বৃহস্পতিবার 20 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 21 নভেম্বর 2024
বাংলা

ঈদের দিন যদি শুক্রবারে পড়ে এ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির ফতোয়া

প্রশ্ন

প্রশ্ন: সমস্ত প্রশংসা এক আল্লাহ্‌র জন্য। যে নবীর পরে আর কোন নবী নেই সে নবীর প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাথীবর্গের প্রতি আল্লাহ্‌র রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। পর সমাচার: যদি দুই ঈদ একত্রে পড়ে অর্থাৎ ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহার দিন এবং শুক্রবার যেটা হচ্ছে সাপ্তাহিক ঈদের দিন; এ সম্পর্কে প্রচুর প্রশ্ন আসছে: যে ব্যক্তি ঈদের নামায আদায় করেছে তার উপরে জুমার নামাযও কি ফরয হবে? নাকি ঈদের নামায পড়াই যথেষ্ট এবং জুমার নামাযের পরিবর্তে সে ব্যক্তি কি যোহরের নামায আদায় করবে? যোহরের নামাযের জন্যে কি মসজিদগুলোতে আযান দেয়া হবে; নাকি নয়? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। তাই স্থায়ী কমিটি নিম্নোক্ত ফতোয়া ইস্যু করলেন:

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

আলহামদুলিল্লাহ।

এ মাসয়ালার সাথে সম্পৃক্ত বেশ কিছু মারফু হাদিস ও মাওকুফ হাদিস রয়েছে; যেমন:

১। যায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) এর হাদিস: মুয়াবিয়া (রাঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, আপনি কি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়ে তার সাথে দুই ঈদ(ঈদ ও জুমা) একই দিনে অনুষ্ঠিত হতে দেখেছেন? তিনি উত্তর দিলেন: হ্যাঁ। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন: তিনি কি করেছিলেন? তিনি বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে ঈদের নামায আদায় করেন। অতঃপর জুমার নামায আদায়ের ব্যাপারে অবকাশ প্রদান করে বলেন: যে ব্যক্তি তা আদায় করতে চায়, সে তা আদায় করতে পারে।”[মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে ইবনে মাজাহ, সুনানে দারেমি, মুস্তাদরাকে হাকেম। হাকেম বলেন: এ হাদিসটির সনদ সহিহ; কিন্তু বুখারী ও মুসলিম হাদিসটি সংকলন করেননি। এ হাদিসটির সমর্থনে ইমাম মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ অন্য একটি হাদিস রয়েছে। ইমাম যাহাবীও হাকেমের সাথে একমত হয়েছেন। নববী ‘আল-মাজমু’ গ্রন্থে বলেন: এর সনদ জায়্যিদ (ভাল)]

২। এ হাদিসটির সমর্থনে অপর হাদিসটি হচ্ছে আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদিস: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আজকের এই দিনে দুইটি ঈদ (ঈদ ও জুমা) এর সমাগমঘটেছে। কেউ চাইলে – ঈদের নামাযে উপস্থিত হওয়া তার জন্য জুমার নামাযে উপস্থিত হওয়ার পরিবর্তে যথেষ্ট হবে। আমরা জুমার নামায পড়ব।”[যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে ‘হাকেম’ এ হাদিসটি সংকলন করেছেন। এ ছাড়াও এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, ইবনুল জারুদ, বাইহাকী ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থকারগণ]

৩। ইবনে উমর (রাঃ) এর হাদিস: তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় দুই ঈদ (জুমা ও ঈদ) এর সমাগম হল। তিনি লোকদের নিয়ে (ঈদের) নামায আদায় করার পর বললেন: যে ব্যক্তি জুমার নামাযে আসতে চায় সে আসতে পারে; আর কেউ না আসতে চাইলে সে না আসতে পারে।”[সুনানে ইবনে মাজাহ] তাবারানি তার ‘আল-মুজাম আল-কাবির’ গ্রন্থে হাদিসটি এ ভাষায় বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় দুই ঈদের সমাগম হল; ঈদুল ফিতর ও জুমার দিন। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের নিয়ে ঈদের নামায আদায় করলেন। এরপর লোকদের দিকে ফিরে বললেন: ওহে লোকসকল, আপনারা কল্যাণ ও সওয়াব অর্জন করেছেন। আমরা জুমার নামায আদায় করব। যে ব্যক্তি আমাদের সাথে জুমার নামায আদায় করতে চান তিনি আদায় করতে পারেন। আর যে ব্যক্তি তার পরিবারে ফিরে যেতে চান তিনি ফিরে যেতে পারেন।”

৪। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর হাদিস: রাসূলুল্লাল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আজকের এই দিনে দুই ঈদের সমাগম ঘটেছে। কেউ চাইলে ঈদের নামাযে উপস্থিত হওয়া তার জন্য জুমার নামাযে উপস্থিত হওয়ার পরিবর্তে যথেষ্ট হবে। ইনশা আল্লাহ্‌, আমরা জুমার নামায আদায় করব।[সুনানে ইবনে মাজাহ; বুসিরি বলেন: হাদিসটির সনদ সহিহ এবং বর্ণনাকারীগণ সকলে ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য]

৫। যাকওয়ান বিন সালেহ এর মুরসাল হাদিস: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় দুই ঈদের সমাগম হল; জুমার দিন ও ঈদুল ফিতরের দিন। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (ঈদের) নামায আদায় করলেন। এরপর দাঁড়িয়ে লোকদের উদ্দেশ্যে খোতবা দিলেন। তিনি বললেন: আপনারা যিকির করেছেন এবং কল্যাণ লাভ করেছেন। অবশ্য, আমরা জুমার নামায আদায় করব। তাই যে ব্যক্তি চান যে, অবস্থান করবেন (অর্থাৎ নিজ গৃহে) তিনি তা করতে পারেন। আর যে ব্যক্তি চান যে, জুমার নামায আদায় করবেন তিনি জুমার নামায আদায় করতে পারেন।

৬। আতা বিন আবু রাবাহ (রহঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার ইবনে যুবাইর (রাঃ) জুমার দিনের পূর্বাহ্ণে আমাদেরকে ঈদের নামায পড়ালেন। পরবর্তীতে আমরা জুমার নামায পড়তে যাই। কিন্তু তিনি না আসাতে আমরা প্রত্যেকে একাকী নামায আদায় করি। সে সময় ইবনে আব্বাস (রাঃ) তায়েফে ছিলেন। যখন আমরা(তার কাছে) এলাম বিষয়টি তার নিকট উল্লেখ করলাম। তিনি বললেন:  ইবনে যুবাইর (রাঃ) সুন্নাহ্‌ অনুসারে আমল করেছেন।[সুনানে আবু দাউদ, ইবনে খুযাইমাও হাদিসটি সংকলন করেছেন তবে অন্য ভাষ্যে এবং তাতে অতিরিক্ত রয়েছে; ইবনে যুবাইর (রাঃ) বলেন: দুই ঈদ একত্রিত হলে আমি উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) কে এভাবে করতে দেখেছি]

৭। সহিহ বুখারী ও মুয়াত্তা মালিক গ্রন্থে ইবনে আযহার এর ক্রীতদাস আবু উবাইদ থেকে বর্ণিত আছে; আবু উবাইদ বলেন: আমি উসমান (রাঃ) এর সাথে দুই ঈদ একত্রিত হওয়ার দিন উপস্থিত ছিলাম। সেই দিন ছিল জুমাবার। তিনি খোতবা দেয়ার আগে (ঈদের) নামায পড়ালেন। এরপর খোতবা দিলেন এবং বললেন: “হে লোকসকল, আজকের এই দিনে আপনাদের জন্য দুইটি ঈদ একত্রিত হয়েছে। আওয়ালি (মদিনার কিছু গ্রামের নাম) এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা জুমার নামাযের জন্য অপেক্ষা করতে চায় তারা অপেক্ষা করতে পারে। আর যারা চলে যেতে চায় আমি তাদেরকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলাম।”

৮। আলী বিন আবু তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার যখন দুই ঈদ একত্রিত হল তখন তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি জুমার নামায আদায় করতে চায় সে জুমার নামায আদায় করতে পারে। আর যে ব্যক্তি অবস্থান করতে চায় সে অবস্থান করতে পারে। সুফিয়ান বলেন: অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার গৃহে অবস্থান করতে চায়। এ রেওয়ায়েতটি মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকেও বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপ বর্ণনা মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বাতেও আছে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত উল্লেখিত মারফু হাদিস ও কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত মাওকুফ হাদিসের ভিত্তিতে এবং জমহুর আলেম তাদের ফিকহী গ্রন্থে যা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সে সবের ভিত্তিতে স্থায়ী কমিটি নিম্নোক্ত বিধানাবলি সুস্পষ্ট করছে:

১. যে ব্যক্তি ঈদের নামাযে হাযির হয়েছেন তাকে জুমার নামাযে উপস্থিত না হওয়ার অবকাশ দেয়া হবে। তিনি যোহরের ওয়াক্তে যোহরের নামায আদায় করবেন। আর যদি তিনি অবকাশ গ্রহণ না করে ‘আযিমত’ (অবকাশ গ্রহণ না-করা) এর উপর আমল করেন সেটা উত্তম।

২. যিনি ঈদের নামাযে হাযির হননি তিনি এ অবকাশ পাবেন না। তাই জুমার নামাযের ফরয বিধান তার থেকে রহিত হবে না। তার কর্তব্য হচ্ছে জুমার নামায আদায় করার জন্য মসজিদে যাওয়া। যদি জুমার নামায আদায় করার মত মুসল্লির সংখ্যা না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে যোহরের নামায আদায় করবেন।

৩. জুমা মসজিদ (জামে মসজিদ) এর ইমামের দায়িত্ব জুমার নামাযের আয়োজন করা যাতে করে যারা উপস্থিত হতে চায় তারা উপস্থিত হতে পারে এবং যারা ঈদের নামায পড়েনি তারা জুমার নামায পড়তে পারে; যদি জুমার নামায আদায় করার মত সংখ্যা পাওয়া যায়। আর যদি সংখ্যা পাওয়া না যায় তাহলে যোহরের নামায আদায় করবেন।

৪. যিনি ঈদের নামায আদায় করেছেন এবং জুমার নামায আদায় না করার অবকাশ গ্রহণ করতে চান তিনি যোহরের ওয়াক্ত হওয়ার পর যোহরের নামায আদায় করবেন।

৫. সেই দিন শুধুমাত্র ঐসব মসজিদে আযান উচ্চকিত করা শরিয়তসম্মত হবে যে সকল মসজিদে জুমার নামায আদায় করা হবে। সেই দিন যোহরের নামাযের জন্য আযান দেয়া শরিয়তসম্মত হবে না।

৬। ‘যে ব্যক্তি ঈদের নামাযে হাযির হয়েছে তার উপর সেই দিনের জুমার নামাযও নাই, যোহরের নামাযও নাই’ এমন বক্তব্য সঠিক নয়। এ কারণে আলেমগণ এমন উক্তিকে বর্জন করেছেন এবং এ অভিমতকে ভুল ও বিরল বলে রায় দিয়েছেন; যেহেতু এটি সুন্নতের খিলাফ অভিমত এবং কোন দলিল ছাড়া আল্লাহ্‌র ফরযকৃত বিধানকে বাদ দেয়ার নামান্তর। সম্ভবত এ অভিমত ব্যক্তকারীর কাছে হাদিস (রাসূলের বাণী) ও আছারগুলো (সাহাবীদের বাণীগুলো) পৌঁছেনি; যেগুলোতে ঈদের নামায আদায়কারীর জন্য জুমার নামায আদায় করা থেকে অবকাশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যোহরের নামায আদায় করা তার উপর ফরয।

আল্লাহ্‌ই সবচেয়ে ভাল জানেন। আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সাহাবীবর্গের উপর আল্লাহ্‌র রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।

ফতোয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি

শাইখ আব্দুল আযিয বিন আব্দুল্লাহ্‌ আলে-শাইখ (শাইখের বংশধর), শাইখ আব্দুল্লাহ্‌ বিন আব্দুর রহমান আল-গাদইয়ান, শাইখ বকর বিন আব্দুল্লাহ্‌ আবু যাইদ, শাইখ সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান।

সূত্র: স্থায়ী কমিটি