রবিবার 19 শাওয়াল 1445 - 28 এপ্রিল 2024
বাংলা

নারীদের সাথে কথা বলার শিষ্টাচার

প্রশ্ন

সাধারণভাবে ও নিম্নোক্ত অবস্থাগুলোত নারীদের সাথে কথা বলার শিষ্টাচার কেমন হবে: ক্রয়-বিক্রয়, পড়া ও পড়ানো, কাজের প্রয়োজনে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎগুলো; যেমন নারীকে নির্দিষ্ট কিছু বুঝিয়ে দেওয়া? এই অবস্থাগুলোতে চোখ অবনত রাখার হুকুম কী? সাধারণভাবে কখন নারীদের দিকে নজর দেওয়া জায়েয হবে? যথেষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আশা করছি।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে বেগানা (গায়রে-মাহরাম) নারীর সাথে কথা বলা:

যদি অপ্রয়োজনে হয় এবং নারীর কণ্ঠস্বর শুনে স্বাদ অনুভব হয় কিংবা নারী কোমল কণ্ঠে কথা বলে তাহলে সেটা হারাম। এটি জিহ্বা ও কানের ব্যভিচারের অন্তর্ভুক্ত। যেটার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আদম সন্তানের উপর ব্যভিচারের যতটুকু অংশ লিপিবদ্ধ করা রয়েছে ততটুকু সে অবশ্যই পাবে; এর থেকে নিস্তার নেই। নিঃসন্দেহে দুই চোখের ব্যভিচার হল তাকানো, দুই কানের ব্যভিচার হল শোনা, জিহ্বার ব্যভিচার হল কথোপকথন, হাতের ব্যভিচার হল ধরা, পায়ের ব্যভিচার হল হেঁটে যাওয়া, হৃদয়ের ব্যভিচার হল কামনা-বাসনা করা। আর লজ্জাস্থান তা সত্যায়িত করে বা মিথ্যা সাব্যস্ত করে।”[মুসলিম হাদীসটিকে উক্ত শব্দে বর্ণনা করেছেন: ২৬৫৭]

অন্যদিকে যদি নারীর সাথে কথা বলার প্রয়োজন থাকে তাহলে মৌলিকভাবে সেটা বৈধ। কিন্তু নিম্নোক্ত শিষ্টাচারগুলো রক্ষা করা বাঞ্চনীয়:

১- প্রয়োজনীয় কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা; যে কথা উদ্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। বিষয়গুলোর শাখা-প্রশাখায় লম্বা আলাপ জুড়ে দেওয়া যাবে না। সম্মানিত ভাই, এক্ষেত্রে আপনি সাহাবীদের শিষ্টাচার ভেবে দেখুন। যাতে করে আমাদের বর্তমান অবস্থাগুলোর সাথে সেটাকে তুলনা করতে পারেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে মুনাফিকরা যে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল তিনিই সেই ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সে ঘটনার মধ্যে তিনি বলেছেন:

“সাফওয়ান ইবনুল মুয়াত্তাল, যিনি প্রথমে আস-সুলামী এবং পরে আয-যাকওয়ানী (গোত্রীয় উপনাম) সৈন্য বাহিনীর পেছনে ছিলেন। তিনি সকালের দিকে আমার অবস্থান স্থলের কাছাকাছি এসে পৌঁছলেন এবং একজন ঘুমন্ত মানুষকে আবছা দেখতে পেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। দেখেই আমাকে চিনতে পারলেন। কারণ পর্দার বিধান নাযিলের আগেই তিনি আমাকে দেখেছিলেন। তার ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া-ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়ার শব্দে আমি জেগে উঠলাম এবং আমি আমার জিলবাব দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর কসম! আমরা কোনো কথা বলিনি এবং তার মুখ থেকে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া-ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ ছাড়া তার কাছ থেকে কোনো শব্দ শুনিনি। তিনি নেমে উটটিকে হাঁটু গেড়ে বসালেন এবং উটের সামনের পা চেপে ধরলেন। তখন আমি উটের কাছে গিয়ে উটের পিঠে আরোহন করলাম। তিনি আমাকেসহ সওয়ারীটি সামনে থেকে টেনে নিয়ে চললেন। অবশেষে আমরা সেনাদলের কাছে পৌঁছলাম।”[বুখারী (৪১৪১) ও মুসলিম (২৭৭০)]

ইরাকী (রহঃ) বলেন:

“তার কাছ থেকে কোনো শব্দ শুনিনি” এই কথা পুনরাবৃত্তি নয় (তথা পূর্বের কথা: ‘আল্লাহর কসম! আমরা কোনো কথা বলিনি’ এর পুনরাবৃত্তি নয়)। হতে পারত তিনি (সাফওয়ান) তার সাথে কথা বলেন না; কিন্তু নিজের সাথে কথা বলেন। কিংবা কুরআন তেলাওয়াত বা যিকির তিনি (আয়েশা) শুনার মত উচ্চস্বরে পড়তে পারতেন। কিন্তু তিনি (সাফওয়ান) সেটাও করেননি। বরং শিষ্টাচার ও মর্যাদা রক্ষা এবং পরিস্থিতির ভয়াবহতায় তিনি নীরবতা বজায় রাখেন।

এই হাদীস থেকে প্রাপ্ত অন্যতম শিক্ষা হলো: বেগানা নারীর সাথে উত্তম শিষ্টাচার বজায় রাখা। বিশেষতঃ জরুরী পরিস্থিতিতে মরুভূমিতে কিংবা অন্য কোথাও তাদের সাথে নির্জন বাস ঘটলে। যেমনটি সাফওয়ান (রাঃ) করেছিলেন। তিনি কোনো কথা না বলে বা প্রশ্ন না করে উটকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন।”[সংক্ষেপে সমাপ্ত][ত্বারহুত তাসরীব (৮/৫৩)]

২- হাসি-ঠাট্টা এড়িয়ে চলা। কেননা এটা শিষ্টাচার বা ব্যক্তিত্বের মধ্যে পড়ে না।

৩- স্থির নজরে দেখা থেকে বিরত থাকা। সাধ্যমত দৃষ্টি নীচু রাখতে সচেষ্ট থাকা। তবে কথা বলতে গিয়ে যদি অল্প নজর পড়ে যায় তাহলে গুনাহ হবে না; ইনশা আল্লাহ।

৪- উভয়পক্ষ থেকে কোমল স্বরে কথাবার্তা না হওয়া। যেমন: কৃত্রিমভাবে স্বরকে নরম করা, কথাকে কোমল করা। উভয়পক্ষ স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে কথা বলা। আল্লাহ তায়ালা উম্মাহাতুল মুমিনীনকে বলেন, “তোমরা পর-পুরুষের সাথে কোমল কন্ঠে এমনভাবে কথা বলো না যাতে অন্তরে যার ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়তোমরা সঙ্গত কথা বলবে।”[সূরা আহযাব, আয়াত: ৩২]

৫- প্রেম-ভালোবাসার কিঞ্চিৎ ভাব বা ইঙ্গিতবহ শব্দগুলো এড়িয়ে চলবে। অথবা এমন সব শব্দ পরিহার করবে যেগুলো নারী বা পুরুষের লিঙ্গের সাথে বিশিষ্ট।

৬- শ্রোতার ওপর প্রভাব সৃষ্টি করার শৈলীগুলোতে বাড়াবাড়ি ত্যাগ করা। কিছু মানুষ অন্যদের সাথে কথার সময় তার সর্বোচ্চ যোগ্যতা প্রয়োগ করে; সেটি কথা বলতে গিয়ে হাত-মুখ নাড়ানো কিংবা কবিতা, প্রবাদ-বাক্য বা আবেগী বাক্য ব্যবহার করার মাধ্যমে। যেহেতু এটি দুই লিঙ্গের মাঝে হারাম সম্পর্ক তৈরিতে শয়তানের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।

ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন:

“কবিগণ বেগানা নারীর সাথে কথাবার্তা বলা এবং তাদের দিকে তাকানোকে কোনো সমস্যা মনে করে না। অথচ এটা শরীয়ত এবং আকলের বরখেলাফ। এতে করে প্রত্যেকের স্বভাবে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যে আকর্ষণ আছে সেটাকে জাগ্রত করে তোলা হয়। এর কারণে কত মানুষ যে দ্বীনি ও দুনিয়াবী ফিতনায় পড়েছে!”[রাওদাতুল মুহিব্বীন (পৃ-৮৮)]

ইতিপূর্বে উল্লেখিত বিষয়ে 1497 নং, 59873 নং এবং 102930 নং প্রশ্নোত্তরে আলোচনা করা হয়েছে। নারীদের সাথে কথাবার্তার শিষ্টাচার সম্পর্কে আমাদের ওয়েবসাইটে আলাদা একটা ক্যাটাগরি আছে ভিজিট করতে পারেন।

আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব