আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
যখন কোন মানুষ বলে: ‘ইয়া মুহাম্মদ’, ‘ইয়া আলী’ এ কথার দুইটি অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে:
১. যাকে সম্বোধন করা হচ্ছে তার কাছে কোন কিছু তলব না করে তার চিত্র মানসপটে আনা; যেমন- ইয়া মুহাম্মদ বলে চুপ করে যাওয়া কিংবা ‘ইয়া মুহাম্মদ, সাল্লাল্লাহু আলাইকা’ বলা– এটি শির্ক নয়। কেননা এর মধ্যে গাইরুল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা নেই।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: “ ‘ইয়া মুহাম্মদ’, ‘ইয়া নবী’ এগুলো এবং এ জাতীয় অন্য কথাগুলো সম্বোধনসূচক। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- সম্বোধিত ব্যক্তিকে অন্তরে স্মরণ করা এবং অন্তরে উপস্থিত ব্যক্তিকে সম্বোধন করা। যেমনটি নামাযী ব্যক্তি বলে থাকেন: “আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ” (হে নবী, আপনার প্রতি শান্তি, আল্লাহ্র রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক)। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ এ ধরণের সম্বোধন করে থাকে। নিজের মনে যাকে কল্পনা করছে তাকে সম্বোধন করে থাকে যদিও বহির্জগতে সে তার সম্বোধন শুনে না।”[ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম লি মুখালাফাতি আসহাবিল জাহিম (২/৩১৯)]
২. এই সম্বোধনটির মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রার্থনা অন্তর্ভুক্ত থাকা; যেমন এভাবে বলা- হে মুহাম্মদ, আমার জন্য অমুক অমুক কাজ করে দিন। কিংবা এর মধ্যে পরোক্ষ প্রার্থনা অন্তর্ভুক্ত থাকা; যেমন- যে ব্যক্তি বড় কোন পাথর কিংবা ভারী কোন কিছু বহনকালে বলে: ‘ইয়া মুহাম্মদ’– এটা ইস্তিআনা তথা সাহায্য প্রার্থনা। এ দুটোই আল্লাহ্র সাথে শির্ক। কেননা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন মৃতব্যক্তি বা অনুপস্থিত ব্যক্তিকে ডাকা কুরআন-সুন্নাহ্ এর দলিল ও ইজমার প্রমাণের ভিত্তিতে শির্ক।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “সুতরাং তার চেয়ে কে অধিক যালিম, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ রটায় কিংবা তাঁর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে। তাদের ভাগ্যে লিখিত অংশ তাদের কাছে পৌঁছবে। অবশেষে যখন আমার প্রেরিত-দূতরা (ফেরেশতারা) তাদের নিকট তাদের জান কবজ করতে আসবে, তখন তারা বলবে, ‘কোথায় তারা, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাকতে’? তারা বলবে, ‘তারা আমাদের থেকে হারিয়ে গিয়েছে’ এবং তারা নিজদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে যে, নিশ্চয় তারা ছিল কাফির।”[সূরা আরাফ, আয়াত: ৩৭]
আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন: “আর আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুকে ডেকো না, যা তোমার উপকার করতে পারে না এবং তোমার ক্ষতিও করতে পারে না। অতএব তুমি যদি কর, তাহলে নিশ্চয় তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”।[সূরা ইউনুস, আয়াত: ১০৬]
আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন: “তারা যখন নৌযানে আরোহণ করে, তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে স্থলে পৌঁছে দেন, তখনই তারা শির্কে লিপ্ত হয়।”।[সূরা আনকাবুত, আয়াত: ৬৫] এখানে শির্ক দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- গায়রুল্লাহ্কে ডাকা তথা প্রার্থনা করা।
আল্লাহ্ আরও বলেন: “আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকে, যে বিষয়ে তার কাছে কোন প্রমাণ নেই; এর হিসাব (শাস্তি) হবে কেবলই তার রবের কাছে। নিশ্চয় কাফিরেরা সফলকাম হবে না।”[সূরা মুমিনূন, আয়াত: ১১৭] যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহ্কে ডাকে এটি তার ব্যাপারে সাধারণ হুকুম। আহুত সত্তাকে সে উপাস্য অভিহিত করুক কিংবা সাইয়্যেদ অভিহিত করুক কিংবা ওলী বা কুতুব অভিহিত করুক– হুকুমে কোন পার্থক্য নেই। কেননা আরবী ভাষায় ‘ইলাহ্’ বলা হয় উপাস্যকে। অতএব, যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহ্ এর উপাসনা করল সে তাকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করল। যদিও মৌখিকভাবে সে এটা অস্বীকার করুক না কেন।
এগুলো ছাড়াও অনেক সুস্পষ্ট আয়াতে কারীমসমূহ রয়েছে।
সহিহ বুখারীতে (৪৪৯৭) এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, সে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন অংশীদারকে ডাকে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।”
আলেমগণ এই মর্মে ইজমা (ঐকমত্য) করেছেন যে, যে বক্তি তার মাঝে ও আল্লাহ্র মাঝে বিভিন্ন-মাধ্যম বানিয়ে সেসব মাধ্যমকে ডাকে ও মাধ্যমদের উপর নির্ভর করে তারা কাফের। এই বিধান থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডাকাও বাদ দেয়া হয়নি।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: “যে ব্যক্তি ফেরেশতাদেরকে কিংবা নবীদেরকে মাধ্যম বানিয়ে তাদেরকে ডাকে, তাদের উপর নির্ভর করে, কল্যাণ আনয়ন ও অকল্যাণ দূর করার জন্য তাদের কাছে প্রার্থনা করে; যেমন- গুনাহ মাফ, অন্তরের হেদায়েত প্রাপ্তি, বিপদাপদ দূর হওয়া, অভাব দূর হওয়ার জন্য তাদের কাছে প্রার্থনা করে মুসলিম উম্মাহ্র ইজমা অনুযায়ী সে কাফের।[মাজমুউল ফাতাওয়া (১/১২৪) থেকে সমাপ্ত]
এ ইজমার প্রতি সম্মতি জানিয়ে একাধিক আলেম তা (নিজেদের গ্রন্থে) উদ্ধৃত করেছেন। যেমন দেখুন: “ইবনে মুফলিহ এর ‘আল-ফুরু’ (৬/১৬৫), ‘আল-ইনসাফ’ (১০/৩২৭), ‘কাশ্শাফুল ক্বিনা’ (৬/১৬৯), ‘মাতালিবু উলিন নুহা’ (৬/২৭৯)।
কাশ্শাফুল ক্বিনা গ্রন্থে এই ইজমাটি উল্লেখ করার পর ‘মুরতাদ এর হুকুম পরিচ্ছেদ’-এ বলেন: কেননা তা মূর্তিপূজারীদের কর্মের মত যারা বলে: “আমরা কেবল এজন্যই তাদের ‘ইবাদাত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।”[সমাপ্ত]
দুই:
এই শির্ক জায়েয হওয়ার পক্ষে যথাযথভাবে দলিল দেয়া যেতে পারে কিতাব-সুন্নাহ্তে এমন কিছু নেই। থাকতো এই শির্কের দিকে আহ্বান করা কিংবা উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে কিছু থাকবে। কিভাবেই বা থাকবে! আল্লাহ্ তাঁর কিতাবে যে জিনিসকে শির্ক ও কুফর হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন সে কিতাবে কিভাবে এমন কিছু থাকবে যা ওটাকে বৈধতা দিবে!
জনৈক ব্যক্তির পা-অবশ হয়ে যাওয়া সংক্রান্ত যে আছার (বর্ণনা) আপনি উদ্ধৃত করেছেন সে আছারের সনদ সহিহ নয়। যদি সহিহও হয় তাতেও এর মধ্যে দলিল নেই। কারণ সেটা সম্বোধিত ব্যক্তির চিত্র মানসপটে স্মরণ করা শ্রেণীয়; যেমনটি ইতিপূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি এবং এর মধ্যে গায়রুল্লাহ্র কাছে কোন প্রার্থনা নেই।
এই উক্তিটি সম্পর্কে ইতিপূর্বে 162967 নং প্রশ্নোত্তরে বিস্তারিত জবাব দেয়া হয়েছে।
তিন:
‘ইয়া মুহাম্মাদাহ্’ (হায় মুহাম্মাদ), ‘ওয়া মুহাম্মদাহ’ (হায় মুহাম্মাদ) শ্লোগান সাহাবীগণ কর্তৃক যুদ্ধের সময় ব্যবহার করার বিষয়টি সহিহ সাব্যস্ত নয়; অচিরেই সে আলোচনা আসবে। আর যদি সহিহ সাব্যস্ত ধরে নেয়া হয় তবুও সেটা প্রার্থনা বা সাহায্য-প্রার্থনার শ্রেণীয় নয়। কারণ এতে কোন প্রার্থনা নেই; এটা পরিষ্কার। বরং এটি শোকার্থ জ্ঞাপক। যার জন্য শোক করা হচ্ছে- তাকে ডাকা। যেন মুসলমানেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ও তাঁর দ্বীনের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করে পরস্পর পরস্পরের হিম্মতকে চাঙ্গা করে নিচ্ছেন। যেমন- তারা বলে থাকেন ওয়া ইসলামাহ্ (হায় ইসলাম)।
শোকার্থ জ্ঞাপক অভিব্যক্তি وا (ওয়া) দিয়ে আসে এবং يا (ইয়া) দিয়েও আসে। যেমনটি বলেছেন ইবনে মালিক তাঁর আলফিয়্যাহ্-তে
و(وا) لمن نُدب * أو (يا) ، وغير (واو) لدى اللبس اجتُنب.
(অনুবাদ: যার জন্য দুঃখ করা হচ্ছে তার ক্ষেত্রে وا। কিংবা يا। আর ভুল বুঝার সম্ভাবনা থাকলে واو (ওয়াও) ছাড়া অন্যটি বর্জনীয়।)
আল-উশমুনি বলেন: (وَوَا لِمَنْ نُدِبْ) এর মানে যার জন্য ব্যথিত হওয়া হচ্ছে কিংবা যে অঙ্গ থেকে ব্যথা হচ্ছে। যেমন বলা হয়: وا ولداه (হায় আমার ছেলে), وا رأساه (হায় আমার মাথা)। কিংবা বলা হবে يا (ইয়া) দিয়ে। যেমন- يا ولداه (হায় আমার ছেলে), يا رأساه (হায় আমার মাথা)। “ওয়াও ছাড়া অন্যটি” সেটা হচ্ছে- ‘ইয়া’। “আর ভুল বুঝার সম্ভাবনা থাকলে অন্যটি বর্জনীয়” অর্থাৎ শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে যদি ভুল বুঝার সম্ভাবনা না থাকে শুধু সেক্ষেত্রে ‘ইয়া’ ব্যবহার করুন। যেমন কেউ একজন বলেছেন:
حَمَلتَ أَمْرَاً عَظِيمَاً فَاصْطَبَرْتَ لَهُ * وَقُمْتَ فِيهِ بِأَمْرِ اللَّهِ ؛ يَا عُمَرَا
আর যদি ভুল বুঝার সম্ভাবনা থাকে সেক্ষেত্রে ওয়াও ব্যবহার করা অবধারিত।”[উশমুনি কৃত ‘আলফিয়্যা’ এর ব্যাখ্যা (১/২৩৩) থেকে সমাপ্ত]
ঠিক একই রকম ব্যবহার ফাতেমা (রাঃ) এর উক্তিতেও পাওয়া যায়। নবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুতে তিনি বলেছিলেন: “ও আমার বাবা! (ইয়া আবাতাহ), যিনি তার রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন”। অপর এক বর্ণনায় এসেছে- ‘ওয়া আবাতাহ’।
ইমাম বুখারী (৪৪৬২) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “যখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর রোগ প্রকট রূপ ধারণ করল তখন তিনি জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। এ অবস্থায় ফাতেমা (রাঃ) বললেন, ‘ওয়া কারবা আবাতাহ (উহ্! আমার পিতার কত কষ্ট)! তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বললেন, আজকের পরে তোমার পিতার উপর আর কোন কষ্ট নেই। যখন তিনি মারা গেলেন তখন ফাতেমা (রাঃ) বললেন, হায়! আমার পিতা (ইয়া আবাতাহ)! রবের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। হায় আমার পিতা (ইয়া আবাতাহ)! জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁর বাসস্থান। হায় আমার পিতা (ইয়া আবাতাহ)! জিবরীল (আঃ)- কে তাঁর মৃত্যুর খবর শুনাই। যখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর দাফন শেষ হল, তখন ফাতিমা (রাঃ) বললেন: হে আনাস! রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মাটি চাপা দিয়ে আসা তোমরা কীভাবে বরদাশত করলে?!
সুনানে ইবনে মাজাহ (১৬৩০) এর বর্ণনায় এসেছে- “হায় আমার পিতা (ইয়া আবাতাহ)! জিব্রাঈল (আঃ)- কে তাঁর মৃত্যুর খবর শুনাই। হায় আমার পিতা (ইয়া আবাতাহ)! তাঁর রবের কতই না কাছে চলে গেছেন! হায় আমার পিতা (ইয়া আবাতাহ)! জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁর বাসস্থান। হায়! আমার পিতা (ইয়া আবাতাহ)! রবের ডাকে সাড়া দিয়েছেন”।
এই ডাকগুলো শোকার্থ জ্ঞাপক; সাহায্য-প্রার্থনা বা প্রার্থনাসূচক নয়।
ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন: ফাতেমা (রাঃ)-এর কথা: "يا أبتاه" (ইয়া আবাতাহ): যেন তিনি বলেছেন: يا أبي (ওগো আমার আব্বু)। أبتاه এর মধ্যে উপরে দুই নোকতাবিশিষ্ট ‘তা’ এসেছে দুই নোকতাযুক্ত ‘ইয়া’ এর বদলে। আলিফ এসেছে শোক জ্ঞাতার্থে এবং স্বরকে দীর্ঘ করণার্থে। আর ‘হা’ এসেছে- শব্দের সমাপ্তি জ্ঞাতার্থে।[ফাতহুল বারী (৮/১৪৯) থেকে সমাপ্ত]
আমরা ইতিপূর্বেই ইঙ্গিত করেছি যে, এই শ্লোগানটি সাব্যস্ত হয়নি।
যে ব্যক্তি বলেন যে, হাফেয ইবনে কাছির উল্লেখ করেছেন যে, ইয়ামামা যুদ্ধের দিন মুসলমানদের শ্লোগান ছিল ‘ওয়া মুহাম্মাদাহ’ (হায় মুহাম্মাদ): এই কথা রদ করে শাইখ সালেহ আলে-শাইখ বলেন: আমি বলব, ইবনে কাছির (রহঃ) এ উক্তিটি যুদ্ধ বিষয়ক দীর্ঘ এক সংবাদের মধ্যে উদ্ধৃত করেছেন। সে উদ্ধৃতিতে ঐতিহাসিকদের একজনের কথা অন্যের কথার মধ্যে ঢুকে গেছে। এই শ্লোগানটি ইবনে জারীর তাঁর ‘তারিখুল উমামি ওয়াল মুলুক’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন: আমার কাছে সারিয়্য লিখেছেন শুয়াইব থেকে তিনি সাইফ থেকে তিনি যাহ্হাক বিন ইয়ারবু থেকে তিনি তাঁর পিতা থেকে তিনি বনী সুহাইম এর কোন এক লোক থেকে বর্ণনা করেন যে, এরপর ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন এবং ঘটনার মধ্যে শ্লোগানটিও উল্লেখ করেছেন।
আমি বলব: এটি একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ‘সনদ’। আকিদা ও তাওহিদের মাসয়ালা তো নয়, বরং শরিয়তের অন্যান্য বিধি-বিধানও ইতিহাস গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয় না। বরং ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো বর্ণনা করা হয় শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য এবং ঘটনার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নয়; বরং সামগ্রিকভাবে ঘটনাগুলোকে বিশ্বাস করার জন্য। ইমাম আহমাদ বলেন: “তিনটি জ্ঞানের কোন ভিত্তি নেই। এর মধ্যে মাগাজি বা যুদ্ধবিগ্রহ বিষয়ক জ্ঞানকেও উল্লেখ করেন”।
এই সনদটি তিনটি দিক থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন:
১। সাইফ নামের রাবী তিনি ‘আল-ফুতুহ্’ গ্রন্থ ও ‘আল-রিদ্দা’ গ্রন্থের রচয়িতা ‘উমর’ এর সন্তান। তিনি অনেক মাজহুল (অজ্ঞাত-অবস্থা) মানুষ থেকে বর্ণনা করেন।
ইমাম যাহাবী তাঁর ‘মিযানুল ইতিদাল’ (২/২৫৫) গ্রন্থে বলেন: মুতায়্যিন ইয়াহইয়া থেকে বর্ণনা করেছেন: একটি মুদ্রা তার (সাইফ) এর চেয়ে উত্তম। আবু দাউদ বলেন: তিনি কিছুই না।
আবু হাতিম বলেন: তিনি মাতরুক (বর্জনীয়)।
ইবনে হিব্বান বলেন: তার বিরুদ্ধে ধর্মত্যাগের অভিযোগ দেয়া হয়।
ইবনে আদি বলেন: তার সকল হাদিস ‘মুনকার’।[সমাপ্ত]
২। আয্যাহ্হাক বিন ইয়ারবু:
আল-আযদি বলেন: তার হাদিস যথাযথ নয়। আমি বলব: তিনি হচ্ছেন ঐ সব মাজহুল (অজ্ঞাত-অবস্থা) এর অন্তর্ভুক্ত ‘সাইফ’ যাদের থেকে বর্ণনা করেছেন।
৩। ইয়ারবু এর অজ্ঞাত-অবস্থা এবং সুহাইমি গোত্রের লোকটির অজ্ঞাত-পরিচয়।
এই ইলালগুলোর (দোষগুলোর) প্রত্যেকটি হাদিসকে দুর্বল প্রতীয়মান করে। এরপর হাদিসটি যদি সাইফ বিন উমর এর বর্ণনাকৃত হয় তখন কেমন হয়? ইতিপূর্বে আপনি সাইফ সম্পর্কে জেনেছেন। আমরা আল্লাহ্র কাছেই নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি।
ইবনে জারীর এ ধরণের অমূলক ঘটনা উল্লেখ করা ও তার পরবর্তী অপরাপর ঐতিহাসিকগণ সে ঘটনার উল্লেখ করায় নিন্দা করার কিছু নেই। কারণ ইবনে জারীর তার ‘তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক’ গ্রন্থের ভূমিকায় (১/৮) বলেছেন: “আমি যদি আমার এই কিতাবে পূর্ববর্তীদের থেকে এমন কোন ঘটনা উল্লেখ করে থাকি যে ঘটনা পড়ে পাঠক ভ্রু কুচকে ফেলে, শ্রোতা চোখ কপালে তোলে– সংশ্লিষ্ট ঘটনার কোন সত্যতা বা ভিত্তি না থাকার কারণে; সেক্ষেত্রে তারা জেনে রাখুন যে, এটি আমাদের পক্ষ থেকে আসেনি। বরং আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন এমন কিছু বর্ণনাকারীদের থেকে এসেছে। আমাদের কাছে যেভাবে এসেছে আমরা ঠিক সেভাবে বর্ণনা করেছি।”[শাইখ সালেহ আলে-শাইখ এর ‘হাযিহি মাফাহিমুনা’ পৃষ্ঠা-৫২ থেকে সমাপ্ত]
চার:
ইউসুফ (আঃ) এর ভাইদের সম্পর্কে আল্লাহ্ যা উল্লেখ করেছেন: “তারা বলল, ‘হে আমাদের পিতা, আপনি আমাদের পাপ মোচনের জন্য ক্ষমা চান। নিশ্চয় আমরা ছিলাম অপরাধী। তিনি বললেন, ‘অচিরেই আমি তোমাদের জন্য আমার রবের নিকট ক্ষমা চাইব, নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৯৭,৯৮] সেটা হচ্ছে জীবিত ও সক্ষম ব্যক্তির কাছে দোয়া চাওয়া; আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে এতে কোন অসুবিধা নেই।
তাঁদের কথা: "استغفر" এর অর্থ হচ্ছে- আপনি আমাদের জন্য ক্ষমা চান। তারা এ কথা বলেনি যে, আমাদেরকে ক্ষমা করুন; যেমনটি আপনি ভুল বুঝেছেন।
অপর কারো কাছে দোয়া চাওয়া বৈধ হওয়ার ব্যাপারে অনেক দলিল রয়েছে। যেমন- উওয়াইস কারনি এর দীর্ঘ হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমর (রাঃ)কে বলেন: “...যদি তুমি তার কাছে তোমার জন্য দোয়া চাইতে পার তাহলে সেটা কর। এ কারণে উমর (রাঃ) উওয়াইস এর কাছে এসে বললেন: আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।”[সহিহ মুসলিম (২৫৪২)]
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন: “পরিচ্ছেদ: মর্যাদাবান ব্যক্তির কাছ থেকে দোয়া চাওয়া মুস্তাহাব, যদিও দোয়া-প্রার্থী প্রার্থিত ব্যক্তির চেয়ে উত্তম হোক না কেন এবং মর্যাদাবান স্থানসমূহে দোয়া করা: জেনে রাখুন এ বিষয়ক হাদিস অগণিত। বরং এটি একটি ইজমা-সিদ্ধ (মতৈক্যপূর্ণ) বিষয়।”[আল-আযকার, পৃষ্ঠা-৬৪৩ থেকে সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত]
সারকথা হচ্ছে: যদি কেউ বলে, ‘ইয়া মুহাম্মদ’ এর মূল বিধান হচ্ছে– বৈধতা; যতক্ষণ পর্যন্ত না এতে সরাসরি বা পরোক্ষ প্রার্থনা অন্তর্ভুক্ত না হয়। যদি অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে সেটা শির্ক।
তদুপরি আপনার জন্য উপদেশ হচ্ছে– এ ধরণের ডাক দেয়া কিংবা বেশি বেশি এটি বলা থেকে দুইটি কারণে বিরত থাকুন:
১. এই কথা বলার কারণে আপনার প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা হতে পারে যে, আপনি গায়রুল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করছেন।
২. হতে পারে আপনি এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন এবং কোন কাজ করাকালে ও সহযোগীর দরকার হলে আপনি এই ডাক দিয়ে বসবেন। বরং আপনার উচিত ‘ইয়া আল্লাহ্’, ‘ইয়া হাইয়্যু’, ‘ইয়া কায়্যুম’, ‘ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম’ বলায় নিজের জিহ্বাকে অভ্যস্ত করে তোলা। কোন বান্দা বা দাসের জন্য তার মনিবের কাছে প্রার্থনা করা, তার কাছে মিনতি করা ও সর্বাবস্থায় তাকে ডাকার চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আর কিছু নেই।
পাঁচ:
যে ব্যক্তি শির্কে লিপ্ত হয়েছে এবং তাওবা করেছে আল্লাহ্ তার তাওবা কবুল করবেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেন:
“আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডাকে না এবং যারা আল্লাহ যে নাফসকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর যারা ব্যভিচার করে না। আর যে তা করবে সে আযাবপ্রাপ্ত হবে। কিয়ামতের দিন তার আযাব বর্ধিত করা হবে এবং সেখানে সে অপমানিত অবস্থায় স্থায়ী হবে। তবে যে তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে পরিণামে আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে পূণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[সূরা ফুরক্বান, আয়াত: ৬৮-৭০]
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।