আলহামদু লিল্লাহ।.
جدول المحتويات
কুফরের স্বরূপ ও প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা বেশ দীর্ঘ। তবে আমরা নিম্নোক্ত পয়েন্টগুলোর আলোকে সংক্ষেপে কিছু কথা বলব:
কুফর ও কুফরের প্রকারভেদ জানার গুরুত্ব
কুরআন-সুন্নাহর দলিলসমূহ প্রমাণ করে যে দু’টো বিষয় বাস্তবায়ন করা ছাড়া ঈমান শুদ্ধ নয় ও গ্রহণযোগ্য নয়। এ দু’টো বিষয়ই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-তে সাক্ষ্য দেয়ার মর্ম। সে দু’টো বিষয় হচ্ছে: ১। তাওহীদের (একত্ববাদের) স্বীকৃতি দিয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ। ২। সকল প্রকার কুফর ও শির্ক থেকে বেঁচে থাকা।
কোনো ব্যক্তির পক্ষে কোনো কিছুকে স্পষ্টরূপে জানা-চেনার আগে সেটি থেকে বেঁচে থাকা ও সেটাকে পরিহার করা সম্ভবপর নয়। এর থেকে বোঝা গেল যে, তাওহীদ শেখা জরুরী; যাতে করে এর উপর আমল করা যায় এবং এটি বাস্তবায়ন করা যায়। আবার কুফর ও শির্ক জানাও জরুরী; যাতে করে সেটা থেকে সতর্ক থাকা যায় ও সেটাকে পরিহার করা যায়।
কুফর কী?
কুফরের আভিধানিক অর্থ: কোনো কিছুকে ঢাকা ফেলা, আবৃত করা।
শরয়ি পরিভাষায় কুফর হলো: ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান না-আনা। এর সাথে অবিশ্বাস করা যুক্ত হোক বা না-হোক। কেবল সন্দেহ-সংশয়বশতঃ হোক। কিংবা হিংসা, ধৃষ্টতা বা রাসূলের অনুসরণ থেকে বিমুখকারী কিছু কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে ঈমান গ্রহণ করা থেকে বিমুখ থাকা হোক। তাই কুফর হলো প্রত্যেক এমন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তায়ালা যা কিছুর প্রতি ঈমান আনা ফরয করেছেন এর কোন কিছুর সংবাদ যে ব্যক্তির কাছে পৌঁছার পর সে এটাকে অস্বীকার করে; চাই এ অস্বীকারকরণ শুধু অন্তর দিয়ে হোক, মুখ দিয়ে নয়; কিংবা শুধু মুখ দিয়ে হোক, অন্তর দিয়ে নয়; কিংবা উভয়টা দিয়ে হোক অথবা এমন কোনো কাজ করার মাধ্যমে হোক যে কাজের ব্যাপারে দলিল উদ্ধৃত হয়েছে যে, এটি ব্যক্তিকে ঈমানের উপাধি থেকে বহিষ্কারকারী’। দেখুন: শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যার মাজমুউল ফাতাওয়া (১২/৩৩৫), ইবনে হাযমের ‘আল-ইহকাম ফী-উসূলিল আহকাম’ (১/৪৫)।
ইবনে হাযম রাহিমাহুল্লাহ তাঁর আল-ফাস্ল বইয়ে বলেন: ‘বরং সহিহ দলীল অনুসারে যে বিষয়টি বিশ্বাস করা ছাড়া ঈমান সাব্যস্ত হয় না সেটি অস্বীকার করা কুফর। যে বিষয়টি উচ্চারণ করা কুফর বলে প্রমাণিত সেটি উচ্চারণ করা কুফর। এবং যে কাজটিতে লিপ্ত হওয়া কুফর বলে প্রমাণিত সে কাজ করাও কুফর।’
ইসলাম থেকে বের করে দেয় এমন বড় কুফরের প্রকারসমূহ
আলেমরা কুফরকে কয়েক প্রকারে ভাগ করেছেন। এ প্রকারগুলোর অধীনে শির্কের অনেক রূপ ও প্রকার অধিভুক্ত। যথা:
১- অস্বীকার ও অবিশ্বাস করার কুফর। এই কুফর কখনো অন্তরে অবিশ্বাস করার মাধ্যমে ঘটে। এটি কাফেরদের মধ্যে কম পাওয়া যায়, যেমনটি ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন। আবার কখনো মৌখিকভাবে অবিশ্বাস করার মাধ্যমে ঘটে। আবার কখনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে অবিশ্বাস করার মাধ্যমে ঘটে। তা এভাবে যে, ভেতরে ভেতরে সত্যকে জানা ও চেনার পরেও সেটাকে গোপন করা এবং সেটার প্রতি নতি স্বীকার না করা; যেমন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে ইহুদিদের কুফরি। আল্লাহ তায়ালা তাদের ব্যাপারে বলেন:
فلما جاءهم ما عرفوا كفروا به
“যখন তাদের এই পূর্ব জানা বিষয় তাদের কাছে এল তখন তারা তা কুফরি (অস্বীকার) করল।”[সূরা বাকারা: ৮৯]
তিনি আরো বলেন:
وإن فريقا منهم ليكتمون الحق وهم يعلمون
“আসলে তাদের একটি দল জ্ঞাতসারেই সত্যকে গোপন করছে।”[সূরা বাকারা: ১৪৬]
কারণ অবিশ্বাস করা কেবল এমন ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঘটতে পারে যে সত্যকে জানার পর সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে। এ কারণে কাফেরগণ কর্তৃক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবিশ্বাস করাকে প্রকৃত ও ভেতরগত অবিশ্বাস হিসেবে আল্লাহ নাকচ করে দিয়েছেন। বরং সেটি ছিল কেবল মৌখিক অবিশ্বাস। তাই তো আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَإِنَّهُمْ لا يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِينَ بِآيَاتِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ
“তারা তো তোমাকে অবিশ্বাস করে না, বরং জালেমরা আল্লাহর আয়াতগুলোকে (নিদর্শনাবলিকে) অস্বীকার করে।”[সূরা আনআম: ৩৩]
وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْماً وَعُلُوّاً
“তারা অন্যায় ও অহঙ্কারবশতঃ সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অথচ তাদের অন্তর সেগুলোতে নিশ্চিত বিশ্বাসী ছিল।”[সূরা নামল: ১৪]
এ কুফরের অধিভুক্ত হবে হারাম কিছুকে হালাল গণ্য করার কুফর। যে ব্যক্তি জানে যে, শরিয়তে এটি হারাম তদুপরি সে এটাকে হালাল গণ্য করে সে তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন সেক্ষেত্রে তাকে অবিশ্বাস করল। অনুরূপভাবে শরিয়তে যা হালাল যে ব্যক্তি এটাকে হারাম গণ্য করে তার ব্যাপারটিও একই।
২- বিমুখতা ও ধৃষ্টতার কুফর। যেমন: ইবলিসের কুফর। তার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
إِلَّآ إِبۡلِيسَ أَبَىٰ وَٱسۡتَكۡبَرَ وَكَانَ مِنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ
“ইবলিস ছাড়া। সে আদেশ অমান্য করল ও ধৃষ্টতা দেখাল। এভাবে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হল।”[সূরা বাকারা: ৩৪]
অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَيَقُولُونَ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلرَّسُولِ وَأَطَعۡنَا ثُمَّ يَتَوَلَّىٰ فَرِيقٞ مِّنۡهُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَۚ وَمَآ أُوْلَٰٓئِكَ بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ
“তারা বলে: আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি এবং আনুগত্য স্বীকার করেছি। তারপর তাদের মধ্যে একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। ওরা মুমিন নয়।”[সূরা নূর: ৪৭]
এ আয়াতে যে ব্যক্তি আমল করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার ঈমানকে নাকচ করা হয়েছে, যদিও সে মৌখিকভাবে ঈমান এনেছে। সুতরাং স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, বিমুখতার কুফর হলো সত্যকে বর্জন করা, সত্যকে না শেখা এবং সে অনুযায়ী আমল না করা। চাই সে সত্য কোন কথা হোক, কোন আমল কিংবা হোক বিশ্বাস হোক। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ عَمَّآ أُنذِرُواْ مُعۡرِضُونَ
“আর যারা কুফরি করেছে তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে সে ব্যাপারে তারা বিমুখ (ভ্রুক্ষেপহীন)।”[সূরা আহকাফ: ৩]
তাই যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তা থেকে মৌখিকভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেমন বলল যে, আমি এর অনুসরণ করব না, কিংবা কাজ দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেমন তিনি যে সত্য নিয়ে এসেছেন সে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, সেটা শ্রবণ করা থেকে পলায়ন করা কিংবা কানে আঙ্গুল দিয়ে রাখা যাতে শুনতে না পায় কিংবা শুনলেও অন্তর দিয়ে ঈমান আনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিংবা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে আমল করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়; সে বিমুখতার কুফর করার মাধ্যমে কাফের হয়ে গেল।
৩- মুনাফিকীর (কপটতার) কুফর। এটি হলো অন্তরের বিশ্বাস ও অন্তরের কর্ম বাস্তবায়ন না করার মাধ্যমে যে কুফর সংঘটিত হয়ে থাকে, যদিও বাহ্যতঃ লোক-দেখানো আনুগত্য প্রকাশ করা হয়। এর উদাহরণ হচ্ছে আব্দুল্লাহ ইবনে সুলূলসহ অন্য সব মুনাফিকদের কুফর যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِينَ.يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ .. الخ الآيات
“কিছু মানুষ আছে যারা বলে: আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি। কিন্তু আসলে তারা ঈমানদার নয়। তারা আল্লাহকে ও যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ধোঁকা দেয়। আসলে তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না; কিন্তু তারা (সেটা) অনুভব করে না।” ... শেষ পর্যন্ত।[সূরা বাকারা: ৮-২০]
৪- সংশয় ও সন্দেহের কুফর। সত্যকে অনুসরণ করার ব্যাপারে অথবা সত্য সত্য হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা। কারণ বান্দার প্রতি নির্দেশ হচ্ছে: রাসূল যা নিয়ে এসেছেন সেটাকে ‘সত্য’ জেনে নিশ্চিত বিশ্বাস (ইয়াকীন) করা; যাতে কোন সন্দেহ থাকবে না। তাই যে ব্যক্তি মনে করে যে, তিনি যা নিয়ে এসেছেন সেটা সত্য নাও হতে পারে, সে কুফরী করল। তার কুফরীটা হলো সন্দেহ বা অনুমানের কুফরী। যেমনটি আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَنْ تَبِيدَ هَذِهِ أَبَداً. وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لأجِدَنَّ خَيْراً مِنْهَا مُنْقَلَباً. قَالَ لَهُ صَاحِبُهُ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَكَفَرْتَ بِالَّذِي خَلَقَكَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ سَوَّاكَ رَجُلاً. لَكِنَّا هُوَ اللَّهُ رَبِّي وَلا أُشْرِكُ بِرَبِّي أَحَداً
“সে নিজের প্রতি যুলুমকারী অবস্থায় (অর্থাৎ আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের পরিবর্তে মনে অহংকার আর অবিশ্বাস নিয়ে) তার বাগানে প্রবেশ করেছিল। সে বলেছিল: আমি মনে করি না, এই বাগান কখনো ধ্বংস হবে। আমি মনে করি না, কেয়ামত কখনো সংঘটিত হবে। আর (আসলেই) যদি আমাকে আমার প্রভুর নিকট ফিরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে (সেখানে) আমি অবশ্যই এর চেয়ে ভালো প্রত্যাবর্তনস্থল পাবো। তার সাথে আলাপকালে তার (মুমিন) সাথী বলেছিল: ‘তুমি কি তাঁকে অবিশ্বাস করো যিনি তোমাকে মাটি থেকে ও পরে বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের আকৃতি দিয়েছেন? কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, তিনিই আল্লাহ, আমার প্রভু। আর আমি আমার প্রভুর সাথে কাউকে শরীক করি না।”[সূরা কাহফ: ৩৫-৩৮]
সুতরাং উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বোঝা গেল যে, কুফর (যা ঈমানের বিপরীত) কখনও অন্তরের অবিশ্বাসের মাধ্যমে হতে পারে। তখন সেটি অন্তরের কথা তথা বিশ্বাসের বিপরীত। আবার কখনও অন্তরের কর্মের মাধ্যমে হতে পারে; যেমন আল্লাহ তায়ালা অথবা তার আয়াতসমূহ কিংবা তাঁর রাসূলকে ঘৃণা করার মাধ্যমে। তখন সেটি ঈমানী ভালোবাসার সাথে সাংঘর্ষিক, যা অন্তরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল। আবার কুফর কখনও স্পষ্ট কথা হতে পারে, যেমন: আল্লাহকে গালমন্দ করা। আবার কখনো প্রকাশ্য আমল হতে পারে, যেমন: মূর্তিকে সিজদাহ করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য যবাই করা। যেমনিভাবে ঈমান অন্তর, জিহ্বা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে সংঘটিত হয় তেমনিভাবে কুফরও অন্তর, জিহ্বা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে সংঘটিত হয়।
আমরা আল্লাহর কাছে কুফর ও এর শাখা-প্রশাখা থেকে পানাহ চাই। আমরা প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে ঈমানের সাজে সজ্জিত করে তোলেন এবং আমাদেরকে সুপথপ্রাপ্ত ও সঠিক পথের প্রদর্শক বানিয়ে দেন। আমীন।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
তথ্যসূত্র:
- হাফেয হাকামীর রচিত ‘আ’লামুস সুন্নাহ আল-মানশূরাহ’ (পৃ. ১৭৭)।
- শাইখ আব্দুল আযীয আলে-আব্দুল লত্বীফের রচিত ‘নাওয়াকেদুল ঈমান আল-কাওলিয়্যা ওয়াল-’আমালিয়্যা’ (পৃ. ৩৬-৪৬)।
- শাইখ আব্দুল্লাহ আল-ক্বারনীর ‘দ্বাওয়াবেতুত তাকফীর’ (পৃ. ১৮৩-১৯৬)।