রবিবার 21 জুমাদাল ছানী 1446 - 22 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

জুমার দিন দোয়া কবুলের সময় নির্ধারণ

প্রশ্ন

আমি শুনেছি যে, জুমার দিন খোতবার দোয়া কবুলযোগ্য। কেননা দোয়া কবুলের নির্দিষ্ট একটি সময় আছে। হতে পারে এই দোয়াটি সে সময়ের মধ্যে পড়ে যাবে…। কিন্তু নিরব থেকে খতীবের খোতবা শুনা ও মনোযোগ দেয়াও আমাদের উপর ওয়াজিব। তাই আমরা কিভাবে এটি করতে পারি? আশা করি জবাব দিবেন। আল্লাহ্‌ আপনাদেরকে সামর্থ্য দিন।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

সহিহ সুন্নাহ প্রমাণ করছে যে, জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার একটি সময় রয়েছে। এই সময়টিতে কোন মুসলিম বান্দা যদি আল্লাহ্‌র কাছে কোন কল্যাণ চায় আল্লাহ্‌ তাকে সে কল্যাণ দিয়ে থাকেন। যেমনটি বুখারী (৫২৯৫) ও মুসলিম (৮৫২) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, আবুল কাসেম (কাসেমের পিতা) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, জুমার দিন এমন একটি সময় রয়েছে কোন মুসলিম বান্দা যদি নামাযে (অর্থাৎ নামাযের অপেক্ষায়) থাকে এবং আল্লাহ্‌র কাছে কোন কল্যাণ চায় তাহলে আল্লাহ্‌ তাকে তা দিয়ে থাকেন।

এই সময়টি কখন তা নির্ধারণ করা নিয়ে বহু অভিমত রয়েছে। সর্বাধিক সঠিক অভিমত হচ্ছে দুটি। ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন: এ অভিমতগুলোর মধ্যে সর্বাধিক অগ্রগণ্য অভিমত দুটি; সাব্যস্ত হাদিসগুলোতে যে অভিমতদ্বয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ দুটো অভিমতের মধ্যে একটি অপরটির চেয়ে অগ্রগণ্য:

১। এ সময়টি হচ্ছে ইমাম মিম্বরে বসা থেকে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত। এ অভিমতের দলিল হল যা ইমাম মুসলিম (রহঃ) তার সহিহ গ্রন্থে (৮৫৩) আবু বুরদা বিন আবু মুসা আল-আশআরি (রাঃ) থেকে সংকলন করেছেন যে, তিনি বলেন: আমাকে আব্দুল্লাহ্‌ বিন উমর (রাঃ) বললেন: আপনি কি আপনার পিতাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে জুমার দিনের সময়টির ব্যাপারে হাদিস বর্ণনা করতে শুনেছেন? তিনি বলেন: হ্যাঁ। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন: এ সময়টি ইমাম (মিম্বরে) বসা থেকে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত

ইমাম তিরমিযি (৪৯০) ও ইমাম ইবনে মাজাহ (১১৩৮) তাঁদের গ্রন্থে কাছির বিন আব্দুল্লাহ্‌ বিন আমর বিন আওফ আল-মুযানির হাদিস সংকলন করেছেন; তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি তাঁর দাদা থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন: নিশ্চয় জুমার দিন এমন একটি সময় আছে যে সময়টিতে কোন বান্দা আল্লাহ্‌র কাছে কোন কিছু চাইলে আল্লাহ্‌ তাকে সেটি দান করেন। তারা (সাহাবীরা) বলল: ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌! সেটি কোন সময়? তিনি বললেন: নামায দাঁড়ানো থেকে শুরু করে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত[শাইখ আলবানী বলেছেন: হাদিসটি ‘যায়ীফ জিদ্দান’ তথা খুবই দুর্বল]

২। এ সময়টি আসরের পর। উভয় অভিমতের মধ্যে এটি সর্বাধিক প্রাধান্যযোগ্য। এটি আব্দুল্লাহ্‌ বিন সালাম (রাঃ) ও আবু হুরায়রা (রাঃ) এর উক্তি এবং ইমাম আহমাদসহ অনেকের অভিমত।

এ অভিমতের দলিল হল যে হাদিস ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে (৭৬৩১) আবু সাঈদ আল-খুদরি (রাঃ) ও আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: নিশ্চয় জুমার দিন এমন একটি সময় আছে যে সময়টিতে কোন মুসলিম বান্দা আল্লাহ্‌র কাছে কোন কল্যাণ প্রার্থনা করলে আল্লাহ্‌ তাকে সেটি দান করেন। সে সময়টি হল আসরের পর[মুসনাদ গ্রন্থের তাহকীকে বলা হয়েছে: অন্যান্য সমার্থক হাদিসগুলোর ভিত্তিতে এটি সহিহ হাদিস; তবে এ সনদটি দুর্বল]

এবং ইমাম আবু দাউদ (১০৪৮) ও ইমাম নাসাঈ (১৩৮৯) তাঁদের গ্রন্থে জাবের বিন আব্দুল্লাহ্‌ (রাঃ) কর্তৃক রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদিস সংকলন করেছেন যে, তিনি বলেন: জুমার দিনে ১২টি ঘন্টা রয়েছে। (এর মধ্যে এমন একটি ঘন্টা রয়েছে) যে সময় কোন মুসলিম বান্দা আল্লাহ্‌র কাছে কোন কিছু চাইলে আল্লাহ্‌ তাকে সেটি দান করেই থাকেন। অতএব, তোমরা আসরের (নামাযের) পর শেষ সময়ে সেটির সন্ধান কর[আলবানী হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

সাঈদ বিন মানসুর তাঁর সুনান গ্রন্থে আবু সালামা বিন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে কিছু লোক সমবেত হয়ে তারা জুমার দিনের সময়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময়টা যে, জুমার দিনের শেষ সময় এ ব্যাপারে তাদের কোন মতভেদ নেই এই মর্মে তারা সমাবেশ শেষ করেন।[হাফেয ইবনে হাজার ফাতহুল বারী গ্রন্থে (২/৪৮৯) বর্ণনাটির সনদকে ‘সহিহ’ বলেছেন]

সুনানে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে (১১৩৯) আব্দুল্লাহ্‌ বিন সালাম (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপবিষ্ট ছিলেন আর তখন আমি বললাম: আমরা আল্লাহ্‌র কিতাবে (তাওরাতে) পাই যে, জুমার দিনে এমন একটি ঘন্টা রয়েছে যে সময়টিতে কোন মুমিন বান্দা নামাযরত অবস্থায় আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করলে আল্লাহ্‌ তার দোয়া কবুল করেন। আব্দুল্লাহ্‌ (বিন সালাম) বলেন: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার দিকে ইশারা করলেন যে, ‘কিংবা এক ঘন্টার কিছু অংশ রয়েছে’। আমি বললাম: আপনি সত্য বলেছেন, ‘কিংবা এক ঘন্টার কিছু অংশ রয়েছে’। আমি বললাম: সে সময়টি কোনটি? তিনি বললেন: সেটি দিবসের শেষ সময়। আমি বললাম: এটা কি নামাযের সময় নয়?! তিনি বললেন: অবশ্যই। নিশ্চয় কোন মুমিন বান্দা যদি নামায পড়ে বসে থাকে; নামায ছাড়া অন্য কিছু যদি তাকে বসিয়ে না রাখে তাহলে সে তো নামাযেই রয়েছে।”[আলবানী হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

সুনানে আবু দাউদ (১০৪৬), সুনানে তিরমিযি (৪৯১) ও সুনানে নাসাঈ (১৪৩০)-তে আবু সালামা বিন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত; তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “সবচেয়ে উত্তম যে দিনে সূর্যোদয় হয়েছে সেটি হচ্ছে— জুমার দিন। এই দিনে আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনে তাকে দুনিয়াতে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এই দিনে তার তওবা কবুল করা হয়েছে। এই দিনে তিনি মারা গেছেন। এই দিনে কিয়ামত সংঘটিত হবে। জুমার দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জ্বিন ও ইনসান ব্যতীত প্রত্যেক প্রাণী কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ভয়ে কান খাড়া করে রাখে। এই দিনে এমন একটি সময় রয়েছে যে সময়টিতে কোন মুসলিম বান্দা নামাযরত অবস্থায় আল্লাহ্‌র কাছে কোন প্রয়োজন পূরণের প্রার্থনা করলে আল্লাহ্‌ তাকে সেটা প্রদান করেন। কাব বললেন: এটি প্রত্যেক বছরে একদিন। আমি বললাম: বরং প্রতি জুমার দিন। তিনি বলেন, তখন কাব তাওরাত পড়ে বলল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য বলেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন: এরপর আমি আব্দুল্লাহ্‌ বিন সালামের সাথে দেখা করলাম এবং কাবের সাথে আমার বৈঠকের বিষয়টি তাকে জানালাম। তখন আব্দুল্লাহ্‌ বিন সালাম (রাঃ) বললেন: সে সময়টি কোনটি আমি তা জানতে পেরেছি। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন: আমি তাকে বললাম, আমাকে সেটা জানান। তখন আব্দুল্লাহ্‌ বিন সালাম (রাঃ) বললেন: সেটি জুমার দিনের শেষ সময়। আমি বললাম: এটি জুমার দিনের শেষ সময় কিভাবে হয়; অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, সে সময়টিতে কোন মুসলিম বান্দা নামাযরত অবস্থায় থাকে; কিন্তু ঐ সময় তো কোন নামায পড়া যায় না। তখন আব্দুল্লাহ্‌ বিন সালাম (রাঃ) বললেন: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেননি যে, যে ব্যক্তি নামাযের অপেক্ষায় বসে আছে সে নামাযেই আছে; যতক্ষণ না নামায আদায় সমাপ্ত করে। তিনি বলেন, আমি বললাম: অবশ্যই। তখন তিনি বললেন: এখানে সেটাই উদ্দেশ্য।”[তিরমিযি বলেন: এটি হাসান-সহিহ হাদিস। সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম হাদিসটির অংশ বিশেষ রয়েছে। আলবানী হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন][যাদুল মাআদ গ্রন্থ (১/৩৭৬) থেকে সমাপ্ত]

দুই:

ইমাম মিম্বরে বসা থেকে নামায সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত এ সময়টি হওয়ার যে অভিমত রয়েছে সেটার ভিত্তিতেও এর অর্থ এ নয় যে, মুসল্লি খোতবা শুনা বাদ দিয়ে দোয়া করায় মশগুল হবেন। বরং তিনি খোতবা শুনবেন এবং ইমাম দোয়া করাকালে আমীন বললেন এবং নামাযের মধ্যে, নামাযের সেজাদাতে ও সালাম ফিরানোর আগে দোয়া করবেন।

এর মাধ্যমে তিনি এ মহান সময়টিতে দোয়ার আমল করতে পারলেন। আর এর সাথে যদি আসরের পর দিনের শেষ সময়েও দোয়া করেন তাহলে সেটাই উত্তম ও ভাল।

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব