আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
এ প্রশ্নটি পেয়ে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। সন্তানদের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া ও তাদেরকে আল্লাহর আনুগত্যের ভিত্তিতে গড়ে তোলার আন্তরিক চেষ্টার ইঙ্গিত বহন করে এ ধরনের প্রশ্ন। এটি অধীনস্থদের কল্যাণ কামনার অন্তর্ভুক্ত।আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার উপর যাদের দায়দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।
দুই:
শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে ৯ বছরের ছেলে সিয়াম পালনে মুকাল্লাফ (দায়িত্বপ্রাপ্ত) নয়। কারণ সে এখনও সাবালক হয়নি।তবে আল্লাহ তা‘আলা ইবাদতের উপর সন্তানদেরকে লালন-পালনের দায়িত্ব পিতা-মাতার ওপর অর্পণ করেছেন। ৭ বছর বয়সী সন্তানকে নামায শিক্ষা দেয়ার জন্য পিতামাতার প্রতি আদেশ জারী করেছেন। নামাযে অবহেলা করলে ১০ বছরবয়স হতে বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান সাহাবীগণ তাঁদের সন্তানদেরকে ছোটবেলা থেকে রোযা রাখাতেন, যেন তারা এ মহান ইবাদত পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। এ আলোচনা হতে সন্তানসন্ততিকে উত্তম গুণাবলী ও ভাল কাজের উপর গড়ে তোলার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সালাতের ব্যাপারে এসেছে:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
“আপনারা আপনাদের সন্তানদের ৭ বছর বয়সে সালাত আদায়ের আদেশ করুন।এ ব্যাপারে অবহেলা করলে ১০ বছর বয়সে তাদেরকে প্রহার করুন এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দিন।” [হাদিসটিআবু দাউদ বর্ণনা করেছেন (নং ৪৯৫) এবং শাইখ আলবানী সহীহ আবু দাউদগ্রন্থেএ হাদিসকে সহীহ হাদিস বলে চিহ্নিত করেছেন]
রোযার ব্যাপারে এসেছে:
রুবাইবিনতে মুআওয়েয ইবনে আফরা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার সকালে মদিনার আশেপাশে আনসারদের এলাকায় (এই ঘোষণা) পাঠালেন : ‘যে ব্যক্তি রোযা অবস্থায় সকাল শুরু করেছে, সে যেন তার রোযা পালন সম্পন্ন করে। আর যে ব্যক্তি বে-রোযদার হিসেবে সকাল করেছে সে যেন বাকি দিনটুকু রোযা পালন করে।’ এরপর থেকে আমরা আশুরারদিনরোযা পালন করতাম এবং আমাদের ছোট শিশুদেরকেও (ইনশাআল্লাহ্) রোযা রাখাতাম। আমরা (তাদের নিয়ে) মসজিদে যেতাম এবং তাদের জন্য উল দিয়ে খেলনা তৈরী করে রাখতাম।তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে সেই খেলনা দিয়ে ইফতারের সময় পর্যন্ত সান্ত্বনা দিয়ে রাখতাম। [হাদিসটিবর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী (নং ১৯৬০) ও মুসলিম (নং ১১৩৬)]
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রমজান মাসে এক মদ্যপকে বলেছিলেন :
“তোমার জন্য আফসোস! আমাদের ছোট শিশুরা পর্যন্ত রোযাদার!” এরপর তাকে প্রহার করা শুরু করলেন। [হাদিসটি ইমাম বুখারীসনদবিহীন বাণী (মুআল্লাক) হিসেবে ‘শিশুদের রোযা’ পরিচ্ছেদে সংকলন করেছেন]
যে বয়সে শিশু রোযা পালনে সক্ষমতা লাভ করে সে বয়স থেকে পিতামাতা তাকে প্রশিক্ষণমূলক রোযা রাখাবেন। এটি শিশুর শারীরিক গঠনের উপর নির্ভর করে। আলেমগণের কেউ কেউ এ সময়কে ১০ বছর বয়স থেকে নির্ধারণ করেছেন। এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জবাব দেখুন (65558)নং প্রশ্নের উত্তরে।সেখানে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা পাবেন। তিন : শিশুদেরকে রোযা পালনে অভ্যস্ত করে তোলার বেশকিছু পন্থা রয়েছে:
১। শিশুদের নিকট রোযার ফজিলত সম্পর্কিত হাদিসগুলো তুলে ধরতে হবে। তাদেরকে জানাতে হবে সিয়াম পালন জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম। জান্নাতের একটি দরজার নাম হচ্ছে ‘আর-রাইয়্যান’।এ দরজা দিয়ে শুধু রোযাদারগণ প্রবেশ করবে।
২। রমজান আসার পূর্বেই কিছু রোযা রাখানোর মাধ্যমে সিয়াম পালনে তাদেরকে অভ্যস্ত করে তোলা। যেমন- শা’বান মাসে কয়েকটি রোযা রাখানো। যাতে তারা আকস্মিকভাবে রমজানের রোযার সম্মুখীন না হয়।
৩। প্রথমদিকে দিনের কিছু অংশে রোযা পালন করানো।ক্রমান্বয়ে সেই সময়কে বাড়িয়ে দেয়া।
৪। একেবারে শেষ সময়ে সেহেরি গ্রহণ করা।এতে করে তাদের জন্য দিনের বেলায় রোযা পালন সহজ হবে।
৫। প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে তাদেরকে রোযা পালনে উৎসাহিত করা।
৬। ইফতার ও সেহেরীর সময় পরিবারের সকল সদস্যের সামনে তাদের প্রশংসা করা।যাতে তাদের মানসিক উন্নয়ন ঘটে।
৭। যার একাধিক শিশু রয়েছে তাদের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করা। তবে খুবই সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে যাতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া শিশুটির প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করা না হয়।
৮। তাদের মধ্যে যাদের ক্ষুধা লাগবে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়েঅথবা বৈধ খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা। এমন খেলনা যাতে পরিশ্রম করতে হয় না। যেভাবে মহান সাহাবীগণ তাঁদের সন্তানদের ক্ষেত্রে করতেন। নির্ভরযোগ্যইসলামী চ্যানেলগুলোতে শিশুদের উপযোগী কিছু অনুষ্ঠান রয়েছেএবংরক্ষণশীল কিছু কার্টুন সিরিজ রয়েছে। এগুলো দিয়ে তাদেরকে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে।
৯। ভাল হয় যদি বাবা তার ছেলেকে মসজিদে নিয়ে যান। বিশেষতঃ আসরের সময়। যাতে সে নামাযের জামাতে হাযির থাকতে পারে। বিভিন্ন দ্বীনি ক্লাসে অংশ নিতে পারে এবং মসজিদে অবস্থান করে কুরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহ তা’আলার যিকিরে রত থাকতে পারে।
১০। যেসব পরিবারের শিশুরা রোযা রাখে তাদের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য দিনে বা রাতের কিছু সময় নির্দিষ্ট করে নেয়া। যাতে তারা সিয়াম পালন অব্যাহত রাখার প্রেরণা পায়।
১১। ইফতারের পর শরিয়ত অনুমোদিত ঘুরাফিরার সুযোগ দেয়া। অথবা তারা পছন্দ করে এমন খাবার, চকলেট, মিষ্টি, ফল-ফলাদি ও শরবত প্রস্তুত করা।
আমরা এ ব্যাপারেও লক্ষ্য রাখতে বলছি যে, শিশুর যদি খুব বেশি কষ্ট হয় তবে রোযাটি পূর্ণ করতে তার ওপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়া উচিত নয়।যাতে তার মাঝে ইবাদতেরপ্রতি অনীহা না আসে অথবা তার মাঝে মিথ্যা বলার প্রবণতা তৈরী না করে অথবা তার অসুস্থতা বৃদ্ধির কারণ না ঘটায়। কেননা ইসলামী শরিয়তে সে মুকাল্লাফ (ভারার্পিত) নয়। তাই এ ব্যাপারে খেয়াল রাখা উচিত এবং সিয়াম পালনে আদেশ করার ব্যাপারে কড়াকড়ি না করাউচিত।
আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।