আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
প্রশ্নকারী ভাই যে হাদিসগুলোর সঠিকতার ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন আমরা সে হাদিসগুলো পাইনি। যেহেতু আমরা হাদিসগুলো জানতে পারিনি। কারণ তিনি উল্লেখ করেছেন যে, মুয়াত্তার ৫০ তম খণ্ডে! কিন্তু মুয়াত্তা এক খণ্ডের কিতাব।
তবে আমরা এ বিষয়ে যে হাদিসগুলো রয়েছে সাধ্যানুযায়ী সে হাদিসগুলো উল্লেখ করব এবং এ হাদিসগুলোর উপর আলেমদের আরোপকৃত হুকুম উল্লেখ করব। হতে পারে এগুলোর মধ্যে প্রশ্নকারী ভাইয়ের উদ্দিষ্ট হাদিসগুলো থাকতে পারে।
১। আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশটি স্বভাবকে অপছন্দ করতেন; তবে হারাম হিসেবে নয়: খালুক (হলুদ রঙের বিশেষ সুগন্ধি), শুভ্র কেশের পরিবর্তন, লুঙ্গি ঝুলিয়ে পরা, স্বর্ণের আংটি পরা, পাশা খেলা, অনুপযুক্ত স্থানে সৌন্দর্য্যের প্রদর্শন, মুআওয়িযাত (সূরা নাস, সূরা ফালাক...) ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ঝাড়ফুঁক করা, তাবিয লটকানো, নির্দিষ্ট স্থানের পরিবর্তে অন্যত্র বীর্যপাত করা এবং বাচ্চা নষ্ট করা।”[সুনানে নাসাঈ (৫০৮৮০) ও সুনানে আবু দাউদ (৪২২২)]
“খালুক”: এক প্রকার হলুদ রঙের সুগন্ধি।
“নির্দিষ্ট স্থানের পরিবর্তে অন্যত্র বীর্যপাত করা”: অর্থাৎ বীর্য স্ত্রীর যৌনাঙ্গে না ফেলে অন্যত্র ফেলা।
“বাচ্চা নষ্ট করা”: অর্থাৎ দুগ্ধদাত্রী স্ত্রীর সাথে সহবাস করা। কারণ স্ত্রী গর্ভবতী হয়ে গেলে তার দুধ থাকবে না। অর্থাৎ তিনি দুগ্ধদাত্রী স্ত্রীর সাথে সহবাস করাকে অপছন্দ করেছেন; হারাম করেননি।
শাইখ আলবানী ‘যায়িফুন নাসাঈ’ গ্রন্থে (৩০৭৫) হাদিসটিকে যয়ীফ (দুর্বল) বলেছেন।
২। আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদের স্ত্রী যয়নব (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে তিনি ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন: নিশ্চয় ঝাড়ফুঁক, তাবিয ও কবচ শির্ক। ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর স্ত্রী বললেন: আপনি কেন এ কথা বলছেন? আল্লাহ্র শপথ! আমার চোখ থেকে কেতর ও পানি বের হত। তখন আমি অমুক ইহুদীর কাছে যেতাম। সে আমাকে ঝাড়ফুঁক করলে আমার চোখ শান্ত হয়ে যেত। তখন ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেন: সেটা ছিল শয়তানের কাজ। শয়তান তার হাত দিয়ে চোখে খোঁচা দিত। যখন ঝাড়ফুঁক করা হত তখন শয়তান চোখ থেকে সরে যেত। বরং তোমার এইটুকু বলাই যথেষ্ট যেভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন:أَذْهِبْ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ اشْفِ أَنْتَ الشَّافِي لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا (ওহে মানুষের প্রভু! আপনি রোগ দূর করে দিন। আরোগ্য করুন। আপনিই তো আরোগ্যকারী। আপনার আরোগ্য ছাড়া কোন আরোগ্য নেই। এমন আরোগ্য দিন যাতে করে কোন রোগই না থাকে।)[সুনানে আবু দাউদ (৩৮৮৩), সুনানে ইবনে মাজাহ (৩৫৩০)] শাইখ আলবানী এ হাদিসটিকে ‘আস-সিলসিলাতুস সহিহা’ গ্রন্থে (৩৩১) ও (২৯৭২) সহিহ বলেছেন।
৩। উকবা বিন আমের আল-জুহানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি: “যে ব্যক্তি কবচ ঝুলাবে আল্লাহ্ যেন তার উদ্দেশ্য পূর্ণ না করেন এবং যে ব্যক্তি ودعة (পাথর) লটকাবে আল্লাহ্ যেন তাকে স্বস্তিতে না রাখেন।”[মুসনাদে আহমাদ (১৬৯৫১)] আলবানী ‘যয়ীফুল জামে’ গ্রন্থে (৫৭০৩) এ হাদিসটিকে দুর্বল।
৪। উকবা বিন আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, “একবার রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একদল লোক উপস্থিত হল। তিনি দলটির নয়জনকে বাইআত করালেন। একজনকে বাইআত করাননি। তারা (সাহাবীরা) বলল: ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আপনি নয়জনকে বাইআত করিয়েছেন; একে করাননি কেন? তিনি বললেন: তার সাথে কবচ রয়েছে। তখন লোকটি হাত ঢুকিয়ে কবচটি ছিঁড়ে ফেলল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বাইআত করালেন। আর বললেন: যে ব্যক্তি কবচ লটকালো সে শির্ক করল।”[মুসনাদে আহমাদ (১৬৯৬৯)] আলবানী ‘আস-সিলসিলাতুস সাহিহা’ গ্রন্থে (৪৯২) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।
দুই:
আরবী التمائم শব্দটি تَمِيْمَة শব্দের বহুবচন। تَمِيْمَة (তাবিয-কবচ) হল: অনিষ্ট দূর করা (বিশেষতঃ বদনজর) কিংবা কল্যাণ আনয়ন করার উদ্দেশ্যে পুতি, হাড্ডি ইত্যাদি যা কিছু বাচ্চাদের গলায় কিংবা বড় মানুষের গলায় ঝুলানো হয় কিংবা বাসার উপরে বা গাড়ীতে রাখা হয়।
তাবিয-কবচের প্রকারভেদ ও প্রত্যেক প্রকারের হুকুম সম্পর্কে আলেমদের বক্তব্য নিম্নরূপ এবং এর মধ্যে কিছু দৃষ্টি আকর্ষণী ও কিছু পারিপার্শ্বিক তথ্যও রয়েছে:
১। শাইখ সুলাইমান বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহঃ) বলেছেন: জেনে রাখুন, আলেম সাহাবীগণ, আলেম তাবেয়ীনগণ ও তাঁদের পরবর্তী আলেমগণ কুরআন, আল্লাহ্র নাম ও সিফাতসমূহের তাবিয লটকানো জায়েয হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। একদল বলেছেন: তা জায়েয। এটি আব্দুল্লাহ্ বিন আমর ইবনুল আস (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবীর অভিমত এবং আয়েশা (রাঃ) থেকে যা বর্ণিত হয়েছে সেটার প্রত্যক্ষ ভাব। আবু জাফর আল-বাকেরও এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং ইমাম আহমাদ থেকেও এ ধরণের একটি অভিমত বর্ণিত আছে। তাঁরা সকলে উল্লেখিত হাদিসকে শির্কী তাবিয-কবচ অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। আর যে সব তাবিয-কবচে কুরআন, আল্লাহ্র নাম ও গুণাবলী রয়েছে সে সবের বিধান এগুলো দিয়ে রুকিয়া করার মত। আমি বলব: এটি ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) এর মনোনীত অভিমতের প্রত্যক্ষ ভাব।
অপর একদল আলেম বলেন: তা জায়েয নয়। এটি ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর উক্তি এবং হুযাইফা (রাঃ), উকবা বিন আমের (রাঃ) ও ইবনে আকিম (রাঃ) এর উক্তির প্রত্যক্ষ ভাব। একদল তাবেয়ীও এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর ছাত্রগণ। এটি ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণিত অন্য একটি অভিমত। ইমাম আহমাদের অনেক ছাত্র এ অভিমতটি গ্রহণ করেছেন এবং তার মাযহাবের উত্তরসূরী আলেমগণ এ অভিমতের পক্ষে দৃঢ়তা জ্ঞাপন করেছেন। তাঁরা এ হাদিস দিয়ে এবং এ অর্থবোধক অন্যান্য হাদিস দিয়ে প্রমাণ পেশ করেছেন। কেননা এ হাদিসের বাহ্যিক মর্ম সামগ্রিক; এতে কুরআন দিয়ে প্রদেয় তাবিয-কবচ ও অন্য কিছু দিয়ে প্রদেয় তাবিয-কবচের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি; ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে যেভাবে পার্থক্য করা হয়েছে। এ অভিমতের পক্ষে এভাবেও সমর্থন মিলে যে, যে সকল সাহাবায়ে কেরাম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তারা সকলে এ হাদিস থেকে সামগ্রিকতা বুঝেছেন; যেমনটি ইতিপূর্বে ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর অভিমত আলোচিত হয়েছে।
আবু দাউদ (রহঃ) ঈসা বিন হামযা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: একবার আমি আব্দুল্লাহ্ বিন আকিম (রাঃ) এর নিকট প্রবেশ করলাম। তখন তিনি হুমরা (রোগে) আক্রান্ত ছিলেন। আমি বললাম: আপনি কি তাবিয লটকাবেন না? তিনি বললেন: আমি এর থেকে আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি কোন কিছু লটকালো তাকে সে জিনিসের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হয়....”
এই হচ্ছে কুরআন ও আল্লাহ্র নাম-সিফাত দিয়ে তাবিয লটকানোর ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ। সুতরাং তাঁদের পরবর্তীতে শয়তানদের নাম দিয়ে ঝাড়ফুঁক করা ও শয়তানের নামগুলো গলায় লটকানোর যে বিদাত চালু হয়েছে; বরং শয়তানদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া, তাদের কাছে আশ্রয় চাওয়া, তাদের জন্য জবাই করা এবং অনিষ্ট দূর করা ও কল্যাণ আনয়নের জন্য তাদের কাছে প্রার্থনা করা ইত্যাদি যা কিছু নিরেট শির্ক এবং আল্লাহ্ যাদেরকে রক্ষা করেছেন তারা ছাড়া অসংখ্য মানুষের উপর এগুলোই প্রবল সে সবের ব্যাপারে আপনার কী ধারণা হতে পারে? সুতরাং আপনি একটু গভীর চিন্তাভাবনা করে দেখুন এ বিষয়ে ও এ কিতাবের অন্যান্য বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ কিসের উপরে ছিলেন, তাদের পরবর্তীতে আলেমগণ কী বলেছেন; এরপর আপনি পরবর্তী যামানার লোকেরা যা কিছু ঘটিয়েছে সেগুলোর দিকে একটু নজর দিন তাহলে আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বর্তমানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনিত ধর্ম প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসারীহীন। আল্লাহুল মুস্তাআন (আল্লাহ্ই সহায়)।[তাইসিরুল আযিযিল হামিদ (১৩৬-১৩৮)]
২। শাইখ হাফেয হাকামী বলেন: “যদি এটি (তাবিয-কবচ) কুরআনের আয়াত দিয়ে হয়, অনুরূপভাবে সহিহ সুন্নাহ দিয়ে হয় তাহলে এটি জায়েয হওয়ার ব্যাপারে পূর্বসুরি সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাদের পরবর্তী আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সালাফদের কেউ কেউ এটাকে জায়েয বলেছেন। এ ধরণের অভিমত আয়েশা (রাঃ), আবু জাফর মুহাম্মদ বিন আলী ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত আছে। আর তাঁদের কেউ কেউ এগুলো থেকে নিষেধ করেছেন, অপছন্দ করেছেন এবং এটাকে জায়েয মনে করেননি। তাদের মধ্যে রয়েছেন আব্দুল্লাহ্ বিন আকীম (রাঃ), আব্দুল্লাহ্ বিন আমর (রাঃ), উকবা বিন আমের (রাঃ), আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রাঃ) এবং তাঁর ছাত্রবর্গ যেমন আসওয়াদ, আলকামা এবং তাদের পরবর্তী ইব্রাহিম নাখায়ী ও অন্যান্য আলেমগণ।
নিঃসন্দেহে তাবিয থেকে বারণ করা গর্হিত আকিদার পথ রূদ্ধ করার ক্ষেত্রে অধিক উপযুক্ত; বিশেষতঃ আমাদের এ যামানায়। কারণ অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ীগণ তাঁদের সে পবিত্র যামানাতেই এটাকে অপছন্দ করেছেন; অথচ তাদের অন্তরে ঈমান ছিল পাহাড়ের মত মজবুত। সুতরাং আমাদের এ ফিতনার যামানায় এটাকে অপছন্দ করা অধিক উপযুক্ত ও অধিক যুক্তিযুক্ত। কিভাবে নয়; এ যামানার লোকেরা এ রুখসতকে ব্যবহার করে নিরেট হারাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এবং ঐ হারামে পৌঁছার জন্য এটাকে তারা একটি মাধ্যমে হিসেবে গ্রহণ করেছে! যেমন তারা তাবিজের মধ্যে একটি আয়াত, একটি সূরা, বিসমিল্লাহ্ বা এ জাতীয় কিছু একটা লিখে এরপর এর নীচে শয়তানী নকশাগুলো আঁকে; যারা তাদের বইগুলো পড়েছে তারা ছাড়া অন্যেরা এসব বুঝতে পারে না। যেমন তারা এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অন্তরকে আল্লাহ্র উপরে নির্ভরশীল হওয়ার পরিবর্তে তারা যে তাবিয লিখেছে এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকার দিকে ধাবিত করে। বরং তাদের অধিকাংশই মিথ্যা কথা বলে তাদেরকে ভয় দেখায়; অথচ তাদের কিছুই হয়নি। তারা যাকে ফাঁদে ফেলে তার সম্পদ হস্তগত করতে চায় যখন বুঝতে পারে যে, সে তার দ্বারা প্রভাবিত তখন তার কাছে এসে বলে যে, তোমার পরিবারে বা তোমার সম্পদে বা তোমার নিজের এমন এমন ঘটবে। কিংবা বলে যে, তোমার সাথে জ্বিন আছে কিংবা এ জাতীয় অন্য কিছু এবং এর সাথে শয়তানী ওয়াসওয়াসার প্রাথিমক কিছু আলামত ও কিছু বিষয় উল্লেখ করে। এমনভাবে বলে যেন সে তার ব্যাপারে সম্যক অবগত ও তার প্রতি খুবই সহমর্মী, তার কল্যাণ করতে আগ্রহী। যখন এই নির্বোধ ও মূর্খ লোকটির অন্তর সে যা উল্লেখ করেছে তা শুনে ভীত হয়ে উঠে তখন সে তার প্রভু থেকে বিমুখ হয়ে পুরোপুরিভাবে এই মিথ্যুকের দিকে মনোনিবেশ করে, তার কাছে আশ্রয় চায়, আল্লাহ্র বদলে তার উপরে নির্ভর করে এবং তাকে বলে: আপনি যে সমস্যার কথা উল্লেখ করলেন সেটা থেকে মুক্তির উপায় কী? এটি প্রতিরোধ করার কৌশল কী? যেন এই ব্যক্তির হাতেই কল্যাণ ও অকল্যাণ। এ পর্যায়ে এসে এ ব্যক্তির ব্যাপারে এই মিথ্যুকের আশা পূর্ণ হয় এবং তার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার লোভ আরও বেড়ে যায়। তখন সে বলে: ‘তুমি যদি আমাকে এত এত অর্থ দাও তাহলে আমি তোমার জন্য একটি পর্দা লিখে দিব। এই পর্দার দৈর্ঘ্য এত হবে, প্রস্থ এত হবে; এভাবে সে পর্দার বর্ণনা দেয় এবং রঙ রূপ দিয়ে সে তার কথা উপস্থাপন করে। এই পর্দাটি তুমি অমুক অমুক রোগ থেকে বাঁচার জন্য টানাবে।’ আপনি কি মনে করেন, এই বিশ্বাসের সাথে এই কর্মটি ছোট শির্ক? না; কক্ষণো নয়। বরং এটি গাইরুল্লাহ্কে উপাস্য বানানো, গাইরুল্লাহ্র উপরে নির্ভর করা, তার কাছে আশ্রয় চাওয়া, মাখলুকের কর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়া এবং তাদেরকে তাদের ধর্ম থেকে বিচ্যুত করা। শয়তান কি এ কৌশলগুলো তার দোস্ত মানুষ শয়তানদের মাধ্যম ছাড়া করতে সক্ষম হত? আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “বলুন, রাতে ও দিনে কে তোমাদেরকে রহমানের হাত থেকে বাঁচাতে পারে? কিন্তু তারা নিজেদের রবের উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।”[সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৪২]
এসব ছাড়াও এই তাবিযের নকশার সাথে কুরআনের কিছু অংশ লেখা হয় এবং অপবিত্র অবস্থায়ও সেটা ব্যক্তির সাথে লটকানো থাকে। চাই ব্যক্তি লঘু অপবিত্র হোক কিংবা গুরু অপবিত্র হোক; এটি সবসময় তার সাথে থাকে। কোন প্রকার অপবিত্রতা থেকে সে এটাকে পবিত্র রাখে না। আল্লাহ্র শপথ; ইসলামের দাবীদার এই জিন্দীকরা (ধর্মত্যাগীরা) আল্লাহ্র কিতাবের যেভাবে অমর্যাদা করে আল্লাহ্র কিতাবের শত্রুরাও এইভাবে অমর্যাদা করে না। আল্লাহ্র শপথ; কুরআন নাযিল হয়েছে তেলাওয়াত করা, এর উপর আমল করা, কুরআনের নির্দেশনাবলী পালন করা, নিষেধাজ্ঞাসমূহ থেকে বিরত থাকা, এর সংবাদসমূহে বিশ্বাস করা, এর সীমারেখাগুলোতে থেমে যাওয়া, এর উপমাসমূহ থেকে উপদেশ গ্রহণ করা, এর ঘটনাসমূহ থেকে নসিহত গ্রহণ করা এবং এটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নাযিলকৃত এ ঈমান আনার জন্য। অথচ এ লোকেরা এ সকল আমলকে বাদ দিয়েছে, তাদের পিছনে ছুড়ে মেরেছে। কুরআনের লিপি ছাড়া কুরআনের আর কিছু তারা সংরক্ষণ করেনি; যাতে এটা করে তারা ভুরিভোজন ও উপার্জন করতে পারে; অন্য সব উপকরণের মত। যার মাধ্যমে তারা হারাম উপার্জন পর্যন্ত পৌঁছতে পারে; হালাল উপার্জন নয়। যদি কোন বাদশাহ বা আমীর তার অধঃস্থন কারো কাছে এই মর্মে পত্র পাঠাত যে, তুমি এটা এটা কর, এটা এটা বর্জন কর, তোমার অধীনে যারা আছে তাদেরকে এ এ নির্দেশ দাও এবং এটা এটা থেকে বারণ কর ইত্যাদি; তারা যদি এ পত্রটি না পড়ে, এর নির্দেশ ও নিষেধাবলী নিয়ে চিন্তাভাবনা না করে এবং যাদের কাছে এর পয়গাম পৌঁছানোর কথা ছিল তাদের কাছে না পৌঁছিয়ে গলায় লটকায় কিংবা বাহুতে লটকায় এবং পত্রের মধ্যে যা লেখা আছে সেটার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তাহলে নিশ্চিত বাদশা তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিবে। সুতরাং আসমান ও জমিনের পরাক্রমশালীর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাবটির সাথে কী আচরণ হওয়া উচিত; আসমান ও জমিনের পরিপূর্ণ গুণ যার জন্য, আদি ও অন্তে প্রশংসা যার জন্য, সকল সিদ্ধান্তের মালিক যিনি! সুতরাং তাঁর ইবাদত করুন। তাঁর উপর নির্ভর করুন। তিনিই আমার জন্য যথেষ্ট। তিনি ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। আমি তাঁর উপরই নির্ভর করছি। তিনি মহান আরশের প্রভু। আর যদি এ তাবিযগুলো কুরআন-সুন্নাহ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে হয় তাহলে নিঃসন্দেহে এগুলো শির্ক। বরং ইসলাম পালনকারীদের বৈশিষ্ট্য থেকে দূরত্বের বিবেচনায় এগুলো আযলাম (ভাগ্য নির্ধারক বাটিসমূহ)-এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। যদি এ তাবিযগুলো কুরআন-সুন্নাহ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে হয়; যেমন- ইহুদীদের, প্রতিকৃতি পূজারীদের, জ্যোতিষীদের, ফেরেশতাদের কিংবা জ্বিন বশকারীদের নকশা দিয়ে হয় কিংবা পুতি, তাগা বা লোহার খোলশের হয় তাহলে এগুলো শির্ক; অর্থাৎ এগুলো লটকানো নিঃসন্দেহে শির্ক। যেহেতু এগুলো বৈধ উপকরণ কিংবা জানাশুনা কোন ঔষধ বা চিকিৎসা নয়। বরং তারা এসব তাবিজ-কবচের ব্যাপারে এমন একটি বিশ্বাস করছে যে, এগুলো অমুক অমুক ব্যথা থেকে সত্ত্বাগতভাবে নিজেই প্রতিরক্ষা করে; এগুলোর বিশেষ বিশেষত্বের কারণে যাতে তারা বিশ্বাস করে। ঠিক যেমন মূর্তিপূজারীরা তাদের মূর্তিগুলোর ব্যাপারে বিশ্বাস করে। বরং এটি জাহেলী যামানার ঐসব আযলাম (বাটি)-এর মত যে বাটিগুলোকে তারা সবসময় সাথে রাখত এবং যখনই কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইত তখনই এ বাটিগুলো দিয়ে তারা ভাগ্য নির্ধারণ করত। এমন তিনটি বাটি ছিল। একটির উপরে লেখা ছিল: কর। অন্য একটির উপরে লেখা ছিল: করো না। তৃতীয়টির উপরে লেখা ছিল: বিস্মৃতি ঘটেছে। যদি লটারীতে এই বাটিটি উঠত যার উপরে লেখা ছিল ‘কর’ তখন ব্যক্তি উদ্দিষ্ট কর্মে অগ্রসর হত। যদি এই বাটিটি উঠত যার উপরে লেখা ছিল ‘করো না’ তখন ব্যক্তি উদ্দিষ্ট কর্মটি বাদ দিতেন। আর যদি ‘বিস্মৃতি ঘটেছে’ লেখা বাটিটি উঠত তখন ব্যক্তি পুনরায় লটারী করত। আলহামদু লিল্লাহ্; আল্লাহ্ আমাদেরকে এগুলোর পরিবর্তে অন্য একটি উত্তম বদলা দিয়েছেন; সেটা হচ্ছে- ইস্তিখারার নামায ও দোয়া।
মূল কথা: কুরআন-সুন্নাহ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে যে সব তাবিয সেগুলো নষ্ট বিশ্বাস ও শরিয়তের বিরোধিতার ক্ষেত্রে এবং ইসলামের অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য থেকে দূরত্বের ক্ষেত্রে আযলাম (ভাগ্য বাটিগুলো)-র সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। কেননা নিরেট তাওহীদ এসব থেকে বহু দূরে। ইসলামের অনুসারীদের অন্তরে ঈমান এত মহান যে, এসব প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। তারা এত মহান মর্যাদা ও এত মজবুত একীনের অধিকারী যে, তারা গাইরুল্লাহ্র উপরে নির্ভর করতে পারে না এবং গাইরুল্লাহ্র প্রতি আস্থা রাখতে পারে না। আল্লাহ্ই তাওফিকের মালিক।”[মাআরিজুল কাবুল (২/৫১০-৫১২)]
আমাদের শাইখগণ তাবিয নিষিদ্ধ হওয়ার মতটি গ্রহণ করেছেন; এমনকি সে তাবিয কুরআন দিয়ে হলেও।
৩। স্থায়ী কমিটির আলোমগণ বলেছেন:
“যদি তাবিয-কবচ কুরআন ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে হয় তাহলে এমন তাবিয পরিধান করা হারাম হওয়ার ব্যাপারে আলেমগণ একমত। তবে যদি কুরআন দিয়ে হয় সেক্ষেত্রে তারা মতভেদ করেছেন। কেউ কেউ তাবিয পরাকে জায়েয বলেছেন; আর কেউ কেউ হারাম বলেছেন। হাদিসগুলোর সামগ্রকিতার দলিল এবং হারামের পথ রূদ্ধ করার দিক বিবেচনা থেকে তাবিয পরা হারাম হওয়ার অভিমতটি অগ্রগণ্য।”
শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায, শাইখ আব্দুল্লাহ্ বিন গুদইয়ান, শাইখ আব্দুল্লাহ্ বিন কূয়ূদ।[ফাতাওয়াল লাজনাদ দায়িমা (১/২১২)]
৪। শাইখ আলবানী (রহঃ) বলেন: “এখনও এই ভ্রষ্টতা বেদুঈন, কৃষক ও কিছু শহরবাসীদের মধ্যে বিদ্যমান। অনুরূপ ভ্রষ্টতা হল পুতি; কিছু কিছু ড্রাইভার তাদের গাড়ীর সামনের গ্লাসের সাথে যে পুতিগুলো লটকিয়ে রাখে। কেউ কেউ পুরোনো কোন একটি জুতা তার গাড়ীর সামনের অংশে কিংবা পিছনের অংশে টানিয়ে রাখে। আবার অন্য কেউ কেউ ঘোড়ার জুতা বাড়ীর সম্মুখভাগে কিংবা দোকানের সম্মুখভাগে লটকিয়ে রাখে। তারা দাবী করেন যে, এ সবকিছু বদনজর রোধ করার জন্য করা হয়। তাওহীদের ব্যাপারে অজ্ঞতার কারণে এ ধরণের আরও অনেক কিছুর সয়লাব হয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে শির্ক ও পৌত্তলিকতা; অথচ রাসূলগণকে প্রেরণ করা হয়েছে এবং কিতাবসমূহ নাযিল করা হয়েছে এগুলোকে প্রতিহত ও উৎখাত করার জন্য। আল্লাহ্র কাছেই মুসলমানদের অজ্ঞতা ও দ্বীন থেকে তাদের দূরে সরে যাওয়ার অভিযোগ পেশ করছি।”[সিলসিলাতুল আহাদিছিস সাহিহা (১/৮৯০, হাদিস নং ৪৯২)]
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।