বুধবার 8 শাওয়াল 1445 - 17 এপ্রিল 2024
বাংলা

ঈদের কিছু বিধিবিধান ও ঈদে পালনীয় কিছু সুন্নত

প্রশ্ন

আমি ঈদে পালনীয় কিছু সুন্নত ও বিধিবিধান জানতে চাই।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

আল্লাহ্‌ তাআলা ঈদের জন্য কিছু বিধান দিয়েছেন; সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:

এক:

ঈদের রাতে তাকবীর দেওয়া মুস্তাহাব। রমযান মাসের সর্বশেষ দিনের সূর্যাস্ত থেকে শুরু করে ঈদের নামাযের ইমাম ঈদগাহে হাযির হওয়া পর্যন্ত। তাকবীরের শব্দাবলী হচ্ছে নিম্নরূপ:

 الله أكبر الله أكبر لا إله إلا الله والله أكبر الله أكبر ولله الحمد

(উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ)(অনুবাদ: আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ্‌ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ্‌ মহান, আল্লাহ্‌ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য।)

কিংবা 'তাকবীর' তিনবার উচ্চারণ করে এভাবেও বলতে পারেন:

الله أكبر، الله أكبر، الله أكبر، لا إله إلا الله . والله أكبر ، الله أكبر ، ولله الحمد 

(উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ)(অনুবাদ: আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ্‌ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ্‌ মহান, আল্লাহ্‌ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য।)

সবটিই জায়েয।

ব্যক্তির উচিত হাটেবাজারে, মসজিদে-নামাযের স্থানে ও বাড়ীঘরে এ যিকির দিয়ে তার ধ্বনিকে উচ্চকিত করা। তবে নারীরা তাকবীর দেওয়ার সময় তাদের কণ্ঠস্বর উচ্চকিত করবে না।

দুই:

ঈদের নামাযের উদ্দেশ্য বের হওয়ার আগে বেজোড় সংখ্যায় খেজুর খেয়ে বের হবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন প্রত্যুষে বেজোড় সংখ্যায় খেজুর খেয়ে তারপর বের হতেন। বেজোড় সংখ্যায় খেতে হবে যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমল করেছেন।

তিন:

সবচেয়ে ভাল পোশাক পরিধান করবে। এটি পুরুষদের জন্য। নারীরা ঈদগাহে যাওয়ার সময় সুন্দর পোশাক পরে বের হবে না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: (وليخرجن تَفِلات) অর্থাৎ তারা সাধারণ পোশাকে বের হবে; আকৃষ্টকারী কোন পোশাকে নয়। কোন নারী সুগন্ধি মেখে ও আকৃষ্টকারী হয়ে বের হওয়া হারাম।

চার:

কোন কোন আলেম ঈদের নামাযের জন্য গোসল করাকে মুস্তাহাব বলেছেন। কেননা কিছু কিছু সালাফ থেকে এটি বর্ণিত আছে। ঈদের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব; যেমনিভাবে জুমার নামাযে মানুষের সম্মিলনের জন্য গোসল করার বিধান রয়েছে। যদি কেউ গোসল করেন তাহলে সেটা ভাল।

পাঁচ:

ঈদের নামায আদায় করা। ঈদের নামায আদায় করা শরিয়তের বিধান মর্মে সকল মুসলমান ইজমা (একমত পোষণ) করেছেন। কারো কারো মতে, এটি সুন্নত। কেউ কেউ বলেছেন: এটি ফরযে কিফায়া। আবার কেউ কেউ বলেছেন: ফরযে আইন; যে ব্যক্তি এটি বর্জন করবে সে গুনাহগার হবে। এ অভিমতের পক্ষে তারা দলিল দেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনকি অন্তপুরবাসিনী কিশোরী, অবিবাহিত তরুণী এবং যাদের বাহিরে বের হওয়ার অভ্যাস নেই তাদেরকেও ঈদগাহে হাযির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হায়েযগ্রস্ত নারীরা নামাযের স্থান থেকে দূরে থাকবে। যেহেতু হায়েয অবস্থায় নামাযের স্থানে অবস্থান করা জায়েয নয়। যদিও নামাযের স্থান দিয়ে গমন করা জায়েয; কিন্তু অবস্থান করা জায়েয নয়। দলিলগুলো থেকে অগ্রগণ্যতা পাচ্ছে যে, ঈদের নামায ফরযে আইন। কোন ওজর না থাকলে ঈদের নামাযে হাযির হওয়া প্রত্যেক পুরুষ ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। এটি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার অভিমত।

ইমাম প্রথম রাকাতে সূরা 'আ'লা' পড়বেন, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা 'গাশিয়া' পড়বেন কিংবা প্রথম রাকাতে সূরা 'ক্বাফ' পড়বেন, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা 'ক্বামার' পড়বেন। উভয় পদ্ধতির পক্ষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহিহ হাদিস রয়েছে।

ছয়:

যদি জুমা ও ঈদ একই দিনে একত্রিত হয় তখন ঈদের নামায আদায় করা হবে এবং জুমার নামাযও আদায় করা হবে; যেমনটি প্রমাণ করে নুমান বিন বাশির (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস, যে হাদিসটি ইমাম মুসলিম তার 'সহিহ' গ্রন্থে রেওয়ায়েত করেছেন। তবে যে ব্যক্তি ইমামের সাথে ঈদের নামায আদায় করেছেন তিনি চাইলে জুমার নামাযে হাযির হতে পারেন। আর চাইলে যোহরের নামায পড়তে পারেন।

সাত:

অনেক আলেমের মতে, কেউ যদি ইমামের আগে ঈদগাহে উপস্থিত হয় তাহলে সে বসে পড়বে; দুই রাকাত নামায পড়বে না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দুই রাকাত নামায পড়েছেন; এর আগে বা পরে কোন নামায পড়েননি।

আর কিছু আলেমের মতে, কেউ যদি ঈদগাহে আসে তাহলে তিনি দুই রাকাত নামায না পড়ে বসবেন না। কেননা ঈদগাহ একটি নামাযের স্থান তথা মসজিদ। এর দলিল হচ্ছে হায়েযগ্রস্ত নারীদেরকে সেখানে অবস্থান করতে বারণ করা। সুতরাং ঈদগাহের জন্য মসজিদের হুকুম সাব্যস্ত হল। এটি প্রমাণ করে যে, ঈদগাহ একটি মসজিদ। অতএব, ঈদগাহও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: "যদি তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করে তখন সে যেন দুই রাকাত নামায না পড়ে না বসে" এর সাধারণ হুকুমের অধিভুক্ত হবে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের নামাযের আগে ও পরে নামায না পড়ার কারণ হল যখন তিনি হাযির হয়েছেন তখনই তিনি ঈদের নামায পড়ানো শুরু করেছেন। অতএব, ঈদগাহের জন্য তাহিয়্যাতুল মাসজিদ সাব্যস্ত হল যেভাবে সকল মসজিদের জন্য সাব্যস্ত। আরও কারণ হল, আমরা যদি বলি ঈদের নামাযের মসজিদের জন্য 'তাহিয়্যা' নেই তাহলে আমাদেরকে এটাও বলতে হবে যে, জুমার নামাযের মসজিদের জন্যেও 'তাহিয়্যা' নেই। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখনই জুমার মসজিদে হাযির হতেন সাথে সাথে খোতবা দেওয়া শুরু করতেন। এরপর দুই রাকাত নামায পড়ে চলে যেতেন। বাসায় গিয়ে জুমার সুন্নত নামায আদায় করতেন। জুমার নামাযের আগেও তিনি কোন নামায পড়তেন না, পরেও পড়তেন না।

আমার কাছে যে অভিমতটি অগ্রগণ্য সেটি হল: ঈদগাহেও তাহিয়্যাতুল মাসজিদ পড়া হবে। তবে তা সত্ত্বেও এ মাসয়ালার ক্ষেত্রে আমরা কেউ যেন কাউকে বাধা না দেই। যেহেতু মাসয়ালাটি মতবিরোধপূর্ণ। মতবিরোধপূর্ণ মাসয়ালায় বাধা দেওয়া চলে না। কেবল সেক্ষেত্রে চলে যে ক্ষেত্রে দলিল একেবারে সুস্পষ্ট। অতএব, যে ব্যক্তি নামায পড়ল আমরা তাকেও বাধা দিব না। আর ব্যক্তি বসে গেল আমরা তাকেও বাধা দিব না।

আট:

ঈদুল ফিতরের বিধানাবলীর মধ্যে রয়েছে যাকাতুল ফিতর (ফিতরা) ফরয হওয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের নামাযের আগেই ফিতরা পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ঈদের একদিন বা দুইদিন আগে ফিতরা পরিশোধ করা জায়েয। দলিল হচ্ছে ইবনে উমর (রাঃ) এর হাদিস যা ইমাম বুখারী সংকলন করেছেন: "তারা (সাহাবায়ে কেরাম) ঈদের একদিন বা দুইদিন আগে দিয়ে দিতেন"। যদি কেউ ঈদের নামাযের পরে পরিশোধ করে তাহলে সেটা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরা) হিসেবে আদায় হবে না। যেহেতু ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে এসেছে: "যে ব্যক্তি নামাযের আগে আদায় করেছে সেটা 'মকবুল ফিতরা'। আর যে ব্যক্তি নামাযের পরে আদায় করেছে সেটি (সাধারণ) সদকাসমূহের মধ্যে থেকে একটি সদকা।" তাই ফিতরা আদায়ে ঈদের নামাযের চেয়ে বেশি বিলম্ব করা হারাম। যদি কেউ কোন ওজর ছাড়া বিলম্ব করে তাহলে সেটা 'মকবুল ফিতরা' নয়। আর যে ব্যক্তির কোন ওজরের কারণে বিলম্ব হয়ে গেছে যেমন- সে ব্যক্তি সফরে থাকায় তার কাছে ফিতরা আদায় করার মত কিছু ছিল না; কিংবা কাকে দিবে এমন কাউকে পায়নি, কিংবা সে নির্ভর করেছে তার পরিবার আদায় করবে আর তার পরিবার নির্ভর করেছে যে সে আদায় করবে— এমন ব্যক্তি যখনই তার সুযোগ হয় তখনই আদায় করে দিবে। এমনকি এতে যদি নামাযের পরেও হয় তবুও তার গুনাহ হবে না। যেহেতু সে ওজরগ্রস্ত।

নয়:

একে অপরকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু শরিয়ত গর্হিত কাজ অনেক মানুষের পক্ষ থেকে ঘটে থাকে। সেটা হল পুরুষেরা বাসায় এসে মাহরাম কারো অনুপস্থিতিতে মহিলাদের বেপর্দা অবস্থায় তাদের সাথে মুসাফাহা করা। এতে সংঘটিত গর্হিত কাজ একটির চেয়ে অপরটি জঘন্য।

আমরা এটাও পাই যে, কেউ যদি নারীদের সাথে মুসাফাহা করা থেকে বিরত থাকে কিছু কিছু মানুষ তাকে এড়িয়ে চলে। অথচ তারাই হচ্ছে অন্যায়কারী; সে ব্যক্তি নয়। তারাই হচ্ছে সম্পর্ক ছিন্নকারী; সে ব্যক্তি নয়। তবে তার উচিত তাদেরকে বিধান বলে দেওয়া এবং নিশ্চিত হওয়ার জন্য নির্ভরযোগ্য আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করার পরামর্শ দেওয়া এবং তাদের এ বিষয়েও দিকনির্দেশনা দেওয়া যে, বাপদাদার প্রথা ধরে রাখার জন্য রাগ করা ঠিক না। কেননা কোন প্রথা হালালকে হারাম করতে পারে না; কিংবা হারামকে হালাল করতে পারে না। তার উচিত তাদের কাছে এ কথা তুলে ধরা যে, যদি তারা এটি করে তাহলে তাদের অবস্থা ঐ সকল ব্যক্তিদের মত যাদের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: "এমনিভাবে আপনার পূর্বে আমি যখনই কোন জনপদে কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই তাদের বিত্তশালীরা বলেছে: নিশ্চয় আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এক মতাদর্শে পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাংক অনুসরণ করে থাকব।"[সূরা যুখরুফ, আয়াত: ২৩]

কিছু কিছু মানুষের ঈদের দিন কবর যিয়ারত করা ও কবরবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর অভ্যাস রয়েছে। কবরবাসীদেরকে শুভেচ্ছা জানানোর কিছু নেই। তারা তো রোযাও রাখেনি, নামাযও পড়েনি।

কবর যিয়ারত ঈদের দিন বা জুমার দিন বা অন্য কোন দিনের সাথে খাস কিছু নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি রাতের বেলায়ও কবর যিয়ারত করছেন। যেমনটি সহিহ মুসলিমে সংকলিত আয়েশা (রাঃ) এর হাদিসে সাব্যস্ত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: "তোমরা কবর যিয়ারত কর, কারণ কবর যিয়ারত তোমাদেরকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়"।

কবর যিয়ারত একটি ইবাদত। কোন ইবাদত শরিয়ত মোতাবেক না হলে শরিয়তে সেটা অনুমোদনহীন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর যিয়ারতের জন্য ঈদের দিনকে খাস করেননি। সুতরাং কবর যিয়ারতের জন্য ঈদের দিনকে খাস করা উচিত নয়।

দশ:

ঈদের দিনে পুরুষেরা পরস্পর যে কোলাকুলি করে এতে কোন অসুবিধা নেই।

এগার:

ঈদের নামাযের জন্য এক রাস্তা দিয়ে বের হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণে অপর রাস্তা দিয়ে ফেরত আসার শরয়ি বিধান রয়েছে। এটি ঈদের নামায ব্যতীত অন্য কোন নামাযের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সুন্নত নয়; জুমার নামাযের ক্ষেত্রেও নয়; অন্য কোন নামাযের ক্ষেত্রেও নয়। বরং এটি ঈদের নামাযের সাথে খাস।[মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে উছাইমীন (১৬/২১৬-২২৩) সংক্ষেপে সংকলিত]   

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব