমি জানি যেদিন ও যে স্থানে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে। এটি আরাফার ময়দানে শুক্রবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিল হয়েছে। তখন আমরা তাঁর সাথে আরাফার ময়দানে অবস্থান করছিলাম।
সাত. এটি কেয়ামতের দিনের মহা সম্মেলনের সাথে মিলযুক্ত। কারণ কেয়ামত শুক্রবারে সংঘটিত হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “সর্বোত্তম দিন হচ্ছে জুমার দিন। এদিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনে তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে, এ দিনে তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেয়া হয়েছে এবং এ দিনে কেয়ামত সংঘটিত হবে। এ দিনে এমন একটি সময় রয়েছে যদি কোন মুসলিম বান্দা সে সময়ে আল্লাহর কাছে ভাল কিছু চাইতে পারে আল্লাহ তাকে তা দান করেন।”
আট. জুমার দিনে ও রাতে মুসলমানদের আমল অন্য দিনের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। এমনকি পাপীরাও জুমার দিন ও রাতকে সম্মান করে থাকে এবং মনে করে থাকে এ দিনে যে ব্যক্তি গুনাহ করার স্পর্ধা দেখায় আল্লাহ তাকে অবিলম্বে শাস্তি দেন; দেরি করেন না। এটি তাদের নিকট স্বতঃসিদ্ধ। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তারা তা জেনেছে। তা এ দিনের মহান মর্যাদা, সম্মান ও আল্লাহর নিকট মনোনীত দিন হওয়ার কারণে। কোন সন্দেহ নেই এ দিনে আরাফায় অবস্থান নিতে পারার মর্যাদা অনেক বেশি।
নয়. জুমার দিন জান্নাতে কিছু বাড়তি পাওয়ার দিন...। এ দিন ও আরাফার দিন যদি মিলিত হয় তাহলে এর বাড়তি মর্যাদা থাকাটাই স্বাভাবিবক।
দশ. আরাফার দিন বিকেল বেলা আল্লাহ তাআলা আরাফাবাসীর নিকটবর্তী হন এবং ফেরেশতাদের কাছে তাদেরকে নিয়ে গর্ব করেন...
এ কারণগুলো এবং এগুলো ছাড়াও আর কারণ আছে যা জুমার দিনে আরাফায় অবস্থানকে বিশেষত্ব দিচ্ছে।
কিন্তু মানুষের মুখে মুখে যা চালু আছে যে, জুমার দিনের হজ্জ ৭২টি হজ্জের সমান এটি বাতিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অথবা কোন সাহাবী কিংবা কোন তাবেয়ী থেকে এ ধরনের কোন বর্ণনার ভিত্তি নেই।
যাদুল মাআদ (১/৬০-৬৫) থেকে সংক্ষেপিত।
আল্লাহই ভাল জানেন।