আলহামদু লিল্লাহ।.
আহলে কিতাবরা (ইহুদী ও খ্রিস্টান) ছাড়া মুশরিক কর্তৃক যা কিছু জবাই করা হয় সেগুলো মৃতপ্রাণী হিসেবে গণ্য। এমনকি সে জবাইকৃত প্রাণী যদি গোশত খাওয়া জায়েয এমন প্রাণী হয় তবুও।
পক্ষান্তরে, মৃতপ্রাণীর হাড় ব্যবহার করা— সে প্রাণী গোশত খাওয়া জায়েয এমন প্রাণী হোক; কিংবা গোশত খাওয়া নাজায়েয এমন প্রাণী হোক— আলেমগণ এ নিয়ে মতভেদ করেছেন; সেটা কি পবিত্র; নাকি নাপাক?
জমহুর আলেম এর অভিমত হচ্ছে— এটি নাপাক। হানাফী আলেমগণ তাদের সাথে মতভেদ করেছেন। তারা এটাকে পবিত্র বলেন।
ইবনে কুদামা (রহঃ) বলেন:
“মৃতপ্রাণীর হাড় নাপাক; সেটি গোশত খাওয়া জায়েয এমন প্রাণীর হাড় হোক; কিংবা গোশত খাওয়া নাজায়েয এমন প্রাণীর হাড় হোক। এটি কোন অবস্থায় পবিত্র হবে না। এটা হচ্ছে ইমাম মালেক, শাফেয়ি ও ইসহাকের মাযহাব।
আর ইমাম ছাওরী ও আবু হানিফার মাযহাব হচ্ছে— এটি পবিত্র। কেননা হাড়ের মৃত্যু ঘটে না; তাই এটি অপবিত্র হয় না; চুলের মত।
কেননা গোশত ও চামড়া অপবিত্র হওয়ার হেতু হল এর সাথে রক্ত ও আর্দ্রতা যুক্ত থাকা। হাড়ের মধ্যে এটি পাওয়া যায় না।
আমাদের দলিল হচ্ছে আল্লাহ্ তাআলার বাণী: “সে বলে, ‘(মৃতের) ক্ষয়প্রাপ্ত হাড়গুলোকে প্রাণ দিবেন?’ বলুন, যিনি প্রথমবার সেগুলোকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই প্রাণ দিবেন। প্রতিটি সৃষ্টির ব্যাপারে তিনি সম্যক অবগত।”[সূরা ইয়াসীন, ৩৬:৭৯]
আর যেহেতু প্রাণ থাকার আলামত হচ্ছে অনুভূতি ও ব্যথা পাওয়া। হাড়ের মধ্যে গোশত ও চামড়ার চেয়ে বেশী ব্যথা পাওয়া যায়।
যে জিনিসের মধ্যে প্রাণ আছে সে জিনিসের মৃত্যুও আছে। যেহেতু মৃত্যু মানে প্রাণের বিচ্ছেদ। যে জিনিসের মৃত্যু ঘটে সেটা নাপাক হয়; যেমন গোশত।”[আল-মুগনী” (১/৫৪) থেকে সমাপ্ত]
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) এ অভিমতকে অগ্রগণ্যতা দিয়েছেন। দেখুন: “আল-শারহুল মুমতি” (১/৯৩)।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) হানাফি মাযহাবের অভিমতকে নির্বাচন করেছেন। তিনি বলেন:
“মৃতপ্রাণীর হাড়, শিং ও নখ এবং এ জাতীয় যা কিছু আছে যেমন খুর, চুল, পালক ও পশম ইত্যাদি: পবিত্র। এটি ইমাম আবু হানিফার অভিমত। মালেকি ও হাম্বলি মাযহাবেও এমন একটি কথা আছে।
এ অভিমতটি সঠিক। কেননা এ জিনিসগুলোর মূল বিধান হলো পবিত্রতা; আর এগুলো অপবিত্র হওয়ার পক্ষে কোন দলিল নেই।
তাছাড়া এ জিনিসগুলো ভাল শ্রেণীয়; মন্দ শ্রেণীয় নয় যে, হালাল বর্ণনাকারী আয়াতের অধীনে এগুলো অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ আল্লাহ্ যা কিছুকে মন্দ শ্রেণীয় হিসেবে হারাম করেছেন সেগুলোর মধ্যে এ জিনিসগুলো পড়বে না; শব্দগত দিক থেকেও নয় এবং মর্মগত দিক থেকেও নয়।
শব্দগত দিক থেকে নয়: যেমন আল্লাহ্র বাণী: حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ (তোমাদের উপর মৃতপ্রাণী হারাম করা হয়েছে) এর মধ্যে চুল ও এ জাতীয় জিনিসগুলো পড়ে না। অর্থাৎ যেহেতু মৃতের বিপরীত জীবিত। জীবন দুই প্রকার: প্রাণীর জীবন ও উদ্ভিদের জীবন। প্রাণীর জীবনের বৈশিষ্ট্য হল: অনুভূতি ও ইচ্ছাধীন নড়াচড়া। আর উদ্ভিদের জীবনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: বৃদ্ধি পাওয়া ও পুষ্টি গ্রহণ।
হারামকৃত মৃতপ্রাণী: যাতে অনুভূতি ও ইচ্ছাধীন নড়াচড়া নেই। পক্ষান্তরে, চুল বাড়ে ও পুষ্টিগ্রহণ করে এবং উদ্ভিদের মত লম্বা হয়। উদ্ভিদের কোন অনুভূতি নেই এবং উদ্ভিদ নিজ ইচ্ছায় নড়াচড়া করে না। এর মধ্যে জীবের মত প্রাণ নাই যে, সে প্রাণের বিচ্ছেদে মৃত্যুবরণ করবে। সুতরাং এমন জিনিস নাপাক হওয়ার কোন যুক্তি নেই।
যারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন তাদেরকে বলা হবে: আপনারা নিজেরাও তো আয়াতের শাব্দিক ব্যাপকতাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেন না। কেননা যে সব প্রাণীর রক্ত নাই; যেমন- (মরা) মাছি, বিচ্ছু ও পোকা; এগুলো আপনাদের নিকটেও অপবিত্র নয় এবং জমহুর আলেমের কাছেও অপবিত্র নয়। অথচ এ এগুলোর মৃত্যু জীবের মৃত্যুর মত।
ব্যাপারটি যেহেতু এ রকম এর থেকে জানা গেল যে, মৃতপ্রাণী অপবিত্র হওয়ার হেতু হল মৃতপ্রাণীর মধ্যে রক্ত জমাট হয়ে থাকা। আর যে প্রাণীর মাঝে তরল রক্ত নেই সেটা মারা গেলেও তাতে কোন রক্ত জমাট বাধে না; তাই সেটা নাপাক হয় না।
তাই এ ধরণের জীবের চেয়ে হাড় ও হাড় জাতীয় জিনিস নাাপাক না হওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত। কেননা হাড়ের ভেতরে কোন তরল রক্ত নাই এবং হাড়ের ইচ্ছাধীন নড়াচড়াও নাই; অন্যকিছুর অনুবর্তী হওয়া ছাড়া।
সুতরাং অনুভূতি শক্তির অধিকারী, স্ব-ইচ্ছায় নড়াচড়াকারী পরিপূর্ণ জীব যদি এর মধ্যে তরল রক্ত না থাকার কারণে নাপাক না হয় তাহলে হাড়ের ভেতরে তরল রক্ত না থাকার পরেও সেটা কিভাবে নাপাক হবে…?
বিষয়টি যেহেতু এমন অতএব, হাড়, নখ, শিং, খুর ইত্যাদি যাতে প্রবহমান রক্ত নাই সেগুলো নাপাক হওয়ার কোন যুক্তি নাই। এটাই অধিকাংশ সালাফের অভিমত।
যুহরী বলেন: এ উম্মতের উত্তম প্রজন্ম হাতির হাড় দিয়ে তৈরীকৃত চিরুনী দিয়ে মাথা আঁচড়াতেন।
হাতির দাঁতের ব্যাপারে একটি পরিচিত হাদিস বর্ণিত হয়েছে; কিন্তু সে হাদিসের ব্যাপারে কিছু কথাবার্তা আছে। এটি সে আলোচনা করার স্থান নয়। কারণ আমাদের সে হাদিস দিয়ে দলিল দেওয়ার প্রয়োজন নাই।
আরও বলা যায়, চামড়া তো মৃতপ্রাণীর অংশবিশেষ। চামড়ার মধ্যে রক্ত আছে; যেমনিভাবে মৃতপ্রাণীর অন্য সকল অংশে রক্ত রয়েছে। তা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চামড়া দাবাগতকরণ (প্রক্রিয়াজাত করণ)কে চামড়ার জবাই হিসেবে গণ্য করেছেন। কেননা প্রক্রিয়াজাতকরণ চামড়ার আর্দ্রতাকে শুকিয়ে ফেলে।
এটি প্রমাণ করে যে, অপবিত্রতার কারণ হল আর্দ্রতা। হাড়ের মধ্যে কোন তরল রক্ত নাই। হাড়ের ভেতরে যা কিছু থাকে সেটা শুকিয়ে যায়। হাড়কে চামড়ার চেয়ে বেশি সময় সংরক্ষণ করা যায়। সুতরাং চামড়ার চেয়ে হাড় পবিত্র হওয়া অধিক উপযুক্ত।”[আল-ফাতাওয়াল কুবরা (১/২৬৬-২৭১) সমাপ্ত]
সংক্ষিপ্তসার:
যদি এ পাত্রগুলো গোশত খাওয়া জায়েয এমন প্রাণীর হাড় দিয়ে তৈরীকৃত হয় যে প্রাণীকে কোন মুসলিম বা কোন আহলে কিতাব জবাই করেছেন তাহলে এ সব পাত্র পবিত্র এবং এগুলো ব্যবহার করা হালাল।
আর যদি এমনটি না হয়— চীন দেশের ক্ষেত্রে যেটা ঘটার সম্ভাবনাই প্রবল— তাহলে এ পাত্রগুলো মৃতপ্রাণীর হাড় থেকে তৈরী। মৃতপ্রাণীর হাড়ের ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ খুবই শক্তিশালী। তাই একজন মুসলিমের জন্য উত্তম হল এ ধরণের পাত্র ব্যবহার করা থেকে দূরে থাকা। এগুলো ছাড়াও অনেক পাত্র রয়েছে।
যদি এ পাত্রগুলো মৃতপ্রাণীর ভস্মীকৃত হাড়ের ছাই দিয়ে তৈরী করা হয় তাহলে সেটা হতে পারে। যেহেতু ছাই নাপাক নয়। যেহেতু রূপান্তরের মাধ্যমে সেটি পবিত্র হয়ে যায়।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।