আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
উপহারের মত খরচ প্রদানে সন্তানদের মধ্যে ন্যায্যতা রক্ষা করা কি আবশ্যক?
উপহার সামগ্রী দেয়া ও কোন কিছু অনুদান দেয়ার ক্ষেত্রে সন্তানদের মধ্যে ন্যায্যতা রক্ষা করা ওয়াজিব। আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “আমি নোমান বিন বাশির (রাঃ) কে মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছি তিনি বলছিলেন: আমার পিতা আমাকে একটা কিছু অনুদান দিয়েছিলেন। তখন আ’মরা বিনতে রাওয়াহা বলেছেন: আমি ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হব না যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাক্ষী করবেন। নোমান বিন বাশির রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন: আমি আমার স্ত্রী আ’মরা বিনতে রাওয়াহার ঘরের ছেলেকে একটা অনুদান দিয়েছি। তখন সে আমাকে নির্দেশ দিল আমি যেন আপনাকে সাক্ষী রাখি; হে আল্লাহ্র রাসূল! তিনি বললেন: তুমি তোমার সব ছেলেকে অনুরূপ অনুদান দিয়েছ? নোমান বললেন: না। তখন তিনি বললেন: আল্লাহ্কে ভয় কর এবং সন্তানদের মাঝে ন্যায় বাস্তবায়ন কর। বর্ণনাকারী বলেন: তখন তিনি ফিরে যান এবং তার অনুদানটি ফিরিয়ে নেন।”[সহিহ বুখারী (২৫৮৭)]
বুখারীর অপর এক রেওয়ায়েতে (২৬৫০) এসেছে: “কোন অন্যায়ের ক্ষেত্রে আমাকে সাক্ষী বানিও না”।
পক্ষান্তরে, খরচের বিষয়টি হলো: প্রত্যেক ছেলেকে তার প্রয়োজন মাফিক দেয়া হবে। বড়দের খরচ ছোটদের খরচের সমান নয়। যেই ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তার খরচ যে ছেলে প্রাইমারীতে পড়ে তার সমান নয়। যেই ছেলে বিয়ের বয়সে পৌঁছেছে এবং তার বিয়ে করা প্রয়োজন তার খরচ যেই ছেলে বালেগ হয়নি কিংবা বালেগ হলেও বিয়ের প্রয়োজন হয়নি তার খরচের সমান নয়।
কাশ্শাফুল ক্বিনা গ্রন্থে (৩/৩০৯) বলেন: “পিতামাতা এবং অন্য সব আত্মীয়ের উপর যারা আত্মীয়তারসূত্রে তাদের থেকে মিরাছ (উত্তরাধিকার সম্পত্তি) পায় তাদের মধ্যে অনুদান দেয়ার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা বিধান করা ওয়াজিব; তিনি সন্তান হন, পিতা হন, মা হন, ভাই হন, ছেলে হন, চাচা হন, চাচাতো ভাই হন। তবে তুচ্ছ জিনিসের ক্ষেত্রে ওয়াজিব নয়; যেহেতু তুচ্ছ জিনিস ক্ষমার্হ; এতে তেমন প্রভাব পড়ে না...। তবে খরচ ও পোশাকের বিষয়টি এর ব্যতিক্রম। এক্ষেত্রে প্রয়োজন মাফিক দেয়া আবশ্যক; সমতা বিধান নয়।”[সমাপ্ত]
শাইখ ইবনে উছাইমীন (রহঃ) অনুদান ও খরচের মধ্যে পার্থক্য চিহ্ণিত করতে গিয়ে বলেন:
“গ্রন্থকার ‘অনুদান’ শব্দের মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, খরচের ক্ষেত্রে তাদের মাঝে তাদের মিরাছের অধিকার অনুযায়ী ন্যায় বিধান করা ওয়াজিব নয়। বরং ন্যায় বিধান করতে হবে তাদের প্রয়োজন অনুপাতে। সন্তানদের খরচ দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজন অনুপাতে ন্যায্যতা বিধান করতে হবে। ধরে নেয়া যাক মেয়ে সন্তান গরীব এবং ছেলে সন্তান ধনী। এক্ষেত্রে মেয়েকে খরচ দেয়া হবে। এর বিপরীতে ছেলেকে কিছুই দেয়া হবে না। কেননা খরচ দেয়া হচ্ছে তার প্রয়োজন মিটানোর জন্য। তাই খরচের ক্ষেত্রে সন্তানদের মাঝে ন্যায্যতা বিধান হচ্ছে— প্রত্যেককে তার প্রয়োজন মাফিক খরচ দেয়া।
ধরে নিই: সন্তানদের একজন মাদ্রাসায় পড়ে। তার মাদ্রাসার খরচ প্রয়োজন। বই, খাতা, কলম, কালি ইত্যাদি প্রয়োজন। অন্য এক ছেলে তার চেয়ে বড়। কিন্তু সে পড়ে না বিধায় তার এগুলোর দরকার নেই। তাই প্রথমজনকে এগুলো দেয়া হলে দ্বিতীয় জনকেও কি অনুরূপ দিতে হবে? জবাব হল: না। কারণ খরচ দেয়ার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা বিধান হলো: প্রত্যেককে তার প্রয়োজন মাফিক দেয়া।
এর উদাহরণ: ছেলে সন্তানের যদি রুমাল ও টুপির প্রয়োজন হয় যেগুলোর মূল্য হচ্ছে ১০০ রিয়াল। আর মেয়ে সন্তানের কানের দুল প্রয়োজন হয়; যেগুলোর মূল্য হচ্ছে ১০০০ রিয়াল। এক্ষেত্রে ন্যায্য বিধান কি? জবাব হলো: ছেলের জন্য ১০০ রিয়াল দিয়ে রুমাল ও টুপি কেনা এবং মেয়ের জন্য ১০০০ রিয়াল দিয়ে কানের দুল কেনা; যা ছেলে সন্তানের ভাগের দশগুণ বেশি। এটাই ন্যায্য বিধান।
আরেকটি উদাহরণ: ছেলেদের একজনের বিয়ের প্রয়োজন। অন্যজনের বিয়ের প্রয়োজন নাই। এক্ষেত্রে ন্যায্যতা কি? জবাব: যার বিয়ে প্রয়োজন তাকে খরচ দেয়া; আর যার বিয়ের প্রয়োজন নাই তাকে কিছুই না দেয়া। এ কারণে কিছু কিছু মানুষ যা করে থাকেন সেটা ভুল। তিনি তার ছেলেদের মধ্যে যারা বালেগ হয়েছেন তাদেরকে বিয়ে করিয়েছেন। আর ছোট ছেলেদের ব্যাপারে ওসিয়তপত্রে লিখে যান: আমার যে ছেলেরা বিয়ে করেনি আমি আমার সম্পদের এক তৃতীয়াংশ থেকে তাদের প্রত্যেককে বিয়ে করানোর জন্য ওসিয়ত করে যাচ্ছি। এটি জায়েয নয়। কেননা বিয়ে করানো প্রয়োজন মিটানো শ্রেণীয়। এই ছেলেরা তো বিয়ের বয়সে পৌঁছেনি। তাই তাদের জন্য ওসিয়ত করা হারাম। এমন ওসিয়ত সংঘটিত হবে না। এমনকি ওয়ারিশদের জন্য এমন ওসিয়ত বাস্তবায়ন করা জায়েয নয়; তবে তাদের মধ্যে বালেগ সুবোধ কেউ যদি তার মিরাছের ভাগ থেকে অনুমতি দেয় তাহলে অসুবিধা নাই।”[আশ্-শারহুল মুমতি (৪/৫৯৯)]
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে আপনাদেরকে প্রদেয় মাসোহারা যদি খরচ হিসেবে দেয়া হয় অর্থাৎ প্রত্যেকের পোশাক, মাদ্রাসার সরঞ্জাম ইত্যাদির প্রয়োজন অনুপাতে দেয়া হয় তাহলে এতে সমতা নিরূপন করা ওয়াজিব নয়। বরং আপনাদের দুইজনের প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুপাতে দেয়া হবে।
আর যদি প্রদেয় মাসোহারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত দেয়া হয় তাহলে এটি অনুদান শ্রেণীয়; যেক্ষেত্রে সমতা বিধান করা অনিবার্য।
ধরে নিই আপনার খাওয়া, পানীয়, পোশাক, মাদ্রাসার যাতায়াত ভাড়া ইত্যাদির জন্য ১৫০ রিয়াল লাগে; আর ৫০ রিয়াল উদ্ধৃত্ত দেয়া হয়। তাহলে এই পঞ্চাশ রিয়াল উপহার। এক্ষেত্রে সমতা বিধান করা অনিবার্য। তাই আপনার ভাইকেও অনুরূপ ৫০ রিয়াল দেয়া ওয়াজিব হবে; যদি ধরে নেয়া হয় যে, তাকে দেয়া ১০০ রিয়ালের পুরাটুকু তার খরচ হয়ে যায়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাসোহারা এটি খরচ শ্রেণীয়; হেবা (উপহার) শ্রেণীয় নয়। তাই এইক্ষেত্রে এক ছেলে থেকে অপর ছেলেকে পার্থক্য করাতে কোন আপত্তি নেই।
দুই: অন্যকে কোন কিছু বেশি দেয়ার প্রতি সন্তুষ্টিসূচক অনুমতি কোনটি?
হেবা (উপহার) করার ক্ষেত্রে কাউকে বেশি দেয়া বৈধ যদি যাকে কম দেয়া হলো সে অনুমতি দেয়। তবে যে ব্যক্তি লেনদেন করার উপযুক্ত কেবল তার অনুমতি ধর্তব্য হবে। এমন ব্যক্তি হলো যে প্রাপ্তবয়স্ক, বিবেকবান ও সুবুদ্ধি সম্পন্ন। সুবুদ্ধি সম্পন্ন হচ্ছে যে ব্যক্তি সম্পদ সুষ্ঠুভাবে খরচ করতে জানে; নির্বোধের বিপরীত। অপ্রাপ্ত বয়স্ক, পাগল ও নির্বোধের অনুমতি ধর্তব্য নয়।
কাশ্শাফুল ক্বিনা গ্রন্থে (৪/৩১০) বলেন: “পিতামাতা ও অন্যান্য আত্মীয় যাদের কথা উল্লেখ করা হলো তারা তাদের ওয়ারিশযোগ্য কিছু আত্মীয়কে অন্যদের অনুমতি সাপেক্ষে বিশেষ কিছু দিতে পারেন। কেননা বিশেষ কিছু দেয়া হারাম হওয়ার কারণ হলো এটি শত্রুতা ও আত্মীয়তার সম্পর্কে ফাটল তৈরী করে। অনুমতি দেয়া হলে সেটি নাকচ হয়ে যায়। যদি অন্যদের অনুমতি ছাড়া কাউকে বিশেষ কিছু দেন কিংবা অন্যদের চেয়ে বেশি কিছু দেন তাহলে পূর্বোক্ত কারণে তিনি গুনাহগার হবেন।”[সমাপ্ত]
তিনি আরও বলেন (৪/২৯৯): “হেবা (উপহার) দেয়ার ক্ষেত্রে ধর্তব্য হলো এমন ব্যক্তির পক্ষ থেকে হওয়া যিনি লেনদেন করার উপযুক্ত। সুতরাং অপ্রাপ্ত বয়স্ক, নির্বোধ, দাস প্রমুখের হেবার লেনদেন অন্যান্য লেনদেনর মত সঠিক নয়”।[সমাপ্ত]
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে আপনার যে ভাই এখনও বালেগ হয়নি কাউকে হেবা (উপহার) হিসেবে বেশি দেয়ার ক্ষেত্রে তার সম্মতি ধর্তব্যযোগ্য নয়।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।