বুধবার 26 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 27 নভেম্বর 2024
বাংলা

কবরের কাছে নামায আদায় ও শাফায়াতের শর্তাবলি

প্রশ্ন

সুফিবাদের অনুসরণ করে আমার এমন এক সঙ্গীর সাথে কথা বলছিলাম। কবরে নামায আদায় করা সম্পর্কে এবং কিয়ামতের দিন কিছু নেককার আলেমদের শাফায়াত নিয়ে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল।

আমি তাকে বললাম: কবরে নামায আদায় করা শির্ক। কিয়ামতের দিন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কেউ শাফায়াত (সুপরিশ) করবে না। আমি এ প্রসঙ্গে আলেমদের মতামত জানতে চাই। এ সংক্রান্ত দলীল কোথায় পাবো? আশা করি আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক: কবরে নামায আদায় করার মাসয়ালা

কবরে নামায আদায় দুই প্রকার:

প্রথম প্রকার: কবরবাসীর জন্য নামায আদায় করা। এটি বড় শির্ক; যা ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয়। কারণ নামায এক প্রকার ইবাদত। আর কোন ইবাদত আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য করা জায়েয নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ۖ

“তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো; তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না।”[সূরা নিসা: ৩৬] আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন:

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا

“আল্লাহর সাথে শরীক করা হলে তিনি তা ক্ষমা করেন না। এর চেয়ে লঘু গুনাহ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করে সে মহা (অপনোদন করা কঠিন এমন) বিভ্রান্তিতে পতিত হয়।”[সূরা নিসা: ১১৬]

দ্বিতীয় প্রকার: কবরস্থানে আল্লাহর জন্য নামায পড়া। এর অধীনে কয়েকটি মাসআলা রয়েছে:

১- কবরের উপর জানাযার নামায পড়া। এটি জায়েয।

এর নমুনা হলো: কোনো ব্যক্তি মারা গেল। কিন্তু আপনি তার জন্য মসজিদে জানাযা পড়তে পারেননি। এমন অবস্থায় তাকে দাফন করার পর আপনি নামায পড়তে পারেন।

এই বিষয়টির দলীল হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক কালো পুরুষ অথবা মহিলা মসজিদ ঝাড়ু দিতেন। তিনি মারা গেলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বলল: তিনি মারা গিয়েছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “তোমরা কেন আমাকে জানালে না? আমাকে তার কবর দেখিয়ে দাও।” তারপর তিনি তার কবরে এসে নামায আদায় করলেন।[হাদীসটি বুখারী (৪৫৮) বর্ণনা করেন, ভাষ্যও তার। মুসলিমও (৯৫৬) এটি বর্ণনা করেন]

২- কবরস্থানে জানাযার নামায পড়া। এটা জায়েয।

এর নমুনা হলো: একজন ব্যক্তি মারা গেল। আপনি মসজিদে গিয়ে তার জানাযার নামায পড়তে পারেননি। কিন্তু আপনি কবরস্থানে গেলেন এবং তাকে দাফন করার পূর্বে তার জানাযা পড়লেন।

শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহ বলেন: কবরস্থানের ভেতর জানাযার নামায পড়া জায়েয, যেমনিভাবে দাফনের পর জানাযার নামায পড়া জায়েয। যেহেতু সাব্যস্ত হয়েছে যে, এক দাসী মসজিদ ঝাড়ু দিত। সে মারা যাওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলল: সে তো মারা গিয়েছে। তিনি বললেন: “তোমরা কেন আমাকে খবর দিলে না? আমাকে তার কবর দেখিয়ে দাও।” তারা তাকে সেই কবর দেখিয়ে দিলে তিনি তাতে নামায আদায় করলেন। তারপর বললেন: “এই কবরগুলো কবরবাসীর জন্য অন্ধকারে পরিপূর্ণ। আমার নামাযের ফলে আল্লাহ তাদের জন্য এগুলো আলোকিত করে দেন।”[হাদীসটি মুসলিম (৯৫৬) বর্ণনা করেন][ফাতাওয়াল-লাজনাহ আদ-দাইমাহ: ৮/৩৯২]

৩- কবরস্থানে জানাযার নামায ছাড়া অন্য নামায পড়া। এই নামায বাতিল বলে গণ্য হবে; সঠিক হবে না। হোক সেটা ফরয কিংবা নফল নামায।

প্রমাণ:

এক: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “সমগ্র যমীন মসজিদ; কেবল কবর ও গোসলখানা ছাড়া।”[হাদীসটি তিরমিযী (৩১৭) ও ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন এবং শাইখ আলবানী এটিকে সহীহ ইবনে মাজাহ গ্রন্থে (৬০৬) সহিহ বলে গণ্য করেছেন]

দুই: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “আল্লাহ ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর অভিশাপ দিন। তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করেছে।”[হাদীসটি বুখারী (৪৩৫) ও মুসলিম (৫২৯) বর্ণনা করেন]

তিন: যৌক্তিক কারণ। সেটি হলো কবরে নামায আদায় করাকে কবরপূজা করা কিংবা কবরপূজাকারীর সাথে সাদৃশ্যের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হতে পারে। এ কারণে কাফেররা যেহেতু সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় সিজদা দিত তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময়টিতে নামায পড়তে নিষেধ করে দেন; যাতে করে এটাকে আল্লাহর বদলে সূর্যপূজার একটি উপায় হিসেবে গ্রহণ করা না হয় কিংবা কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা না হয়।

৪- কবরের দিকে মুখ করে নামায আদায় করা। বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী এটি হারাম।

এর নমুনা হলো: আপনি নামায পড়ছেন এভাবে যে, আপনার কিবলার দিকে একটি কবরস্থান বা কবর রয়েছে। যদিও আপনি কবরস্থানে নামায পড়ছেন না; কিন্তু কবরের খুব কাছের যমীনে নামায পড়ছেন। আপনার ও কবরের মাঝে কোন দেয়াল বা প্রাচীর নেই।

এটি হারাম হওয়ার দলীল:

১- আবু মারসাদ আল-গানাওয়ী বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “তোমরা কবরের উপর বসবে না এবং কবরের দিকে নামায পড়বে না।”[হাদীসটি মুসলিম (৯৭২) বর্ণনা করেন] উক্ত হাদীস প্রমাণ করে যে কবরস্থানের দিকে কিংবা কিছু কবরের দিকে অথবা একটি কবরের দিকে নামায পড়া হারাম।

২- আর যেহেতু কবরস্থানে নামায পড়া হারাম হওয়ার হেতুটি কবরের দিকে নামায পড়ার মাঝেও পাওয়া যায়। ব্যক্তি যেহেতু কবরের দিকে কিংবা কবরস্থানের দিকে এভাবে ফিরে থাকছে যে, তার ব্যাপারে বলা যায় যে সে কবরের দিকে ফিরে নামায পড়ছে; তাই সে নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যদি নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে “তোমরা নামায পড়ো না” এই হাদীসের কারণে সহিহ হবে না। যেহেতু এখানে নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। কেউ যদি কবরের দিকে ফিরে নামায পড়ে তাহলে তার এ আমলে আনুগত্য ও অবাধ্যতা উভয়টা একত্রিত হলো। এমনটি করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন করা সম্ভব নয়।

লক্ষণীয় বিষয়: যদি আপনার মাঝে ও কবরগুলোর মাঝে প্রতিবন্ধক হিসেবে দেয়াল থাকে, তাহলে সে অবস্থায় নামায পড়তে সমস্যা ও নিষেধাজ্ঞা নেই। অনুরূপভাবে যদি আপনার মাঝে ও কবরগুলোর মাঝে রাস্তা অথবা কিছুটা দূরত্ব থাকে যার কারণে আপনি কবরের দিকে ফিরে নামায আদায়কারী হয়ে যান না; তাহলে সমস্যা নেই। আর আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

দেখুন: আল-মুগনী (১/৪০৩) ও ইবনু উছাইমীনের আশ-শারহুল মুমতি (২/২৩২)। আল্লাহ সবাইকে রহম করুন।

দুই: শাফায়াতের মাসআলা:

কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া কেউ শাফায়াত (সুপারিশ) করবে না, এটি আপনি ভুল বলেছেন। বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ অন্যান্য মুমিনরাও শাফায়াত করবেন।

কিন্তু এখানে আমরা একটি মাসআলা যুক্ত করব যা ঐ প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করা হয়নি। শাফায়াতের কিছু শর্ত রয়েছে:

এক: সুপারিশকারীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শাফায়াত করার অনুমতি থাকা।

দুই: সুপারিশকৃত ব্যক্তির ব্যাপারে আল্লাহর সন্তুষ্টি।

এই দুই শর্তের পক্ষে দলীল হলো আল্লাহর বাণী:

وَكَم مِّن مَّلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِن بَعْدِ أَن يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَن يَشَاءُ وَيَرْضَىٰ

“আসমানে অনেক ফেরেশতা আছে, যাদের সুপারিশ কোনো কাজে আসবে না; তবে আল্লাহ যার জন্য চান এবং যার উপর তিনি সন্তুষ্ট, তার পক্ষে তিনি সুপারিশ করার অনুমতি দেওয়ার পর (তা কাজে আসবে)।”[সূরা নাজম: ২৬]

এবং আল্লাহর বাণী:

وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَىٰ

“তারা কেবল তার জন্যই সুপারিশ করতে পারবে যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।”[সূরা আম্বিয়া: ২৮]

আর মূর্তিপূজারীরা যে কাল্পনিক শাফায়াতের কথা ভাবে; সেটি বাতিল সুপারিশ। কারণ আল্লাহ কাউকে সুপারিশের অনুমতি দেন না, যতক্ষণ না তিনি সুপারিশকারী ও সুপারিশকৃতদের ব্যাপারে সন্তুষ্ট থাকেন।[দেখুন, শাইখ ইবনে উছাইমীনের আল-কাওলুল মুফীদ শারহু কিতাবিত তাওহীদ: (পৃ. ৩৩৬-৩৩৭), প্রথম সংস্করণ]

তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ঈমানদারদের সুপারিশ করার স্বীকৃতি থাকাটা তাদের কাছ থেকে সুপারিশ তলব করার বৈধতা প্রদান করে না। যেমনটি দেখা যায় যে, কিছু মানুষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তাঁর কাছ থেকে শাফায়াত চেয়ে থাকে।

সূত্র: শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ