শনিবার 27 শাওয়াল 1446 - 26 এপ্রিল 2025
বাংলা

জুমার দিনের ফযীলতসমূহ

প্রশ্ন

সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় জুমার দিনের বিশেষত্ব কোন দিক থেকে? আর সেটা কেন?

উত্তরের সংক্ষিপ্তসার

জুমার দিনের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ও ফযীলত রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ এই দিনটিকে অন্য সকল দিনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন। এই দিনের বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো: এ দিনে রয়েছে জুমার নামায, যা সর্বোত্তম নামায। জুমার দিন জামাতের সাথে ফজরের নামায আদায় একজন মুসলিমের জন্য গোটা সপ্তাহে পড়া শ্রেষ্ঠ নামায। যে ব্যক্তি জুমার দিন অথবা রাতে মারা যায় আল্লাহ তাকে কবরের ফিতনা থেকে রক্ষা করেন।

আলহামদু লিল্লাহ।.

জুমার দিনের ফযীলত সম্পর্কে কিছু হাদীস

জুমার দিনের বেশ কিছু ফযীলত রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ এই দিনটিকে অন্য দিনগুলোর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।

আবু হুরায়রা ও হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: আল্লাহ তাআলা জুমার দিন সম্পর্কে আমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ভ্রষ্টতায় রেখেছিলেন। তথা তা ইহুদীদের জন্য ছিল শনিবার এবং খ্রিস্টানদের জন্য ছিল রবিবার। এরপর আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সৃষ্টি করলেন এবং আমাদেরকে জুমার দিনের দিশা দিলেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য জুমুআর দিন শুক্রবার, ইহুদীদের জন্য শনিবার এবং নাসারাদের জন্য রবিবার নির্ধারণ করেছেন। অনুরূপভাবে তারা কিয়ামতের দিনেও আমাদের অনুগামী হবে। আমরা দুনিয়ার সর্বশেষ অধিবাসী, কিন্তু কিয়ামতের দিন আমরাই সর্বপ্রথম, অন্য সৃষ্টিদের আগে যাদের বিচার ফয়সালা হবে।[হাদীসটি মুসলিম (৮৫৬) বর্ণনা করেন]

ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন:

“কাযী বলেন: ‘অগ্রগণ্য হলো: তাদের জন্য জুমার দিনকে সম্মান করা ফরয করা হয়েছিল। তবে জুমার দিন সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি, তাদের ইজতিহাদের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল; যাতে করে সেই দিনে তারা তাদের ধর্মীয় অনুশাসনগুলো পালন করতে পারে। কিন্তু, দিনটি নির্ধারণে তাদের ইজতিহাদ এক হয়নি এবং আল্লাহ তাদেরকে এর সন্ধানও প্রদান দেননি। পক্ষান্তরে এই উম্মাতের জন্য আল্লাহ ফরয করার পাশাপাশি দিনটিকে চিহ্ণিত করে দেন। তিনি এই উম্মতের ইজতিহাদের উপর বিষয়টি ছেড়ে দেননি। ফলে তারা তাঁর দেওয়া ফযীলত অর্জন করতে পেরেছে।

কাযী আরো বলেন: বর্ণিত আছে যে মুসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে জুমার দিনে (ইবাদত করার) নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাদেরকে এই দিনের ফযীলত জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তার সাথে তর্ক করে দাবি করে যে, শনিবার সর্বোত্তম। তখন তাঁকে বলা হয়: আপনি তাদেরকে ছেড়ে দিন।

কাযী বলেন: যদি এ ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য থাকত তাহলে তাদের মতভেদ করা সঠিক হত না। বরং বলা হত: তারা এর লঙ্ঘন করেছে। আমি বলব: এমন হতে পারে যে, তাদেরকে স্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল এবং দিনও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা মতভেদ করেছিল যে এই নির্দিষ্ট দিনই কি অনিবার্য; নাকি এর বদলে অন্য দিনে করার অধিকার তাদের আছে? তারা বদল করেছিল এবং এ বদল করার মাধ্যমে ভুল করেছিল।’[সমাপ্ত]

তাদের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে জুমার দিন উল্লেখ করার পরও তারা এর বিরুদ্ধাচারণ করার মধ্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

হাফেয ইবনে হাজার বলেন: এমনটি কেন হবে না অথচ তারাই বলেছিল: “আমরা শুনলাম এবং অবাধ্য হলাম!!”[সমাপ্ত]

আউস ইবনে আউস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে,: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের দিনসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হল জুমার দিন। এই দিন আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো, এ দিনেই তাঁর রূহ কবজ করা হয়েছিলো। এ দিনে শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে, এ দিনেই বিকট শব্দ করা হবে। কাজেই এই দিনটিতে তোমরা আমার উপর বেশি বেশি দুরূদ পাঠ করো। কারণ তোমাদের দুরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়।” সাহাবীরা বলল: ‘হে আল্লাহর রসূল! আমাদের দুরূদ আপনার কাছে কিভাবে পেশ করা হবে? অথচ আপনি পঁচে গলে গেছেন?’ তিনি বললেন: “মহান আল্লাহ মাটির উপর নবীদের দেহ গ্রাস করাকে হারাম করে দিয়েছেন।”[হাদীসটি আবু দাউদ (১০৪৭) বর্ণনা করেছেন। আবু দাউদের ব্যাখ্যায় (৪/২৭৩) ইবনুল কাইয়্যিম এটিকে সহীহ বলেছেন। শাইখ আলবানী সহীহ আবু দাউদে (৯২৫) এটিকে সহীহ বলেছেন]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “সর্বোত্তম যে দিনের উপর সূর্যোদয় হয়েছে সেটি হলো জুমার দিন। এ দিনে আদম (আলাইহিস সালাম)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ দিনে তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এ দিনে তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।”[হাদীসটি মুসলিম (১৪১০) বর্ণনা করেন]

জুমার দিনকে মর্যাদা দেয়ার কিছু কারণ এ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে।

নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন:

‘কাযী ইয়ায বলেছেন: অগ্রগণ্য অভিমত হলো উল্লিখিত এই ফযীলতসমূহ জুমার দিনের ফযীলত উল্লেখ করার জন্য নয়। কারণ আদমকে জান্নাত থেকে বের করে দেয়া, কিয়ামত সংঘটিত হওয়া কোনো ফযীলত নয়। বরং এই দিনে যে সমস্ত বড় বড় ঘটনা ঘটেছে এবং ভবিষতে ঘটবে সেগুলোর বিবরণ দেয়া; যাতে করে বান্দা এই দিনে নেক আমলের দ্বারা আল্লাহর রহমত অর্জন এবং ক্রোধ থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কাযী এমনটাই বলেছেন। আবু বকর ইবনুল আরাবী তার ‘আল-আহওয়াযী ফি শারহিত তিরমিযী’ বইয়ে বলেন: এগুলো সবই জুমার দিনের ফযীলতের অন্তর্ভুক্ত। আদম আলাইহিস সালামের জান্নাত থেকে বের হওয়াই তার বিশাল বংশধর, নবী-রাসূল, নেককার এবং ওলীদের অস্তিত্বের কারণ। তাকে জান্নাত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। বরং দুনিয়াতে কিছু প্রয়োজন পূরণের জন্য পাঠানো হয়েছে, তারপর তিনি আবার সেখানে ফিরে যাবেন। আর এই দিনে কিয়ামতের সংঘটিত হওয়া নবী-রাসূল, সিদ্দীকীন, আউলিয়া ও অন্যান্যদের প্রতিদান দ্রুত প্রদান করা এবং তাদের মর্যাদা ও সম্মান প্রকাশ করার কারণ। এই হাদীসে অন্যান্য দিনের উপর জুমার দিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে।’[সমাপ্ত]

আবু লুবাবা ইবনে আব্দুল মুনযির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “জুমার দিন হলো সপ্তাহের দিনসমূহের নেতা এবং আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত। এ দিনটি আল্লাহর নিকট কুরবানীর দিন ও ঈদুল ফিতরের দিনের চেয়ে অধিক সম্মানিত। এ দিনের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে: এ দিন আল্লাহ আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন, এ দিনই আল্লাহ তাঁকে পৃথিবীতে পাঠান এবং এ দিনই আল্লাহ তাঁর মৃত্যু দান করেন। এ দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, কোন বান্দা তখন আল্লাহর কাছে যা প্রার্থনা করেন তিনি তাকে সেটি করেন। যদি না সে হারাম জিনিসের প্রার্থনা করে। আর এ দিনই কিয়ামত সংঘটিত হবে। নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ, আসমান-যমীন, বায়ু, পাহাড়-পর্বত ও সমুদ্র সবই জুমার দিন শঙ্কিত হয়।”[হাদীসটি ইবনে মাজাহ (১০৮৪) বর্ণনা করেন। শাইখ আলবানী সহীহুল জামে গ্রন্থে (হাদীস নং: ২২৭৯) এটিকে হাসান বলেছেন]

সিন্দী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “তারা ‘জুমার দিনে শঙ্কিত হয়’ কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ভয়ে। এ হাদিসে এ দলিল রয়েছে যে, সৃষ্টিকুল দিনগুলো নির্দিষ্ট করে জানে এবং তারা জানে যে কিয়ামত জুমার দিনে হবে।”

 জুমার দিনের কিছু ফযীলত

জুমার দিনের কিছু ফযীলত নিম্নরূপ:

১. এ দিনে রয়েছে জুমার নামায, যা সর্বোত্তম নামায।

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِي لِلصَّلاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنتُمْ تَعْلَمُونَ

“হে ঈমানদারগণ! যখন শুক্রবার নামাযের জন্য ডাক (আযান) দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণপানে ছুটে আসবে এবং কেনাবেচা বন্ধ করে দিবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জানতে।”[সূরা জুমআ: ৯]

ইমাম মুসলিম (২৩৩) সংকলন করেছেন যে, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমা থেকে অন্য জুমা এগুলোর মধ্যকার (ছোট) গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেয় যদি না ব্যক্তি বড় গুনাহতে লিপ্ত হয়।”

২. জুমার দিন ফজরের নামায জামাতের সাথে আদায় একজন ব্যক্তির সপ্তাহের সর্বশ্রেষ্ঠ নামায।

ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম নামায হলো জামাতের সাথে জুমার দিনের ফজরের নামায।”[হাদীসটি বাইহাকী শুয়াবুল ঈমান গ্রন্থে বর্ণনা করেন। শাইখ আলবানী সহীহুল জামে গ্রন্থে (১১১৯) এটিকে সহীহ বলে গণ্য করেন]

জুমার দিন ফজর নামাযের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এই নামাযে মুসল্লীর জন্য প্রথম রাকাতে সূরা সাজদাহ এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইনসান পড়া সুন্নাহ। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার দিন ফজরের প্রথম রাকাতে সূরা ‘আলিফ লাম মীম’ (সাজদাহ) পড়তেন আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ‘হাল আতা’ (ইনসান) পড়তেন।[হাদীসটি বুখারী (৮৫১) ও মুসলিম (৮৮০)]

হাফেয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘বলা হয়: এই দুই সূরা পাঠের মাঝে নিহিত প্রজ্ঞা হলো: এই দুই সূরায় আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টি এবং কিয়ামতের দিনের যে ঘটনাবলির দিকে ইঙ্গিত করা। কেননা আদমের সৃষ্টি এ দিনেই হয়েছে ও কিয়ামতের ঘটনাবলি এই দিনেই ঘটবে।’[সমাপ্ত]

৩. যে ব্যক্তি জুমার দিনে অথবা রাতে মারা যাবে, আল্লাহ তাকে কবরের ফিতনা থেকে রক্ষা করবেন

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “জুমার দিনে অথবা জুমার রাতে কোন মুসলমান ব্যক্তি যদি মারা যায় তাহলে আল্লাহ তাকে কবরের শাস্তি থেকে রক্ষা করেন।”[হাদীসটি তিরমিযী (১০৭৪) বর্ণনা করেন, শাইখ আলবানী ‘আহকামুল জানাইয’ বইয়ে (পৃ. ৪৯, ৫০) হাদীসটি সহীহ বলেছেন]

এগুলো জুমার দিনের কিছু ফযীলত। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে তার সন্তুষ্টি অর্জনের তৌফিক দান করেন।

জুমার দিনের সাথে সংশ্লিষ্ট আরো কিছু বিধান জানতে এই উত্তরগুলো দেখা যেতে পারে: (13815), (346334), (7699) ও (13692)।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব