আলহামদু লিল্লাহ।.
ইতিকাফ করার ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ হচ্ছে অধিক পরিপূর্ণ ও অধিকতর সহজ।
তিনি লাইলাতুল ক্বদরের সন্ধানে— একবার প্রথম দশদিন ইতিকাফ করেছেন; তারপর মাঝের দশদিন ইতিকাফ করেছেন; এরপর তাঁর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, লাইলাতুল ক্বদর শেষ দশকে। এর পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি শেষ দশকে ইতিকাফ করে গেছেন। একবার তিনি শেষ দশকে ইতিকাফ করতে পারেননি। তাই শাওয়াল মাসে সেটার কাযা পালন করেছেন। শাওয়াল মাসের প্রথম দশকে তিনি ইতিকাফ করেছেন।[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম]
যে বছর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু হয়েছে সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেছেন।[সহিহ বুখারী (২০৪০)]
এর কারণ সম্পর্কে বলা হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আয়ু শেষ হয়ে আসার বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন; তাই তিনি নেকীর কাজ বেশি করতে চেয়েছেন। যাতে করে তাঁর উম্মতের কাছে এ বিষয়টি তুলে ধরতে পারেন যে, যখন তারা শেষ বয়সে পৌঁছবে তখন তারা যেন আমলের ক্ষেত্রে পরিশ্রমী হয়; যাতে করে তারা তাদের সর্বোত্তম অবস্থায় আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাৎ করতে পারে।
অন্য মতে, এর কারণ হল প্রত্যেক রমযান মাসে জিব্রাইল আলাইহিস সালাম তাঁর সাথে একবার কুরআন পুনরাবৃত্তি করতেন। যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন সে বছর দুইবার পুনরাবৃত্তি করেছেন। তাই তিনি যতটুকু সময় ইতিকাফ করতেন তার দ্বিগুণ সময় ইতিকাফ করেছেন।
তবে সবচেয়ে মজবুত অভিমত হলো— তিনি সেই বছর বিশদিন ইতিকাফ করেছেন। কারণ আগের বছর তিনি মুসাফির ছিলেন। এর সপক্ষে প্রমাণ করে নাসাঈ, আবু দাউদ ও ইবনে হিব্বান প্রমুখ কর্তৃক সংকলিত উবাই বিন কাব (রাঃ) এর বর্ণিত হাদিস; হাদিসটির ভাষ্য আবু দাউদের: "নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। একবছর তিনি সফরে থাকায় ইতিকাফ করেননি। তাই পরের বছর তিনি বিশদিন ইতিকাফ করেছেন।"[ফাতহুল বারী থেকে সমাপ্ত]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছোট আকৃতির তাবু পাতার নির্দেশ দিতেন। মসজিদে তার জন্য এটি পাতা হত। তিনি তাতে অবস্থান করতেন এবং মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে তাঁর রবের অভিমুখী হতেন। যাতে করে নির্জনতার বাস্তব রূপ পূর্ণ হয়।
একবার তিনি তুর্কি তাবু (ছোট তাবু)-তে ইতিকাফ করেছেন এবং তাবুর মুখে একটা ছাটাই দিয়ে রেখেছিলেন। [সহিহ মুসলিম (১১৬৭)]
ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) যাদুল মাআদ গ্রন্থে (২/৯০) বলেছেন:
"এ সবকিছু করেছেন যাতে করে ইতিকাফের উদ্দেশ্য ও প্রাণ হাছিল হয়। এটি ছিল অজ্ঞ লোকেরা যা করে তথা ইতিকাফকে মেলামেশা ও সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাক্ষাৎস্থল হিসেবে গ্রহণ করা এবং তাদের মাঝে খোশ আলাপ জুড়ে দেয়া— এ সবের সম্পূর্ণ বিপরীত। এ ধরণের ইতিকাফের এক রঙ। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইতিকাফের আরেক রঙ।"[সমাপ্ত]
তিনি সারাক্ষণ মসজিদে অবস্থান করতেন। শুধু প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হতেন না। আয়েশা (রাঃ) বলেন: "যখন তিনি ইতিকাফে থাকতেন তখন প্রয়োজন ছাড়া বাসায় আসতেন না।"[সহিহ বুখারী (২০২৯) ও সহিহ মুসলিম (২৯৭)] মুসলিমের অপর এক রেওয়ায়েতে আছে: "মানবিক প্রয়োজন ছাড়া"। ইমাম যুহরী এর ব্যাখ্যা করেছেন: পেশাব ও পায়খানার প্রয়োজন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করে চলতেন। তিনি আয়েশা (রাঃ) এর কামরার দিকে মাথা ঢুকিয়ে দিতেন। আয়েশা (রাঃ) তাঁর মাথা ধুয়ে চিরুনি করে দিতেন।
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, "নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে ইতিকাফে থাকাবস্থায় আমার দিকে তাঁর মাথা ঢুকিয়ে দিতেন। আমি হায়েয অবস্থা নিয়ে তাঁর মাথা আঁচড়িয়ে দিতাম।[সহিহ বুখারী (২০২৮) ও সহিহ মুসলিম (২৯৮)] সহিহ বুখারী ও মুসলিমের অপর রেওয়ায়েতে আছে: "আমি তাঁর মাথা ধুয়ে দিতাম"।
হাফেয ইবনে হাজার বলেন:
"এ হাদিসে মাথা আঁচড়ানোর অধিভুক্ত হিসেবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সুগন্ধি ব্যবহার, গোসল করা, মাথা মুণ্ডন করা, পরিপাটি হওয়া ইত্যাদি জায়েয হওয়ার পক্ষে প্রমাণ রয়েছে। জমহুর আলেমের অভিমত হচ্ছে— মসজিদে যা কিছু করা মাকরুহ কেবল সে সব ছাড়া ইতিকাফ অবস্থায় অন্যসব কিছু করা মাকরুহ নয়।[সমাপ্ত]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ছিল তিনি ইতিকাফে থাকাবস্থায় কোন রোগী দেখতে যেতেন না, কোন জানাযার নামাযে শরীক হতেন না। যাতে করে আল্লাহ্ তাআলার আরাধনায় পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারেন এবং ইতিকাফের গূঢ় রহস্য বাস্তবায়ন করতে পারেন। আর তা হল: মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহ্ অভিমুখী হওয়া।
আয়েশা (রাঃ) বলেন: "ইতিকাফকারীর জন্য সুন্নত হল— রোগী দেখতে না যাওয়া, জানাযার নামাযে না যাওয়া, কোন নারীকে স্পর্শ না করা ও শৃঙ্গার না করা এবং একান্ত যে প্রয়োজনে বের না হলে নয়; এমন প্রয়োজন ছাড়া বের না হওয়া।"[সুনানে আবু দাউদ (২৪৭৩), আলবানী হাদিসটিকে সহিহ সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে সহিহ বলেছেন]
"কোন নারীকে স্পর্শ না করা ও শৃঙ্গার না করা" এর দ্বারা আয়েশা (রাঃ) সহবাস বুঝাতে চেয়েছেন— শাওকানী নাইলুল আওতার গ্রন্থে এ কথা বলেছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিকাফে থাকাবস্থায় তাঁর কোন এক স্ত্রী তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। যখন তাঁর স্ত্রী চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন তখন তিনিও তাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য তার সাথে উঠে দাঁড়ালেন। এটি ছিল রাতের বেলায়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী সাফিয়্যা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশকে মসজিদে ইতিকাফ করাকালে তিনি তাঁর সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি কিছু সময় তাঁর সাথে কথা বলেন। এরপর চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ান। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য তা সাথে উঠে দাঁড়ান।[সহিহ বুখারী (২০৩৫) ও সহিহ মুসলিম (২১৭৫)]
সারকথা হলো: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইতিকাফের বৈশিষ্ট্য ছিল সহজতা ও কাঠিন্যবিহীন। গোটা সময় ছিল আল্লাহ্র যিকির, তাঁর ইবাদত ও লাইলাতুল ক্বদরের সন্ধানে মশগুল।
[দেখুন: ইবনুল কাইয়্যেম-এর 'যাদুল মাআদ' (২/৯০), ড. আব্দুল লতিফ বালতু-এর 'আল-ইতিকাফ: নাযরা তারবাওয়িয়্যাহ']